ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনির মেলব্যাগ ॥ স্বদেশ হোক সবার বড় সত্য

প্রকাশিত: ০৫:০৫, ১৬ জুলাই ২০১৭

সিডনির মেলব্যাগ ॥ স্বদেশ হোক সবার বড় সত্য

যার যা ইচ্ছে তাই বলে এখন। ফরহাদ মজহার নিয়ে কোন কথা বলার প্রয়োজন দেখি না। তারপরও এক ধরনের মানুষ কথিত সুশীলরা মানতে নারাজ। ভিডিও দেখলে বলেন এটা বানানো। ফুটেজ দেখে বলেন সরকারের চাল। এই দেশ কি আসলে এজন্যে স্বাধীন হয়েছিল? এসব ফরহাদ মজহাররা কোনকালে দেশের কোন উপকারে না আসলেও এরাই সংবাদ শিরোনামে। এখন এই এক প্রবণতা। কিছুদিন প্রগতির মুখোশ তারপর সফট জামায়াত, তারপর সন্ত্রাসী বা উগ্রতা। এটাই এখন জনপ্রিয় হবার শটকার্ট পথ। অথচ এমন ছিল না এই দেশ। যখন এই দেশ স্বাধীন হয় তখন আমি এক দুরন্ত কিশোর। যৌবনে পা দিয়ে এদেশের স্বাধীনতা যেমন দেখেছি তেমনি দেখেছি এর মানমর্যাদা আর অস্তিত্ব নিয়ে ছেলেখেলা। আজ আমি জীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে। ষাট ছুঁই ছুঁই বয়সে দেশ ছেড়ে প্রবাসী জীবনে একদিনের জন্যও আমার দেশকে ভুলিনি। এই না ভোলার পেছনে যে জন্মাধিকার তার নাম স্বাধীনতা। মাঝে মাঝে ভাবি আমার জন্ম তো পূর্ব পাকিস্তানে। দেশ যদি স্বাধীন না হতো আমি কি আসলেই প্রবাসী হয়ে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির জন্য এমন গর্ববোধ করতাম? কিংবা এভাবে ফিরে যাবার তাগিদ অনুভব করতাম? উত্তর সম্ভবত, না। কেন না? দেশ বা মাটির টান থাকার পরও বহু মানুষ তাদের দেশে ফেরেন না। কারণ, রাজনীতি ও সরকার সেদেশগুলোকে এমন বিকৃত আর এমন বসবাসঅযোগ্য করে তোলে যে, একশ্রেণীর মানুষের জন্য সেটা আর কোনকালেই ফিরে যাবার দেশ থাকে না। আমার সৌভাগ্য আমাদের দেশে টুঙ্গিপাড়ার নিভৃত গ্রামে এমন এক সাহসী মানুষ জন্মেছিলেন যিনি আমাদের স্বাধীন একটি রাষ্ট্র দিয়ে গেছেন। পরম ভাগ্য একাত্তরে আমাদের মাথার ছাতা ছিলেন তাজউদ্দীনের মতো নির্ভীক আদর্শবাদী নেতা। সেই দেশটিতে এখনও এত দুশমন আর এত ষড়যন্ত্রকারী ভাবতেই অবাক লাগে। আজ আমি যখন স্বাধীনতার কথা লিখছিÑ দেশ ও মানুষের ইমেজ আগের জায়গায় নেই। একদা আমরা বাংলাদেশ বললে বিদেশে কেউ চিনত না। যদি চিনতও পরিচয় হতো নেক্সট টু ইন্ডিয়া। এখন আর সে বাস্তবতা নেই। আমাদের পোশাক, আমাদের ক্রিকেট, আমাদের মেধা, আমাদের উন্নয়ন বাংলাদেশকে একটি উন্নয়নশীল দেশে পরিচিত করে তুলেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের যারা এই কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন যারা দেশকে ইতিহাস ও অতীতের পাপ থেকে মুক্ত করলেন, যারা পারুক না পারুক মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফেরানোর কথা বলছেন ক্রমেই তারা কোণঠাসা ও দুর্বল হয়ে পড়ছেন। যে কারণে কোন কিছুতে না থেকেও এদেশের ইতিহাস ও স্বাধীনতার চরম অপমানকারী বিএনপি জানে তারা ভোট হলে আবারও বেরিয়ে আসতে পারে। আমি কোন রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে লিখতে চাই না। তারা এদেশের লাখো লাখো মানুষের সমর্থনপুষ্ট দল। আওয়ামী লীগের অনেক কাজ আর মন্ত্রী মিনিস্টারদের অনাচারের সময় তাদের কথা মনে আসে বৈকি। নব্য রাজাকারে পুষ্ট সরকারী দলের সঙ্গে তাদের ব্যবধান এখন খুব বেশি কিছু না। তারপরও আমরা কি চাইব আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের গৌরব হোক কলঙ্কিত? এই কলঙ্ক বিএনপি চাইলেও শোধরাতে পারবে না। কারণ, তারা জানে এ দেশটি কোন মেজরের বাঁশির ফুঁ বা এক ঘোষণায় জন্ম নেয়নি। স্বাধীনতার লড়াইয়ে আমাদের দুশমন ছিল পাকিস্তান আমেরিকা আর চীনের মতো শক্তি। তাদের মোকাবেলা করার জন্য ভারত আর সোভিয়েত ইউনিয়ন না থাকলে আমরা আজকের সিরিয়া বা আফগানিস্তান হয়ে থেকে গেলেও অবাক হবার কিছু ছিল না। অথচ তারুণ্য তা জানে না। জানলেও মানে না। এখন যারা লেখালেখি করেন, কথা বলেন যারা সুশীল হতে চান তাদের কথাবার্তা শুনলে মনে হয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় ছিল যেন হাতের মোয়া। সে সময়কার লোকজন যত কমে আসছে এরা ততই নতুন নতুন বিভ্রান্তি আর ষড়যন্ত্রের জালে আটকা পড়ছে। আজ স্বাধীনতার মধ্য বয়সে আমরা সমাজে পোশাকে জীবনাচরণে আর কথায় মধ্যপ্রাচ্যের যে প্রভাব দেখছি তা কোনভাবেই ভবিষ্যত বাঙালিত্বকে আগলে রাখতে পারবে না। যে সব নারী অকুতোভয় আর সাহসী তারা আজ ঘরবন্দী। দু-একটা মিডিয়ায় বড় বড় কথা বললেই স্বাধীনতার স্বপ্ন সফল হয় না। যে সাধারণ মানুষ এ দেশের মুক্তি জন্য চেতনার জন্য লড়াই করেছিলেন আজ তারা অন্ধ বিশ্বাস আর ভয়ঙ্কর স্বর্গ-নরকের যন্ত্রণায় দিশেহারা। যার প্রমাণ জঙ্গীবাদ। বিশ্বের আর কোন দেশে নিজেদের নেতারা জঙ্গীবাদকে সরকারের লেলানো বা রাষ্ট্রের পয়দা বলার সাহস পায় না। অথচ আমাদের বিরোধী নেতারা আকছার তা বলে থাকেন। এটা যদি বাকস্বাধীনতা হয়ত যারা জঙ্গীবাদ ও মুক্তচিন্তার সঙ্গে এবং উচ্চকিত তারা কেন তোপের মুখে? তাদের গর্দান কেন চাপাতির তলায়? এই বৈষম্য বলে দেয় ভৌগোলিক স্বাধীনতা ও পতাকা থাকলেও আমাদের সামাজিক মুক্তি আসেনি। আপনারা সবাই জানেন এখন অটো চালক থেকে বাসের হেলপারÑ সবাই নারীদের পোশাক বিষয়ে হেদায়েত করতে ভালবাসেন। এমনও ঘটে একা মহিলা যাত্রীকে এই বলে সাবধান করা হয় তাদের পছন্দমতো পোশাক না হলে ভবিষ্যত নাকি অন্ধকার। কথা ও চিন্তা তো আগেই মুখ ও কলম সামলে ফেলেছে। মানুষের ঘাড়ে একাধিক মাথা নেই যে সে বারংবার জান দিতে যাবে। দেশ স্বাধীনের সময় আমরা পরাধীনতার আড়ালে ছিলাম মানসিকভাবে মুক্ত ও সংগ্রামী একটি জাতি। আজ নিজেদের মাটিতে নিজেদের শাসনে নিজেদের আমলে আমরা বিকারগ্রস্ত এক পঙ্গু জাতিতে পরিণত হতে চলেছি। এটা বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। যারা বাংলাদেশের নাম ঠিকানা আর পাসপোর্ট নিয়ে গর্বিত তাদের অন্তরে আরেক ছবি। আমি দেখি আর বিস্ময় মানি। এই কি সেই দেশের মানুষ যার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা? যার অন্তরে থাকার কথা সুফিবাদ? আজ তার একি চেহারা? খাদ্যে পোশাকে আচারে কথায় এদের মতো সঙ্কীর্ণ আর সাম্প্রদায়িক বাঙালী আগে দেখিনি। সবাই না হলেও বেশিরভাগ মানুষের মনে আজ এই দ্বন্দ্ব। এর প্রতিকার আছে কিনা জানি না তবে এটুকু বুঝি অন্ধকারের ঘোড়া সওয়াররা এই বাংলাদেশের সবকিছু চায় চেটেপুটে খায় বিদেশে এসে তাদের সচ্ছলতা ভোগ চরিতার্থ করার পর দেশের সর্বনাশ আর নিজের অন্ধকার অন্যের ওপর চাপাতে সচেষ্ট। সহজে পরিত্রাণ মিলবে বলেও মনে হয় না। দেশের রাজনীতির যে ধারাটি বাংলাদেশকে তার নাম পতাকা গান ইত্যাদি রেখে বা পরে বদলানোর সুযোগ দিয়ে পাকি কায়দায় চালাতে চায় তারাই এর পৃষ্ঠপোষক। এরা জানে পাকিস্তান আজ দেশে-বিদেশে পরাজিত এক দেশের নাম। তার আবেগ ইমেজ কিংবা ভাবধারা কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। তবুও অন্ধ ভারতবিদ্বেষ অন্ধ সাম্প্রদায়িকতা আর গোঁড়ামি আমাদের স্বাধীনতাকে তার দ্যুতি নিয়ে বের হয়ে আসতে দিচ্ছে না। আমি এবার আমাদের তারুণ্যকে বলব, তোমাদের দায় মেটাও। হাতে মোবাইল হাতে ইন্টারনেট কানে বিদেশী গান চোখে সানগ্লাস আর মনে পাকি এই আবহ থেকে মুক্ত হতে হবে। একজন বাঙালীর যে ইতিহাস যে অতীত যে স্বপ্ন তার কাছে না যাওয়া পর্যন্ত তোমরা আধুনিক ও বিশ্বমানব হতে পারবে না। অগ্রজদের তোমরা যত মন্দ বল তারাই দেশ দিয়েছে। বায়ান্ন দিয়েছে। তোমরা কি পারবে তার মর্যাদা ও সুনাম তুলে ধরতে? আজ তোমাদের মেধা ও গৌরব বিশ্বে স্বীকৃত। এখন প্রয়োজন আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি আর মননের পরিচর্যা। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর উত্তরসূরিরা বড় ভালবেসে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে আমাদের যা দিয়ে গেছেন তার নাম বাংলাদেশ। আসো, আমরা সবাই মিলে পদ্মা মেঘনা রাইন প্রশান্তপাড় বা নীল নদের কাছে থেকেও একে ভালবাসি। এর আনন্দে আনন্দিত হই, এর বেদনায় চোখের জলে ভাসি। সবার উপরে বাংলাদেশ সত্য তাহার উপরে নাই। এই হোক আমাদের জীবনব্রত। [email protected]
×