ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আজাদ এহতেশাম

জুলফিকার মতিনের কবিতায় সমাজ ও স্বদেশ

প্রকাশিত: ০৭:০২, ২১ জুলাই ২০১৭

জুলফিকার মতিনের কবিতায় সমাজ ও স্বদেশ

আধুনিক বাংলা সাহিত্যে সৃজন প্রতিভার উজ্জ্বল্যে হাতে গোনা যে কজন কবি সাহিত্যিক আধুনিক বাংলা কাব্যাঙ্গনে একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছেন কবি জুলফিকার মতিন তাঁদের অগ্রগণ্য নিঃসন্দেহে। নিভৃতচারী এই কাব্যকুলশী কবি, প্রাবন্ধিক ও উপন্যাসিক এবং ছোট গল্পকার নিরবচ্ছিন্নভাবে লিখে চলছেন কিন্তু সাহিত্যবোদ্ধা ও সমালোচকের পাদপ্রদীপের অগ্রভাবে কখনো বিশেষভাবে থিতু হননি। স্বীয় কর্ম নৈপুণ্যের প্রচার, খ্যাতি যশ কোনটিই তাঁর স্বভাবজাত নয়, তাই মিডিয়াকরের ভূমিকা থেকে তিনি অনেক দূরে। সমকালীনতা ও যুগ যন্ত্রণার নানা অভিঘাত, গভীর অন্তর্দৃষ্টি তাঁর জীবনবোধের সংবৃত্তিতে সন্দীপিত হয়ে উঠেছে কাব্য পঙ্ক্তিতে অঝর ধারায়। জুলফিকার মতিনের কাব্যে সমাজ ও স্বদেশ ভাবনা প্রকটভাবে উদ্ভিন্ন হয়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধত্তোরকালে নানা সঙ্কট ও অসঙ্গতির প্রেক্ষাপটে। তিনি পরিপূর্ণ সমাজ ও রাজনীতি সচেতন কবি- এ কারণে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে দেশে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, ভুঁইফোড় রাজনীতিক এবং প্রতারক, শোষক শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে তার অনুপুক্সক্ষ চিত্র কবিতায় ভাস্বর হয়ে উঠেছে প্রতিবাদ ও হতাশার সংবেগে এবং অনেক সময় ব্যঙ্গ বিদ্রƒপের তীর্যক বাক্যবাণে সমকালীন জীবনের নানা সঙ্কট ও অসঙ্গতিকে সমাজের চোখে মোটাদাগে উপস্থাপিত করেছেন। গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ রচনায় তাঁর দক্ষতা ও কৃতিত্ব সাহিত্যবোদ্ধা মহলে থাকলেও কাব্য সাহিত্যে তাঁর প্রতিভার স্ফুরণ ঈর্ষণীয় নিঃসন্দেহে। সংখ্যা বিচারে তাঁর কাব্যগ্রন্থের তালিকা দীর্ঘ না হলেও কাব্যগুণের উৎকর্ষতায় ও শৈল্পিকমানে কালোত্তীর্ণ এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তাঁর রচিত কাব্য গ্রন্থগুলো হলো : ‘স্বৈরিণী স্বদেশ তুই (১৯৭২)’, ‘কোন লক্ষ্যে হে নিষাদ (১৯৮৯)’, ‘তাইতো সংবাদ নেই (১৯৯৯)’, ‘নীলিমাকে চাঁদ দেবো বলে (২০০০)’, ‘বৈশাখে ঝড় জল রোদের কবিতা (২০০০)’, ‘ঘামের ওজন কত ভারী (২০০১)’, ‘দুঃখ ভোলার দীর্ঘশ্বাস (২০০৫), ‘এই সংবাদ এই একুশ (২০০৭)’ ইত্যাদি। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘স্বৈরিণী স্বদেশ তুই’ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই স্বদেশ ও সমাজ ভাবনার পরিচয় বিষয়ে পাঠকের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়। যৌবনের প্রারম্ভের কবিতাগুলোতে প্রেম প্রকৃতি ও নারীর অনুষঙ্গ প্রক্টিত হলেও সে মোহ ছিন্ন হয়েছে পরবর্তী কাব্যগুলোতে। অনেক সময় তাঁর কাব্যে সীমাহীন নিঃসঙ্গতা ও নিরুদ্বিগ্নতা জীবনবোধের গভীর অনুধ্যানে মূর্ত হয়ে উঠেছে নারী সৌন্দর্যের অবয়বে। যদিও পরবর্তীতে প্রেম, নারী ও সৌন্দর্য সমাজ ও স্বদেশ ভাবনায় সংস্পর্শে ফিকে হয়ে উঠেছে। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় নানা অভিঘাত ব্যথিত কবি চিত্তের অন্তরালে যে দীর্ঘশ্বাস ধূমায়িত হয়ে উঠেছে তাঁর বহিঃপ্রকাশ লাখ করা যায় পরবর্তী কাব্যের পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে। মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে নানা পরিবর্তন সূচিত হয়। চারদিকে যুদ্ধের ভয়াবহ ক্ষতচিহ্ন, খাদ্য সংকট, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ইত্যাদি মধ্যবিত্তের সঙ্কটকে আরও বিপর্যস্ত করে তোলে। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ স্বাচ্ছন্দ্য এবং বিলাসীতায় জীবন কাটালেও দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবন ধারণে নাভিশ্বাস ওঠে। কবির ব্যথিত চিত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ সঙ্কটাপূর্ণ সাধারণ মানুষের কল্যাণেই ব্যথিত হয়ে উঠেছে। কবির অন্তর্জাত উপলব্ধি : ... আমি বয়ে যাব সে নিশানখানি যে নিশান হাতে নিয়ে জনতার পুরোভাগে বর আমি। বুকে মোর অগ্নিশপথ কোন বাধা কোনদিন রুখিবেনা পথ। ভেঙ্গে যাক এ পৃথিবী ফেটে ফেটে খান খান হোক চৌচির নতুন দিনের গানে হৃদয় অধীর। [‘রাত্রির কোন গান’] কবি পরিপূর্ণ রাজনৈতিক সচেতন ছিলেন জীবনের প্রারম্ভ থেকেই। ষাটের দশকে পূর্ববাংলার রাজনীতিতে নানা টানা পোড়েন ও সঙ্কট শুরু হতে থাকে। স্বৈরাচারী আইয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। এ সময়ে কবি দৃঢ়চিত্তে আন্দোলিত সংগ্রামী জনতার অনুভাব সন্নিবদ্ধ করে উপস্থাপিত করেছেন কবিতার আখরে। নারী সঙ্গ প্রেম ও রোমান্টিকতা অন্বিত থাকেননি। এ বিষয়ে কবির উপলব্ধি : আর যেন না দেখি পূর্ণিমার চাঁদ আর ঝলমল, মায়াবী আকাশ আর যেন না শুনি উষ্ণ সুর ভালো লাগা হৃদয়ের শ্বাস আর যেন না দেখি ফুল আর সে নারীর মুখ ছিন্ন হোক ছিন্ন হোক ঝিলমিল সেই হাসিটুক। [‘রাত্রির কোন গান’] কবির সমাজতান্ত্রিক চিন্তাচেতনার পরিচয় পাওয়া যায় প্রথম দিককার বেশকিছু কবিতায়। সমাজতন্ত্রের মূলমন্ত্র সাম্যবাদিতা তাঁর কবিতায় দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। শ্রেণী বৈষম্য, ধর্মীয় ভেদাভেদ জাত-পাতের ঊর্ধ্বে থেকে কবিতা রচনায় প্রয়াসী হয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ব্যথিত হয়েছেন এই ভেবে যে, এই সুজলা-সুফলা প্রাকৃতিক সম্পদ ও ঐশ্বর্যশালী দেশ বার বার আক্রমণের শিকার হয়েছে বিদেশীদের দ্বারা। লোভও ক্রোধের উন্মত্ততায় তারা এদেশের ক্ষতিসাধন করেছে বারংবার: সে সংবাদ দেশে আগুনের ন্যায় পরিব্যপ্ত হয়ে আসে বীর পুরুষেরা সশস্ত্র হাতে বীরভোগ্য। স্বদেশের স্তন ছিঁড়ে দুধ খায়- মন্থনে মধু ...। [‘স্বৈরিণী স্বদেশ তুই’] বিদেশী দস্যু-ডাকাত, মোগল-পাঠান- ডাচ, এবং সর্বশেষ ব্রিটিশ বেণীয়া এদেশকে আক্রমণ করে স্বার্থ লুটেছে যুগের পর যুগ ধরে। চিরসবুজ শান্তিময় এ বঙ্গভূমিকে তারা শ্মশানে পরিণত করতে চেয়েছে। গ্রামে গ্রামে কিছু লোভী প্রতারক ও শোষক শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছে তারা ছল-চাতুর্যের আশ্রয় নিয়ে রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হয়েছে। ভাগ্য বিড়ম্বিত দরিদ্ররা ক্রমশ অত্যাচারিত, নির্যাতিত এবং শোষিত হতে হতে একেবারে নিঃস্ব হয়েছে। সৃষ্টিকর্তা ছাড়া তাদের পাশে আর কেউ নেই। এ শ্রেণীর মানুষের প্রতি কবির সহানুভূতি ব্যক্ত হয়েছে : গ্রামে গ্রামে লোভী দস্যুদল উন্মুক্ত কৃপাণ হাতে লুণ্ঠনে রত ল- ভ- সংসার জীর্ণ ন্যাকড়ায় ছিন্নভিন্ন বাতাসেতে সব স্বপ্নসাধ বিজয়ী অশ্বের খুর প্রত্যাগত হলে জীবিকার পুনর্জন্ম শ্রমে ঐক্য গড়ে দুঃখের সমবায় দশে মিলে মিলে ভাগ করে অনায়াসে আত্মীয়ের মতো দরিদ্রের ভগবানে ডাকে বেদনায় হাজার বছর ধরে এই খেলা চলে... [‘স্বৈরিণী স্বদেশ তুই’] অর্থবিত্ত ও প্রভাব বলয়ে শোষক ও প্রতারক শ্রেণী গ্রাম ছেড়ে নগর সভ্যতার স্পর্শে এসে বিলাসীতায় মত্ত হয়ে ওঠে। নাগরিক নানা সুবিধায় তারা জীবনকে উপভোগ্য করে তোলে। অন্যদিকে বস্তিবাসী নিরন্ন মানুষের দুর্ভোগ ও দুর্যোগ বাড়তে থাকে। অভাব অনটন ও জীবন সঙ্কটে তাদের জীবনে নাভিশ্বাস ওঠে। অন্যদিকে চলে শহুরে বাবুদের সীমাহীন বিলাসীতা। এ প্রসঙ্গে কবির উপলব্ধি: নগরে বন্দরে জোটে ক্ষিপ্ত ফেরুপাল বিচিত্র জীবনবীক্ষা স্বাদে ও গ্রহণে ঠক চাচাদের ভিড়, বাবুর বিলাস। [‘স্বৈরিণী স্বদেশ তুই’] ‘৪৭ সালে দেশ বিভাগের মাধ্যমে ব্রিটিশ বেনিয়ার বিদায় সংঘটিত হলেও দেশের মানুষের ন্যূনতম ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। পাকিস্তানী কর্তাব্যক্তিদের চ-নীতির শিকার হয় এদেশ ও দেশের মানুষ। দীর্ঘ তেইশ বছর তাদের দুঃশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে মানুষ। বাধ্য হয়ে আবার তারা পাকিস্তানী স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কবির দৃষ্টিতে সে বীভৎস ও ভয়ঙ্কর দিনের চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে কবিতার পঙ্ক্তিতে: তছনছ সারাদেশ দারুণ আগুনে দগ্ধীভূত ঘরবাড়ী, মৃত শিশু পশু জ্বলন্ত অনলে সিদ্ধ ধর্ষিতা নারী ... ... ... যুদ্ধ চলে ঘরে ঘরে নদী নালা জুড়ে যুদ্ধ চলে বাঙলার শ্যামল প্রান্তরে সদম্ভে মেশিনগান রকেট মর্টার গর্জে ওঠে নিয়মিত...। [‘স্বৈরিণী স্বদেশ তুই’] ত্রিশ লাখ প্রাণের বিনিময়ে এবং দুই লাখ মা বোনের সম্ভ্রম হানির বদৌলতে এদেশে আসে কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। কিন্তু বিধিবাম! এ স্বাধীনতা দেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন করতে ব্যর্থ হয়। যে নীতি আদর্শে দেশ স্বাধীন করা হলো পরে তার বৈপরীত্যই পরিলক্ষিত হয়। যারা খুনী, বেইমান রাজাকার দেশদ্রোহী তারাই ক্রমশ মুক্তিযোদ্ধা বনে যেতে থাকে। এ পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন কবির প্রতিবাদমুখর কবিতার পঙ্ক্তি: দগ্ধ দেশ পোড়ামাটি বিনষ্ট সম্পদ আসে মন্ত্রী এম.সি.এন সুবিধাবাদীরা রাজনীতি ব্যবসায়ী সুযোগ সন্ধানী আল শামস রাজাকার আলবদরেরা শিল্পপতি শ্রেণীচক্র শ্রেণীহীনগণ ময়দানে হুংকার দেন সফেদ পাঞ্জাবি। [ ‘স্বৈরিণী স্বদেশ তুই’] স্বাধীনতা পরবর্তীকালে এদেশে রাজনৈতিক সঙ্কট তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। রাজনৈতিক অস্থিরতায় গোটা দেশ বিশৃঙ্খল অবস্থায় নিপতিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকা-, স্বাধীনতা বিরোধীদের উল্লাস ও হঠকারিতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরমাবনতি গোটা দেশকে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত করে। এহেন পরিস্থিতিতে নি¤œবিত্তের জীবনে নানা সঙ্কট ও হতাশা বৃদ্ধি পেতে থাকে। শ্রমজীবী নিরন্ন মানুষের দুঃখ দুর্দশা লাঘবে কবি সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে শ্রেণীভেদাভেদ দূর করে একটি সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তাঁর আকাক্সক্ষা ছিল সাম্যবাদী সমাজ গড়ার মাধ্যমে পুঁজিবাদী বুর্জোয়া বিলাসীতা দূরীভূত হয়ে গরিব নি¤œবিত্ত মানুষের মুখে হাসি ফুটবে। পতাকা বদল সমাপ্ত হল শ্রেণী বদলের পালা এখনো প্রদোষ বিহার শয়নে তৃণদল এলোমেলো। [‘ সেøাগান’ ‘কোন লক্ষ্যে হে নিষাদ’] লক্ষ্য প্রাণের বিনিময়ে লব্ধ সদ্য স্বাধীন দেশে সোসালিজমের পূর্ণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শ্রেণীবৈষম্য দূর হবে, ধনী-নির্ধন জাতি ধর্মবর্ণ ভেদাভেদ ভুলে সবাই একত্রিত হয়ে দেশটাকে গড়বে এমনটি ছিল কবির ঐকান্তিক প্রত্যাশা। কিন্তু সে আশা গুড়ে বালি। অন্যায় অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে কোটিপতি বনে যাওয়া ভূঁইফোড় নেতারা সাধারণ মানুষের সঙ্গেহয়ে পড়ে। এ বিষয়ে কবির ক্ষোভোক্তি :
×