ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বে জঙ্গী তৎপরতা কমলেও বেড়েছে বাংলাদেশে

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২১ জুলাই ২০১৭

বিশ্বে জঙ্গী তৎপরতা কমলেও বেড়েছে বাংলাদেশে

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ বিশ্বজুড়ে জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা কমলেও বাংলাদেশে তা বেড়েছে। তবে জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে বাংলাদেশ সরকার তৎপর রয়েছে। বিশেষ করে জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে বাংলাদেশ জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ, সন্দেহভাজন জঙ্গীদের গ্রেফতার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সহযোগিতা করছে। গত বছর বিশ্ব জুড়ে মোট সন্ত্রাসবাদী হামলা আগের বছরের তুলনায় ৯ শতাংশ কমেছে। আর এসব হামলায় নিহতের সংখ্যাও কমেছে ১৩ শতাংশ। বুধবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর থেকে ‘দেশভিত্তিক সন্ত্রাসবাদ প্রতিবেদন-২০১৬’ শীর্ষক প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ওয়াশিংটন থেকে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের এই বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালে বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদী কর্মকা- আগের বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। তবে গুলশান-শোলাকিয়া হামলার পর জঙ্গীবাদ নির্মূলে সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথাও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। ২০১৫ সালের শুরু থেকে ২০১৬ সালের মধ্যভাগ পর্যন্ত একের পর এক কুপিয়ে ও গুলি করে মুক্তমনা লেখক, অনলাইন এ্যাকটিভিস্ট, বিদেশী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীসহ বিভিন্নজনকে ‘টার্গেট কিলিংয়ের’ বেশিরভাগ ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গীগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট-আইএস এবং আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা একিউআইএসের নামে দায় স্বীকারের খবর আসে। গত বছর পহেলা জুলাইয়ে গুলশানের কূটনীতিক পাড়ার হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলায় ১৭ বিদেশী ও দুই পুলিশ সদস্যসহ ২২ জনকে হত্যার আলোচিত ঘটনায়ও আইএসের নামে দায় স্বীকারের খবর আসে। তবে এসব হামলার পেছনে বাংলাদেশ সরকার ‘ হোম গ্রোন’ জঙ্গী ও বিরোধী কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে দায়ী করছে বলে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়। বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসবাদী হামলা ২০১৬ সালে কমে আসার নেপথ্যে ব্যাখ্যায় প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়, এ সময়ে আফগানিস্তান, সিরিয়া, নাইজিরিয়া, পাকিস্তান এবং ইয়েমেনে তুলনামূলক কম হামলা ও প্রাণহানির ঘটনায় বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদী হামলার পরিমাণ কমে আসে। তবে একই সময়ে ইরাক, সোমালিয়া ও তুরস্কসহ বেশ কয়েকটি দেশে সন্ত্রাসী হামলা ও নিহতের ঘটনা বেড়েছে বলে এতে উল্লেখ করা হয়। অন্যদিকে গত বছরে বাংলাদেশ দেখেছে স্মরণকালের ভয়াবহতম গুলশানের জঙ্গী হামলা। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালে হলি আর্টিজান বেকারির ওই হামলাসহ আইএস বাংলাদেশে মোট ১৮টি হামলার দায় স্বীকার করেছে। অন্য হামলাগুলো সাধারণত সংখ্যালঘু গোষ্ঠী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর বিচ্ছিন্নভাবে করা চাপাতি হামলা। একই বছরের ৬ এপ্রিল পুরান ঢাকায় সিলেট গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিমুদ্দিন সামাদ এবং ২৫ এপ্রিল রাজধানীর কলাবাগানে ইউএসএআইডি এর কর্মসূচী কর্মকর্তা সমকামী অধিকার কর্মী জুলহাজ মান্নান এবং তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বী তনয়কে কুপিয়ে হত্যার দায় স্বীকার করে একিউআইএস। এ ছাড়া শোলাকিয়ায় ঈদ জামাতের কাছে বড় আকারের হামলার সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু হামলার ঘটনায় কোন গোষ্ঠীর কাছ থেকে দায় স্বীকারের বার্তার খবর পাওয়া যায়নি। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালে বিশ্বজুড়ে বেশির ভাগ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় অন্য যে কোন জঙ্গীগোষ্ঠীর চেয়ে এগিয়ে রয়েছে আইএস। এতে বলা হয়, গত বছর বিশ্বের ১০৪টি দেশে সন্ত্রাসী হামলা হলেও জঙ্গী গোষ্ঠী আইএস গত কয়েক বছরে যেসব স্থানে হামলা চালিয়েছিল- সেইসব ভৌগোলিক এলাকার প্রতিই বেশি মনোযোগী ছিল। বিশ্বজুড়ে মোট হামলার ৫৫ শতাংশ হয়েছে ইরাক, আফগানিস্তান, ভারত, পাকিস্তান এবং ফিলিপিন্সে। আর সন্ত্রাসী হামলায় নিহতদের ৭৫ শতাংশ মারা গেছে ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, নাইজিরিয়া এবং পাকিস্তানে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার সন্ত্রাসবাদের প্রতি ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করেছে, সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের অনেককে গ্রেফতার করেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় সহযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছে। জঙ্গীগোষ্ঠীগুলো বাংলাদেশে তাদের উগ্রবাদী আদর্শ প্রচার ও বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে থাকা অনুসারীদের সঙ্গে যোগাযোগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে। আইএস ও একিউআইএসের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন প্রকাশনা, ভিডিও ও ওয়েবসাইটের দিকে নজর রেখেছে বাংলাদেশ। এছাড়া বাংলাদেশ মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের সন্ত্রাসবিরোধী সহায়তা কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ নিয়েছে বলা হয় প্রতিবেদনে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতে, বিদেশী জঙ্গীদের ধরতে প্রয়োজনীয় আইন না থাকলেও বাংলাদেশ সন্ত্রাসী সন্দেহে কয়েকজন বিদেশী সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথভাবে বাংলাদেশ স্থল, জল ও আকাশ সীমারেখা শক্তিশালী করেছে। সামনে এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের সীমান্তে অবকাঠামো নির্মাণে সহায়তা করছে। এতে আরও বলা হয়, বিদেশী জঙ্গীদের জন্য সুনির্দিষ্ট আইনের অভাব থাকলেও বাংলাদেশে বিদ্যমান আইনের আওতায় অন্যান্য অভিযোগে সন্দেহভাজন বিদেশী জঙ্গী বা তাদের সহায়তাকারীদের গ্রেফতার করেছে। বিভিন্ন জঙ্গী আস্তানায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের বিষয়টি তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, কিছু অভিযান আইনশৃঙ্খলা বাহিনী- সুনির্দিষ্টভাবে র‌্যাবের সাজানো বলে পর্যবেক্ষকদের বিশ্বাস। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশিত প্রতিবেদনে জঙ্গীবাদে অর্থায়ন বন্ধে সন্দেহজনক লেনদেন আটকানোসহ ব্যাংকিং ও অন্যান্য খাতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বাস্তবায়নের তাগিদ দেয়া হয়েছে । প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে বাংলাদেশের ধর্ম মন্ত্রণালয় ও জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে জাতীয় কমিটি ইমাম ও ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে জনসচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে পুলিশ জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে সম্পৃক্ত হয়েছে। বিশেষ করে আল কোরান কোনভাবেই জঙ্গীবাদকে সমর্থন করে না, ধর্মীয় নেতারা এই বিষয়টি সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরছেন। এছাড়া বাংলাদেশে যেসব শিক্ষার্থী নিখোঁজ হয়েছেন, তারা জঙ্গীবাদে সম্পৃক্ত হয়েছে কি-না সে বিষয়েও পুলিশ কাজ করছে। উল্লেখ্য, ২০০৪ সাল থেকে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর প্রতি বছর দেশভিত্তিক সন্ত্রাসবাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। এর আগে ২০০০ সাল থেকে দেশটি বৈশ্বিক জঙ্গীবাদের ধরন নামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছিল।
×