ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিদেশের জেলে বাংলাদেশী

প্রকাশিত: ০৪:০৪, ১৭ জুলাই ২০১৭

বিদেশের জেলে বাংলাদেশী

দৈনিক জনকণ্ঠের ১৫ জুলাই শনিবারের সংখ্যার তৃতীয় পাতার ‘জর্দানের কারাগারে শত শত নারীর দুঃসহ বন্দী জীবন’ শীর্ষক এক দীর্ঘ প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। এটি যেমন মর্মান্তিক ও মর্মন্তুদ, তেমনি মানবিক আবেদনে সমৃদ্ধ। তবে শত শত বন্দী নারী যে শুধু জর্দানের কারগারেই দুঃসহ জীবনযাপন করছেন, তা নয়। প্রকৃত বাস্তবতা হলো যেসব বাংলাদেশী অসহায় নারী গৃহকর্মী হিসেবে জর্দান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, বাহরাইনসহ সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত, তাদের অন্তত অধিকাংশই কারাগারে না থাকলেও ‘কারাসদৃশ’ মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছেন। একে তো বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা কম, অন্যদিকে কাজেরও কোন সীমা-পরিসীমা নেই। এমনকি কাউকে কাউকে বাধ্য থাকতে হয় মনিবের মনোরঞ্জনেও। যে কারণে গৃহকর্মীকে পরিণত হতে হয় যৌনদাসীতে। সৌদি গেজেটের তথ্যানুযায়ী সে দেশে ৫০ হাজার নারী নিযুক্ত গৃহকর্মে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, বর্তমানে প্রায় ৯৬ লাখ বাংলাদেশী অভিবাসী হিসেবে বিশ্বের ১৬০টি দেশে কর্মরত আছেন। তবে এই সংখ্যা আরও বেশি, এক কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে। এর বাইরেও বিদেশের বাজারে নিত্য নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি হওয়ায় প্রতি বছর চার-পাঁচ লাখ কর্মী যাচ্ছেন বিভিন্ন দেশে। বিদেশে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রেরিত অর্থে দেশের অর্থনীতিও সমৃদ্ধ হচ্ছে দিন দিন। তবে প্রবাসী অভিবাসী শ্রমিক-কর্মচারীদের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানসহ সামাজিক সুরক্ষার জন্য তেমন নীতিমালা ও আইন নেই। বিশেষ করে প্রতারক এজেন্সি ও দালালচক্রের খপ্পরে প্রলোভিত হয়ে যেসব পুরুষ-নারী ও শিশু জীবনের সমূহ ঝুঁকি নিয়ে পা বাড়ান বিদেশের অজানা-অচেনা গন্তব্যে, তাদের দুঃখ-কষ্ট-মানবেতর জীবন এক কথায় অবর্ণনীয়, অসহনীয়। এসব ক্ষেত্রে বিদেশ বিভুঁইয়ে জেলখানা ও বন্দীশিবিরে শিকলবাঁধাসহ অনাহারে-অর্ধাহারে মৃত্যুর খবরও আছে। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যে চাকরি নামক সোনার হরিণের সন্ধানে এ পর্যন্ত যে কতজন প্রাণ দিয়েছেন তার হিসাব নেই সংশ্লিষ্ট দফতর ও মন্ত্রণালয়ে। অতঃপর অভিবাসী শ্রমিকদের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানসহ যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়ার জন্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় নিরাপদ অভিবাসন আইনের খসড়া চূড়ান্ত করেছে। এতে বিদেশে যেতে ইচ্ছুক কর্মীদের সঙ্গে প্রতারণা করলে ৫ বছরের জেল-জরিমানাসহ মানবপাচারের ক্ষেত্রে মৃত্যুদ-ের বিধান রাখা হয়েছে। মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদনের পর আইনটি জাতীয় সংসদে পাস হলে প্রবাসীদের দুর্ভোগ কমার পাশাপাশি নিরাপত্তা অনেকটা নিশ্চিত হবে বলে আশা করা যায়। মানুষ নিতান্তই বাধ্য হয়ে পেটের দায়ে বিদেশে পাড়ি জমায়। অনেকে শেষ সহায়-সম্বল ভিটেমাটি পর্যন্ত বিক্রি করে। বিশেষ করে দালাল ও প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে যেসব পুরুষ, নারী ও শিশু শ্রমিক পাড়ি জমায় বিদেশে তাদের দুঃখ-কষ্ট-দুর্দশা অবর্ণনীয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব কর্মসংস্থান হয় অতি নিম্নমানের ও মজুরির। প্রতারক দালালচক্র এর চেয়ে অনেক বেশি অর্থ হাতিয়ে নেয় ভুক্তভোগীর কাছ থেকে। এক্ষেত্রে নারী ও শিশুর অবস্থান হয় আরও শোচনীয়। শিশুদের কাজে লাগানো হয় উটের জকি হিসেবে। আর গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োগ পাওয়া মহিলারা ব্যবহৃত হয়ে থাকেন ‘যৌনদাসী’ হিসেবে। সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ও ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট সাবের হোসেন চৌধুরীর মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এমনই আভাস মিলেছে। সে অবস্থায় বিদেশে নারী ও শিশু প্রেরণের ক্ষেত্রে আরও বেশি মাত্রায় সতর্ক হওয়া বাঞ্ছনীয়। অবর্ণনীয় ও অমানবিক দুঃখ-দুর্দশার কথা-বিবেচনায় ভারত, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপিনস, ইন্দোনেশিয়া মধ্যপ্রাচ্যে নারী শ্রমিক প্রেরণ নিষিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশ সরকারেরও বিষয়টি বিবেচনা করার সময় এসেছে। অন্তত গৃহকর্মী হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে কোন নারী শ্রমিক প্রেরণ না করাই বাঞ্ছনীয়।
×