ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মোঃ আনোয়ার হোসেন

তাহের থাকবেন দীপ্যমান হয়ে

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ২১ জুলাই ২০১৭

তাহের থাকবেন দীপ্যমান হয়ে

২১ জুলাই, ‘তাহের দিবস’। সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের নির্দেশে ও সরাসরি তত্ত্বাবধানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে এক নম্বর মার্শাল-ল’ ট্রাইব্যুনালে এক প্রহসনমূলক গোপন বিচারের পূর্বনির্ধারিত রায়ে ১৯৭৬ সালের এইদিনে কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তমকে হত্যা করা হয়। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বীর সেনানী, ১১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক সম্মুখযুদ্ধে পা হারানো কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তম স্বাধীনতা উত্তরকালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতা দখলকারী মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির হাত থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও জনগণকে উদ্ধারের জন্য ১৯৭৫ সালের ৭ নবেম্বর ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের’ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও সহযোগিতায় ‘সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থানে’ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। জেনারেল জিয়াউর রহমানের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে সেই মহান অভ্যুত্থান সফল হতে পারেনি। ফলে ২১ জুলাই, ১৯৭৬ ফাঁসির মঞ্চে সিপাহী-জনতার মহান নেতাকে হত্যা করা হয়। তাহের হত্যাকাণ্ডের ৩৪ বছর পর ২০১০ সালে মহামান্য সুপ্রীমকোর্ট এক ঐতিহাসিক রায়ে বাংলাদেশের কুখ্যাত কালো আইন ‘পঞ্চম সংশোধনীকে’ অবৈধ ঘোষণা করে। ফলে হাইকোর্টে তাহের হত্যার বিচার প্রার্থনার দ্বার খুলে যায়। পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত তখনকার মার্শাল ল’ অথোরিটি কর্তৃক জারিকৃত সকল ফরমান, আদেশ, নির্দেশ, বিধি ইত্যাদিকে বৈধতা প্রদান করেছিলেন। কোন কোর্ট, ট্রাইব্যুনাল বা অথোরিটির কাছে সেগুলোর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করার পথও রুদ্ধ করে রাখা হয়। ২০১০ সালের ২৩ আগস্ট তাহের মামলার সহ-অভিযুক্ত কর্নেল তাহেরের অনুজ অধ্যাপক মোঃ আনোয়ার হোসেন, তাহেরের সহধর্মিণী বেগম লুতফা তাহের ও তাহেরের অগ্রজ ও মামলার অন্যতম আসামি আবু ইউসুফ খান বীরবিক্রমের সহধর্মিণী ফাতেমা ইউসুফ মহামান্য হাইকোর্টের বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মোঃ জাকির হোসেনের বেঞ্চে বিচার প্রার্থনা করে একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন। সেদিনই তাহেরের তথাকথিত বিচারকে কেন অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না– এই মর্মে রুল ইস্যু হয়। মামলা শুরু হওয়ার পর সহ-অভিযুক্ত হাসানুল হক ইনু, মেজর জিয়াউদ্দিন, এ্যাডভোকেট রবিউল আলম ও আরও কয়েকজন পৃথক পৃথকভাবে রিট আবেদন করেন। দীর্ঘ শুনানি এবং বাংলাদেশের প্রথিতযশা এমিকাস কিউরিদের বিজ্ঞ আইনী মতামতের ভিত্তিতে তাহের হত্যাকাণ্ডের ৩৫ বছর পর ২২ জুলাই, ২০১১ তারিখে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বেঞ্চ প্রদত্ত রায়ে বলা হয়, জিয়াউর রহমানের পরিকল্পনায় বিচারের নামে কর্নেল তাহেরকে ঠা-া মাথায় হত্যা করা হয়। তাহেরকে শহীদ মর্যাদা দেয়ার পাশাপাশি কথিত সামরিক আইন ট্রাইব্যুনালের একমাত্র জীবিত বিচারক মোঃ আবদুল আলীর বিরুদ্ধে খুনের মামলা দায়ের করার নির্দেশ দেয়া হয় সরকারকে। হাসানুল হক ইনু, মেজর জিয়াউদ্দিন ও অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনসহ অন্যদের সাজা খারিজ করে তাদের দেশপ্রেমিক মর্যাদা দেয়ার কথা বলা হয় রায়ে। সাজাপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের পেনশনসহ ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে সরকারকে অনুরোধ জানায় আদালত। এই ঐতিহাসিক রায় ঘোষণার পর ছয় বছর পেরিয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৪ দলীয় সরকার ক্ষমতায় আছে। তাহের পরিবার, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল এবং কর্নেল তাহের সংসদের পক্ষ থেকে সরকার ও সেনাবাহিনী প্রধান বরাবরে বারবার আবেদন করা হয়েছে তাহের ও সহ-অভিযুক্তদের বিষয়ে হাইকোর্টের রায় বিবেচনা করে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে। কিন্তু গভীর পরিতাপের কথা হলো, হাইকোর্টের রায় ও নির্দেশনা বাস্তবায়নে এখনও পর্যন্ত কোন পদক্ষেপ নেয়নি সরকার। সরকারী নির্দেশনার অভাবে প্রতিরক্ষা বাহিনীও তাহের এবং অন্য সদস্যদের বিষয়ে হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়ন করতে পারছে না। আমাদের বিনীত জিজ্ঞাসা, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সরকারসমূহের আমলে আমরা ন্যায় বিচার পাইনি। কিন্তু দীর্ঘ আইনী লড়াইয়ে রায় পাওয়ার পরও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী সরকারের আমলে কেন কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তম ও তাঁর সহযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়ন হবে না। ইতোমধ্যেই রায় বাস্তবায়নের অপেক্ষায় থেকে কয়েকজন সেনা সদস্য অভাবে-রোগে-শোকে ভুগে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে গেছেন। এরা সবাই বীর মুক্তিযোদ্ধা, যারা জিয়াউর রহমানের বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিলেন তাহেরের নেতৃত্বে। ‘তাহের দিবসে’ আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সমীপে সনির্বন্ধ অনুরোধ করছি তাহের হত্যা বিচারের রায় বাস্তবায়ন করুন। সর্বোচ্চ আদালত রায়ে উল্লেখ করেছে তাহের কোন দেশদ্রোহী নন, একজন শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক। সে অনুযায়ী কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তমকে তাঁর মর্যাদা ফিরিয়ে দিন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম এ্যাডজ্যুটেন্ট জেনারেল ছিলেন তাহের। সেনাবাহিনী সদর দফতরে এ্যাডজ্যুটেন্ট জেনারেল অফিসের প্রবেশমুখে তাহেরের প্রতিকৃতি স্থাপনের নির্দেশ দিন। দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক তাহেরের নামে পরিচিত হোক। মেজর জিয়াউদ্দিন, হাবিলদার আব্দুল হাই আজ মৃত্যুশয্যায়। এঁরা মহান মুক্তিযোদ্ধা। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী এঁদের ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর অন্য সাজামুক্ত সদস্যদের প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ আর বিলম্ব না করে বুঝিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা নিতে বলুন। যাঁদের ত্যাগে-রক্তে বাংলাদেশ, তাঁদের মর্যাদা আপনি ছাড়া আর কে ফিরিয়ে দিতে পারেন? বাংলাদেশে মৃত ব্যক্তির সাজা হয় না বলে আদালত ঠাণ্ডা মাথার খুনী জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর বিচারের নির্দেশনা দিতে পারেনি। ট্রাইব্যুনালের একমাত্র জীবিত সদস্য প্রাক্তন ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ আবদুল আলীর বিরুদ্ধে খুনের মামলা দায়ের করতে বলেছে আদালত। সে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আইনমন্ত্রী মহোদয়কে নির্দেশনা দিন। তাহের তাঁর ঐতিহাসিক জবানবন্দীতে জিয়াউর রহমানকে ষড়যন্ত্রকারী মীরজাফর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে এই মীরজাফরের সংশ্লিষ্টতা নানাভাবে প্রমাণিত হয়েছে। শত শত মুক্তিযোদ্ধা সিপাহীকে জিয়ার নির্দেশে হত্যা করা হয়েছে। তাদের পরিবার-পরিজনের অনেকে লাশ পর্যন্ত পাননি। এখন সময় এসেছে জাতীয় সংসদে আমাদের বিচার ব্যবস্থায় মরণোত্তর বিচারের আইন যুক্ত করা যাতে ঠাণ্ডা মাথার খুনী জেনারেল জিয়ার মরণোত্তর বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা যায়। তাহেরকে একবার হত্যা করেছে খুনী জিয়া। খুনীদের দখল করা রাষ্ট্র তাহেরকে হত্যা করতে চেয়েছে তার ওপর লরেন্স লিফৎসুলজের লেখা ‘টহভরহরংযবফ জবাড়ষঁঃরড়হ’ বইটির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তাহেরকে একজন দেশদ্রোহী হিসেবে জনমন থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছে। ইদানীং একজন ভুঁইফোঁড় গবেষকের উদ্ভব হয়েছে। অবিরাম মনগড়া কল্পকাহিনীর চমকে নির্জলা মিথ্যা লিখে লিখে তাহেরকে হত্যা করতে চান তিনি। শুধু তাহের নন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকেও তিনি বিতর্কিত করতে চান এই বলে যে, ’৭১-এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর গণহত্যা শুরুর পর ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার কোন ভিত্তি নেই। এমন গাল-গল্প তিনি করতে থাকুন। তাহের তাঁর জবানবন্দী শেষ করেছিলেন এই বলে, “ও ধস হড়ঃ ধভৎধরফ. ও ষড়াব সু পড়ঁহঃৎু ধহফ সু ঢ়বড়ঢ়ষব. ও ধস ঢ়ধৎঃ ড়ভ ঃযব ংড়ঁষ ড়ভ ঃযরং হধঃরড়হ. ঘড় ড়হব ফধৎব ংবঢ়ধৎধঃব ঁং. ঞযবৎব রং হড় মৎবধঃবৎ ধংংবঃ রহ ষরভব ঃযধহ ঃযব ঢ়ড়ংংবংংরড়হ ড়ভ ধ ভবধৎষবংং সরহফ. অহফ ও যধাব ঃযধঃ. ও ড়ভভবৎ ধ পধষষ ঃড় সু হধঃরড়হ ঃড় ধপয়ঁরৎব ঃযব ংধসব ফবঃবৎসরহধঃরড়হ.” দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে তাহেরের উক্তি সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। তাহের থাকবেন দীপ্যমান হয়ে জনগণের আত্মায়। জিয়ার জায়গা হবে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে। সে আবর্জনায় হারিয়ে যাবে স্বঘোষিত গবেষকরা। লেখক : শিক্ষাবিদ ও কর্নেল তাহেরের অনুজ
×