ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মোঃ আব্দুল হাই

অভিমত ॥ ষোড়শ সংশোধনী রায়ে সরকার হারেনি হেরেছে পার্লামেন্ট

প্রকাশিত: ০৪:০৫, ১৭ জুলাই ২০১৭

অভিমত ॥ ষোড়শ সংশোধনী রায়ে সরকার হারেনি হেরেছে পার্লামেন্ট

শিরোনামটি প্রখ্যাত কলামিস্ট স্বদেশ রায়ের লেখা হতে ধার করা। সুপ্রীম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখায় বিচারপতিদের অভিশংসন ক্ষমতা পার্লামেন্টের হাতে আর থাকল না। ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে জেনারেল জিয়াউর রহমান সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন করে বিচারকদের অসদাচরণ বা নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধের তদন্ত সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে ন্যস্ত করেন। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক যুগান্তকারী রায়ে ৫ম সংশোধনী বাতিল করলেও সামরিক ফরমান বলে করা সংবিধানের কিছু পরিবর্তন প্রমার্জন করে বহাল রাখার সুপারিশ করেন; তার মধ্যে ৯৬ অনুচ্ছেদের পরিবর্তন প্রণিধানযোগ্য। ৫ম সংশোধনী সংক্রান্ত চূড়ান্ত রায়ের আলোকে সংবিধান সংশোধন করতে গিয়ে জাতীয় সংসদ সুপ্রীমকোর্টের প্রমার্জন অনুযায়ী ৯৬ অনুচ্ছেদ পঞ্চদশ সংশোধনীতে হুবহু রেখে দেন। অর্থাৎ তখন থেকেই সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা সংবিধানে থেকে যায়। বছর যেতে না যেতেই জাতীয় সংসদ ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা পরিবর্তন করে অভিশংসন ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ন্যস্ত করা হয়। এই সংশোধনীকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েক আইনজীবী হাইকোর্টে রিট আবেদন করলে হাইকোর্ট ষোড়শ সংশোধনী আইনগত ক্ষমতাবহির্ভূত বলে রায় দেয় এবং তা বাতিল ঘোষণা করে। সরকার এ রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করলে সুপ্রীমকোর্ট হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে। এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে এবং প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্কের সূত্রপাত হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এ নিয়ে যথেষ্ট মতের আদান-প্রদান হয়। শুনানি চলাকালীন কিছু বক্তব্য মতামত এ্যামিকাস কিউরিদের সাবমিশন আদালতের মন্তব্য মিডিয়ায় চলে আসায় জনমনেও এ নিয়ে ঔৎসুক্য সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে একজন বাদে সকল এ্যামিকাস কিউরি সংশোধনী বাতিলের পক্ষে মতামত রাখায় এবং প্রধান বিচারপতি শুনানি চলাকালীন সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ রেখে বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে কি করে দেয়া সম্ভব- এরকম মন্তব্য করায় ৭২-এর সংবিধান নিয়েই সংশয়ের উদ্রেক ঘটানো হয়। এদিকে রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই বিএনপির পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করায় বিশেষ করে এ রায়ে বিচার বিভাগ দলীয় নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়েছে মন্তব্য করা, টেলিভিশনে ‘হলো না ৭২-এ ফিরে যাওয়া’ জাতীয় অনুষ্ঠান করে পক্ষে-বিপক্ষে বক্তব্য দেয়ার জন্য মুখচেনা ব্যক্তিদের নিয়ে আলোচনা দলীয়তন্ত্রের বেড়াজালে জড়িয়ে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী এ রায়ের পর আমাদের বিচার বিভাগ স্বাধীন এরকম মন্তব্য করে দলীয় লোকজনকে কোন মন্তব্য করা থেকে পরোক্ষভাবে বিরত রাখেন। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কলম ধরি; কথা বলি, কিন্তু কোন দলের পক্ষে গলাবাজি করি না তাদের বক্তব্য কোন মিডিয়ায় আসেনি। আমরা বিচারকদের দেখি জাতির বিবেক হিসেবে। তারা যখন এজলাসে বসে কোন মন্তব্য করেন, রায় দেন তা ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীস্বার্থের উর্ধে উঠেই রায় দেন এটা সমাজের বিশ্বাস। কিন্তু ষোড়শ সংশোধনী সংক্রান্ত রায় প্রকাশ পাওয়ার পর কিছুটা হলেও জনমনে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। জাতীয় সংসদ এবং বিচার বিভাগ কি মুখোমুখি অবস্থানে? বিচার বিভাগ কি অন্যান্য সার্ভিসের মতো নিজেদের নিয়েই চিন্তিত? শুনানি চলাকালীন যখন আদালত সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ রেখে কি করে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ন্যস্ত করা সম্ভব- এ প্রশ্ন তোলেন তখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে তা হলে কি ৭২-এর সংবিধান নিয়ে আদালতের শঙ্কা আছে? জাতীয় সংসদ সদস্যরা ৭০ নং অনুচ্ছেদের কারণে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে কোন মতামত রাখতে পারবেন না। তখন দলীয় সিদ্ধান্ত (সরকারী দলের) অনুযায়ী বিচারকের ভাগ্য নির্ধারিত হবে। এ অবস্থা স্থায়ী হতে পারে না। সংসদে বিরোধী দল থাকবে না; সব সময়ই একদল দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন নিয়ে সংসদে আসবে এ ধারণা সর্বজনীন হতে পারে না; এ ধারণার ওপর ভিত্তি করে কোন আইন তাও আবার সাংবিধানিক আইন কখনও করা যায় না। তাছাড়াও ৭২-এর সংবিধান যখন ৭০ অনুচ্ছেদ এডপ্ট করে তখন ৯৬ অনুচ্ছেদ, যেখান বিচারপতিদের অভিশংসন সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সম্মতির ভিত্তিতে হতে হবে বলে শর্ত সংযোজন করা হয় তখন এ বিষয়টি নিশ্চয়ই বিবেচিত হয় সাধারণ সংখ্যা গরিষ্ঠতায় যে কোন দল সরকারে থাকলেই তারা যেন বিচারকদের অপসারণ দলীয় সিদ্ধান্তে করতে না পারে। এখানেও রক্ষাকবচ। সুতরাং ৭০ অনুচ্ছেদকে বিচারপতিদের অভিশংসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে সমালোচনার সুযোগ নেই। শুনানি চলাকালীন দেখলাম ঝুলন্ত পার্লামেন্টের কথাও আসল। যদি কোন দলের সংসদে দুই-তৃতীয়াংশের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকে তখন বিচারপতি অপসারণ সংসদে আটকে যাবে অন্য দলের সহযোগিতা না পাওয়ার কারণে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে দীর্ঘ ব্রিটিশ শাসন, পাকিস্তানের ২৪ বছর ও স্বাধীনতার পর দীর্ঘ সামরিক শাসন আমাদের মনোজগতে পার্লামেন্ট সম্বন্ধে এক রকমের নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি করে ফেলেছে। পার্লামেন্টের মূল সৌন্দর্য বা এসেন্সই হলো বহুদলীয় পার্লামেন্ট। একক সংখ্যা গরিষ্ঠতায় সরকার গঠন করলেও সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে পার্লামেন্ট। আর কোয়ালিশন সরকার হলেও কোন দলের একক সিদ্ধান্ত নেয়ার কোন সুযোগই নেই। এরকম অবস্থায় কোন বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিশংসনের যোগ্য অপরাধ সংসদের বিবেচনার জন্য আসলে সংসদ সদস্যরা তাদের বিচার-বুদ্ধি মতে অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ীই মতামত রাখবেন এতে সন্দেহ থাকার কোন কারণ নেই। এমনকি বর্তমান অবস্থায় যেখানে এক দলের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন সংসদে আছে সেখানে প্রস্তাব ভোটে যাওয়ার আগে সংসদ সদস্যরা চুলচেরা বিচার করে বক্তব্য রাখবেন না এমনটি ভাবার কি কারণ থাকতে পারে? এমনও তো হতে পারে ভোটে যাওয়ার আগেই বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়ে যেতে পারে। সংসদ সম্বন্ধে এত নেতিবাচক ধারণা পোষণ করা বিচারবিভাগ কেন, কারও পক্ষে সমীচীন নয়। তাছাড়া অভিশংসনের মতো অবস্থা শুধু হাইকোর্ট, সুপ্রীমকোর্টের বিচারকদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, জেলা জজদের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নয়। জেলা জজ পর্যন্ত অন্যান্য সার্ভিসের মতো শৃঙ্খলা ও আপীল বিধি জাতীয় বিধিমালাই প্রযোজ্য। সেখানেও সুপ্রীমকোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমেই ব্যবস্থা নেয়া হয়। সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে পরিষ্কার করা হয়েছে বিষয়টি। এ অনুচ্ছেদটি হলো ‘বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনে রত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি দান ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলা বিধান রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত থাকিবে এবং সুপ্রীমকোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তা প্রযুক্ত হইবে।’ আপীল শুনানি চলাকালীন দেখলাম অনেকেই বিচার বিভাগ আর বিচার কর্মবিভাগ নিয়ে তালগোল পাকিয়ে মূল বিবেচ্য পার্লামেন্ট না সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলÑ এ থেকে অনেক দূরে সরে গেলেন। জেলা জজের অনেক শূন্য পদ পূরণ করা যাচ্ছে না আইন মন্ত্রণালয়ের অনীহার কারণেÑ এরকম বক্তব্যও দেয়া হলো। যে সব জজ সাহেব বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে প্রেষণে নিয়োজিত আছেন তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও প্রশ্ন তোলা হয়েছে সুপ্রীমকোর্টের অনুমোদন ছাড়া তারা যেন বিদেশে না যান। অবশ্য জজ সাহেবরা এর পরেও প্রশিক্ষণে গিয়েছেন। একজন বিচারপতি যার বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করছে সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রারের দস্তখতে চিঠি দেয়া হয়েছে তার বিরুদ্ধে তদন্ত বন্ধ করার। কারা নির্বাহী আদেশ স্বাক্ষর করবেন তার তালিকা দেয়া আছে। সেখানে রেজিস্ট্রারের নাম নেই। মানবেন কি-না এটা কমিশনের দায়িত্ব । এরকম প্রশাসনিক অনেক বিষয়ই ষোড়শ সংশোধনী মামলার শুনানিকালে মিডিয়ায় আসে। এ্যামিকাস কিউরিদের বক্তব্য, এ্যাটর্নি জেনারেলের সাবমিশন বিবেচনা করে সুপ্রীমকোর্ট হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে অর্থাৎ জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা বহাল থাকল। আমরা আশা করব বিচার বিভাগ এবং জাতীয় সংসদ কোন অবস্থাতেই মুখোমুখি অবস্থানে যাবে না। অনেকেই অনেক কথা বলতে পারেন; কিন্তু মনে রাখতে হবে জাতীয় সংসদ কেবল আইন প্রণয়ন করে না, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্বও জাতীয় সংসদের। ষোড়শ সংশোধনী অর্থাৎ সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আপনা-আপনি কার্যকর হয়ে যাবে না এটি আমাদের বুঝতে হবে। কিন্তু এ নিয়ে যারা পানি ঘোলা করতে চায় তাদের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সজাগ থাকতে হবে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কাছে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আকুল আবেদন থাকল এ সময়ে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ যেন একের বিরুদ্ধে অন্য কোনরকম অহেতুক রশি টানাটানিতে লিপ্ত হয়ে পঞ্চম বাহিনীকে সুযোগ করে না দিতে পারে। লেখক : যুগ্মসচিব (অব) ও মুক্তিযোদ্ধা
×