ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কাওসার রহমান

এবার আইনস্টাইনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার পালা

প্রকাশিত: ০৪:০৮, ১৭ জুলাই ২০১৭

এবার আইনস্টাইনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার পালা

আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ ১৯১৫ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু তা প্রথম প্রমাণিত হয়েছিল তার চার বছর পর, ১৯১৯ সালে। পশ্চিম আফ্রিকায় একটি পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখতে গিয়ে বিশিষ্ট ব্রিটিশ বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটন যখন প্রথম প্রমাণ পেলেন আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের, তখন গোটা বিশ্বেই হৈচৈ পড়ে গিয়েছিল। আবারও হৈচৈ শুরু হয়েছে এই আপেক্ষিকতাবাদের অস্তিত্ব নিয়ে। যদিও সর্বশেষ পরীক্ষায় উতরে গেছেন আইনস্টাইন। শুধু তাই নয়, ২০১৫ সাল থেকে ২০১৭ সালÑ এই সময়ে আইনস্টাইনকে তিন তিনবারই পরীক্ষায় পাস করালো মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। তবে এটা যেমন ব্রহ্মা-ের ইতিহাস, ভবিষ্যত জানার জন্য আমাদের সামনে সম্পূর্ণ নতুন একটা জানালা খুলে দিল, তেমনই তুলে দিল কিছু প্রশ্নও। যা আগামী দিনে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদকে যে আরও কঠিন পরীক্ষায় বসতে হবে তার সম্ভাবনাকে আরও সুনিশ্চিত করে দিল। সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের জন্য সামনের দিনগুলো আরও কঠিন আইনস্টাইনের জন্য। কারণ, ব্ল্যাক হোলের একেবারে কাছে, ভীষণ জোরালো অভিকর্ষ বলের (স্ট্রং গ্র্যাভিটি) জন্য যেখানে ব্রহ্মা-ের স্পেস-টাইম ভয়ঙ্করভাবে বেঁকেচুরে যায়, সেখানেও তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ খাটে কিনা, সেই ভীষণ কঠিন পরীক্ষায় বসার সময় হয়ে গেছে আইনস্টাইনের। অবশ্য আইনস্টাইনের এই পরীক্ষায় পাসের ঘটনাটা ঘটেছে ৩০০ কোটি আলোকবর্ষ আগে। যা টের পাওয়া গেল এই সেদিন! মাস চারেক আগে! আলোর গতিতে ছুটলে প্রায় ৩০০ কোটি বছর আগে বিশাল বড় একটা ‘পুকুর’-এর মাঝখানে কেউ খুব বড় একটা ‘ঢিল’ ফেলেছিল। আর সেই ‘ঢেউ’টা ছড়াতে ছড়াতে পৃথিবীতে পৌঁছল এই সেদিন। এ বছর জানুয়ারির ৪ তারিখে। বাংলাদেশ সময় ৪টা ১২ মিনিটে। এই পুকুরটা হলো আমাদের ব্রহ্মা-। আর ঢিলটা দুটো ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে ভয়ঙ্কর একটা সংঘর্ষ। এই ব্রহ্মা-ে যে অত ভয়ঙ্কর একটা সংঘর্ষ হয়েছিল দু’দুটো রাক্ষুসে ব্ল্যাক হোলের মধ্যে তা জানতে লেগে গেল আমাদের ৩০০ কোটি বছর! তা কি আদৌ জানতে পারতাম কোনদিন, যদি না তার ‘ঢেউ’টা এসে ভিড়ত এই পৃথিবীর ‘ঘাটে’! পুকুরে যেটা ঢেউ, আদিগন্ত, অতলান্ত ব্রহ্মা-ে সেটাই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বা গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ। যা অনেক দূরের, বন্ড বন্ড কোটি বছরের পুরনো খবরাখবর বয়ে নিয়ে আসে। বার্তা বয়ে বেড়ায় ব্রহ্মা-ের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। পৃথিবীর ‘ঘাটে’ তা যেদিন ভিড়েছিল সেই ২০১৭ সালের ৪ জানুয়ারি, তা দিয়েই তার নামকরণ করা হয়েছে। ‘গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ’ শব্দ দুটির আদ্যাক্ষর ‘এ’ আর ‘ড’-র সঙ্গে ৪ জানুয়ারি তারিখটাকে জুড়ে দিয়ে নাম দেয়া হয়েছে- ‘এড ১৭০১০৪’। এই আবিষ্কারের গবেষণাপত্রটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান জার্নাল ‘ফিজিক্যাল রিভিউ লেটার্সে’। ব্রহ্মা-ে যে এমন ‘ঢেউ’ আছে, ঠিক এক শতাব্দী আগে, তার খবরটা আমাদের দিয়েছিলেন এ্যালবার্ট আইনস্টাইন। তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদে। ‘ঢেউ’ তার অনেক পরে এসে আছড়ে পড়ছে পৃথিবীর ‘ঘাটে’! তাই পূর্বাভাস মিলিয়ে দিয়ে সন্দেহ, সংশয়ের পরীক্ষায় আরও একবার পাস করে গেলেন আইনস্টাইন। ২০১৫ সাল থেকে এই নিয়ে তিনবার। আমেরিকার দুটি জায়গা- ওয়াশিংটনের হ্যানফোর্ড আর লুইজিয়ানার লিভিংস্টোনে বসানো ‘লাইগো’ ডিটেক্টরের চোখে ৩০০ কোটি আলোকবর্ষ (লাইট ইয়ার্স) পর ধরা দিয়ে ওই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ জানিয়ে দিল, হ্যাঁ, অতদিন আগে একটা ভয়ঙ্কর সংঘর্ষ হয়েছিল এই ব্রহ্মা-ে। আর তা হয়েছিল দুটো রাক্ষুসে ব্ল্যাক হোলের মধ্যে। তারপর তারা বিলীন হয়ে গিয়ে আরও বড় একটা ব্ল্যাক হোলের জন্ম দিয়েছিল। এর আগে প্রথম দুবার রাক্ষুসে ব্ল্যাক হোল জোড়াদের মধ্যে সংঘর্ষের জেরে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের টের পেয়েছিলাম আমরা ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর আর ডিসেম্বরে। তবে আগের দু’বার তরঙ্গটা পেয়েছিলাম ব্রহ্মা-ের যে দূরত্বে ব্ল্যাক হোল জোড়াদের সংঘর্ষের জেরে, এবারের তরঙ্গটা এসেছে তার দ্বিগুণ দূরত্ব থেকে। যার মানে, বিগ ব্যাংয়ের সময়ের আরও অনেকটা কাছাকাছি ওই সংঘর্ষের ঘটনাটা ঘটেছিল ব্রহ্মা-ে। ব্রহ্মা-ে ছড়াতে ছড়াতে এবার যেটা আমাদের নাগালে পৌঁছেছে সেই মহাকর্ষীয় তরঙ্গটা পৃথিবীর ‘ঘাটে’ পৌঁছানোর পর বিজ্ঞানীদের চোখে পড়ে আরও একটি অদ্ভুত ঘটনা। ভয়ঙ্কর শক্তিশালী একটি আলোর ঝলসানি। যা থেকে সন্দেহ ইতিউঁতি উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করেছিল, ওই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আর সেই শক্তিশালী আলোর ঝলসানিটা বোধহয় কোন একই ঘটনার ফলাফল! হয়ত একটার সঙ্গে কোন না কোনভাবে যোগসাজশ রয়েছে অন্যটির। কিন্তু সেটা যে ভুল তা জানিয়ে গোটা বিশ্বের সংশয় কাটিয়ে দিল মহাকাশে ভারতের পাঠানো উপগ্রহ ‘এ্যাস্ট্রোস্যাট’। জানিয়ে দিল, ওই আলোর ঝলসানিটা আদতে গামা রে’ বার্স্ট (জিআরবি)। যার সঙ্গে পৃথিবীর ‘ঘাটে’ এসে পৌঁছনো মহাকর্ষীয় তরঙ্গের কোন সম্পর্ক নেই। ওই আলোর ঝলসানিটা আসছে একেবারেই অন্য কোন জায়গা থেকে। অন্য কোন মহাজাগতিক ঘটনার জেরে। তবে কোন ঘটনার কারণে কোন জায়গা থেকে আলোর এই ঝলসানি আসছে তা এখনও জানাজানির বাইরে রয়েছে। তবে ২০১৫ সাল থেকে ২০১৭, এই সময়ে আইনস্টাইনকে তিন তিনবার পরীক্ষায় পাস করালো যে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ, তা একই সঙ্গে যেমন ব্রহ্মা-ের ইতিহাস, ভবিষ্যত জানার জন্য আমাদের সামনে সম্পূর্ণ নতুন একটা জানালা (উইন্ডো) খুলে দিল, তেমনি তুলে দিল কিছু প্রশ্নও। এই প্রশ্ন হলো, আগামী দিনে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদকে আরও কঠিন পরীক্ষায় বসতে হবে। এতদিন আলোকতরঙ্গকে (দৃশ্যমান, অতি বেগুনি ও ইনফ্রারেড, এদেরই মধ্যে পড়ে এক্স-রে ও গামা রে) ‘হাতিয়ার’ করেই ব্রহ্মা-ের অজানা, অচেনা বস্তু খুঁজে বেড়াত বিজ্ঞানীরা। কোন উৎস থেকে সেই আলো বেরিয়ে আসছে, তারই পথ ধরে খুঁজে নিত তা ব্রহ্মা-ের ঠিক কতটা দূরত্বে ঘটছে, বিগ ব্যাংয়ের ঠিক কতদিন পর সেই সব ঘটনা ঘটেছে ব্রহ্মা-ে। কিন্তু ব্ল্যাক হোল বা নিউট্রন নক্ষত্রের মতো মহাজাগতিক বস্তুগুলো কবে, কখন তৈরি হয়েছে, কত কোটি বছর আগে তাদের শরীর কীভাবে গড়ে উঠেছে, তার কিছুই বিজ্ঞানীরা সঠিকভাবে বলতে পারত না। কারণ, অসম্ভব জোরালো অভিকর্ষ বলের জন্য ব্ল্যাক হোল থেকে তেমনভাবে কোন আলোই বেরিয়ে আসে না। যেটুকু আলো বেরিয়ে আসে, তা আসে ব্ল্যাক হোলের এ্যাক্রিশন ডিস্ক থেকে। আমরা যেমন থালার কানায়, কোণায় এঁটোকাঁটা ফেলে রাখি সবকিছু গিলে খাওয়ার পর, তেমনই কিছু ‘এঁটোকাঁটা’ ওই এ্যাক্রিশন ডিস্কে ফেলে, ছড়িয়ে রাখে ব্ল্যাক হোল। তাদের থেকে বেরিয়ে আসে আলোকতরঙ্গ। তারই সূত্র ধরে মেলে ব্ল্যাক হোলের হদিশ। এবার বিজ্ঞানীদের হাতে এল ব্রহ্মা-ে নতুন নতুন বস্তু খুঁজে বের করার নতুন ‘হাতিয়ার’। যার নাম- মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। যা দুটো ব্ল্যাক হোল বা একটি ব্ল্যাক হোলের সঙ্গে একটি নিউট্রন নক্ষত্র বা দুটো নিউট্রন নক্ষত্রের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে তৈরি হয়। সেই সংঘর্ষের ‘ঢেউ’ (মহাকর্ষীয় তরঙ্গ) পৃথিবীতে এসে পৌঁছালেই বিজ্ঞানীরা জানতে পারবে, ঠিক কোথায় সেটা ঘটেছে বা ঠিক কত কোটি বছর আগে সেটা ঘটেছে। তিন তিনবার যে মহাকর্ষীয় তরঙ্গগুলোর হদিশ পেয়েছে বিজ্ঞানীরা, সেগুলো এভাবেই ব্ল্যাক হোলগুলো কোথায় রয়েছে, কতদিন আগে তারা আরেকটি ব্ল্যাক হোলের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটিয়েছে তার খবর বয়ে নিয়ে এসেছে আমাদের কাছে। হালের খবরটা এসে পৌঁছল ৩০০ কোটি আলোকবর্ষ দূরত্ব থেকে। ফলে, ব্রহ্মা--তল্লাশে এবার নতুন ‘হাতিয়ার’ হয়ে উঠেছে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। আবার মহাকর্ষীয় তরঙ্গের আবিষ্কার কিছু প্রশ্নও উস্কে দিয়েছে বিজ্ঞানীদের মনে। বিজ্ঞানীদের জোরালো আশা, ওই সংঘর্ষগুলো থেকে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের পাশাপাশি আলোর মতো তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গেরও (ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক কাউন্টারপার্ট) হদিস পাওয়া যাবে। যা এখনও পাওয়া যায়নি। তা হলে কি ওই সব ব্ল্যাক হোলের এ্যাক্রিশন ডিস্ক নেই? তাই কি সেখান থেকে আলোর মতো কোন তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ বেরিয়ে আসতে পারছে না? মনে হচ্ছে যে, ভাত খেয়ে যেখানে এঁটোকাঁটা ফেলে ব্ল্যাকহোলগুলো সেই এঁটোকাঁটাও শেষ মুহূর্তে তারা খেয়ে নিচ্ছে! তবে এবার আরও একটা জিনিস দেখে অবাক হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। দেখা যাচ্ছে, সংঘর্ষের ঠিক আগের মুহূর্তে খুব কাছে এসে যাওয়া দুটি ব্ল্যাক হোলের একটির স্পিন এ্যাঙ্গুলার মোমেন্টাম বা ঘূর্ণির কৌণিক ভরবেগের দিক আর দুটো ব্ল্যাক হোল কাছাকাছি এসে যাওয়ার পর যে সিস্টেমটা তৈরি হয়, তাদের কৌণিক ভরবেগের দিকগুলো একে অপরের সঙ্গে মিলছে না। এর কারণটা অবশ্য এখনও বুঝে ওঠা যায়নি। ওই সংঘর্ষগুলো থেকে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের ‘কাউন্টারপার্ট’ তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গটিকে খুঁজে বের করতেই এখন বেশি উৎসাহী বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানীদের আশা, এবার দুটো নিউট্রন নক্ষত্রের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে তৈরি হওয়া মহাকর্ষীয় তরঙ্গেরও হদিস পাবে তারা। আর হয়ত সেখানেই খুঁজে পাওয়া যাবে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের ‘কাউন্টারপার্ট’ তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গটিকেও। সেই তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গটাকে যে খুঁজে পাওয়াটা খুব জরুরী, তা স্বীকার করে নিয়েছেন কলকাতার ইন্ডিয়ান এ্যাসোসিয়েশন ফর কাল্টিভেশন অব সায়েন্সের অধ্যাপক সৌমিত্র সেনগুপ্তও। তিনি জানিয়েছেন, সামনের দিনগুলো আরও কঠিন আইনস্টাইনের জন্য। তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের জন্য। কারণ, ব্ল্যাক হোলের একেবারে কাছে, ভীষণ জোরালো অভিকর্ষ বলের (স্ট্রং গ্র্যাভিটি) জন্য যেখানে ব্রহ্মা-ের স্পেস-টাইম ভয়ঙ্করভাবে বেঁকেচুরে যায়, সেখানেও তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ খাটবে কিনা, এবার সেই ভীষণ কঠিন পরীক্ষায় বসার সময় হয়ে গেছে আইনস্টাইনের। তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের। বিজ্ঞানীরা এখন এগিয়ে চলেছে ‘গ্র্যাভিটি বিওন্ড আইনস্টাইনের দিকে!’ লেখক : সাংবাদিক
×