ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সায়েম খান

অভিমত ॥ ভিশন-২০৩০ এবং আগামীর রাজনীতি

প্রকাশিত: ০৫:০৩, ১৬ জুলাই ২০১৭

অভিমত ॥ ভিশন-২০৩০ এবং আগামীর রাজনীতি

বর্তমানে বাংলাদেশে রাজনীতির সংস্কৃতির একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাংলাদেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের সামনে নির্দিষ্ট লক্ষ্য উপস্থাপন করে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। রাজনীতির মাঠে অনেক কথাই হয়ে থাকে। কিন্তু কয়টা কথা জনগণ মনে রাখতে পারে? রাজনীতিতে মাঠে-ময়দানে, সমাবেশ, বক্তৃতায় রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিশ্রুতি শোনা যায়। অনেক সময় সেগুলো শুধুই মুখের কথা হিসেবে থেকে যায়, আবার অনেক নেতা ব্যক্তিগত পর্যায় থেকেও কথা বলে থাকেন। কিন্তু যখন কোন দল তার নির্দিষ্ট লক্ষ্য বা আলোচ্যসূচী সামনে রেখে এগিয়ে যায় তখন তার দলভিত্তিক রাজনীতিতে দায়বদ্ধতা বেড়ে যায়। জনগণ হাতে প্রমাণ নিয়ে পুরো দলকে রাজনীতির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দল হিসেবে জনগণের প্রতি আক্ষরিক অর্থে প্রতিশ্রুতিশীল হয়ে প্রথম রাজনীতি শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ তাদের ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচনী ইশতেহারে রূপকল্প-২০২১ ঘোষণা করে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনী ইশতেহারে রূপকল্প-২০৪১ ঘোষণা করে। কিছু দিন আগে বাংলাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি একটি রূপকল্প ঘোষণা করেছে, ভিশন-২০৩০। ৩৭টি বিষয়ে ২৫৬টি দফায় ইংরেজী-বাংলা দুই ভাষায় মোট ৪১ পৃষ্ঠায় তা বর্ণিত। এটা ঘোষণার পরপরই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে ঝড় তোলেন যে এটা বিএনপি আওয়ামী লীগের দেখাদেখি করেছে। তা যা-ই হোক না কেন, বিএনপির ভিশন-২০৩০ ঘোষণাকে আমি সাধুবাদ জানাই এই কারণে যে, বিএনপি এতদিন বাদে হলেও জনগণমুখী হয়ে রাজনীতিটা নতুনভাবে শুরু করেছে। রাজনীতি হলো একটা প্রতিযোগিতা। কখনও কখনও তা নিজের সঙ্গে নিজের, যার মাধ্যমে পুরাতন কৌশল বা প্রতিশ্রুতির সংযোজন-বিয়োজন করে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা। যেমন, আওয়ামী লীগের রূপকল্প-২০২১ কে সামনে রেখে নতুন রূপকল্প-২০৪১ ঘোষণা করা। আবার কখনও কখনও অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা করা। যেমন, আওয়ামী লীগকে অনুকরণ করে জনগণের সামনে বিএনপির ঘোষিত ভিশন-২০৩০। রাজনীতির এই কৌশলটাকে প্রতিযোগিতামূলক বাজার অর্থনীতির সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। বাজারে যখন কোন কোম্পানি নতুন কোন পণ্য উদ্ভাবন করে জনপ্রিয়তা পায় তখন আরও অনেক কোম্পানি একই ধরনের পণ্য উৎপাদন করে বাজারে ছাড়ে। এতে পরে আসা কোম্পানির ক্ষেত্রে দুটি জিনিসের একটি ঘটে থাকে। এক, সে পূর্ববর্তী কোম্পানির বাজার পর্যবেক্ষণ করে দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে পণ্যের মান বৃদ্ধি করার সুযোগ পায়। দুই, যদি নতুন কোম্পানি সেটা করতে না পারে তাহলে পূর্ববর্তী কোম্পানির বাজার দখল থাকার কারণে তার পণ্য মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। বিএনপির ক্ষেত্রে কি ঘটবে এখন সেটা দেখার বিষয়। এটা যে তারা ২০১৯ এর নির্বাচনকে সামনে রেখে মাঠ চাঙ্গা করতে ঘোষণা করেছে সেটা বুঝতে বিশাল মাপের পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন নেই। আসলে বিএনপি যে ভিশন ঘোষণা করেছে তার মধ্যে আহামরি নতুন কিছু নেই। এসব আগে-পরে বিএনপিসহ রাজনৈতিক দল কথাগুলো বলেছে। তারপরও একেবারে দু-একটি বিষয় যে উঠে আসেনি, তা নয়। আর মৌলিক কিছু জায়গায় তাদের এতদিনের প্রতিফলিত নীতির পরিবর্তন নতুনভাবে ভাবনার তাড়না যোগাচ্ছে। এই ঘোষণায় দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের কথা এসেছে। এখানে বিশিষ্ট নাগরিকদের নিয়ে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠিত হবে। এ বিষয়ে দলের মহাসচিব নির্দিষ্ট করে কোন ব্যাখ্যা বিবিসি বাংলার সাক্ষাতকারে উপস্থাপন করতে পারেননি। তার অর্থ হলো, বিএনপি কোন হোমওয়ার্ক না করেই একটা বিষয় জনগণের সামনে উপস্থাপন করেছে। অন্যদিকে বিএনপি ঘরানার বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ এটার সমালোচনা করেছেন। তিনি মত প্রকাশ করে বলেন, ফেডারেল সিস্টেম সরকারের ক্ষেত্রে উচ্চকক্ষ যতটা ফলপ্রসূ আমাদের সরকার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে তা হবে না। আবার আঞ্চলিক কোন পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়কে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য এই ব্যবস্থা নেয়া হয় বলে তিনি মত প্রকাশ করেছেন। সুতরাং, আমাদের দেশে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের নামে অযথা অর্থের অপচয় হবে বলে আমি মনে করি। এক্ষেত্রে বলে রাখা ভাল যে, বিএনপি ২০০১ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে সংসদীয় আসন বাড়ানোর কথা বলেও ক্ষমতায় গিয়ে বাড়ায়নি। ভিশন-২০৩০ এ যে কথাটা বিশিষ্ট নাগরিক সমাজের নজর কেড়েছে তা হলো, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমিয়ে নির্বাহী বিভাগে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা। কিন্তু আসলেই কি সেটা করতে পারবে বিএনপি? কেননা সংসদে দেখা যায় দলীয় প্রধানরাই সরকারপ্রধান হয়। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোতে দলীয় প্রধানরা অনেক শক্তিশালী। আর দলটি যখন বিএনপি তখন এই প্রস্তাব গভীরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ ১৯৯১ সালে তারা ক্ষমতাসীন অবস্থায় সংসদীয় উপনেতা এবং ২০০৯ সালে সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা নির্বাচন করতে পারেনি। একে তো এই প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান সংশোধন করতে হবে; তার জন্য দুই-তৃতীয়াংশ আসন প্রয়োজন। অন্যদিকে যারা সংসদে তাদের দলের প্রধানের অনুপস্থিতিতে কে তাদের সংসদীয় নেতা হবে সেটাই নির্বাচন করতে পারেনি, তাদের কাছে এই প্রত্যাশা অলীকই বটে। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। স্বাধীনতা অর্জনে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের অবদান ছিল। সুতরাং বলা যায় এই রাষ্ট্রের এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র পথ হলো বহুত্বের সমন্বয়বাদ। বিএনপি এই ঘোষণায় রেইনবো সমাজ গঠনের কথা বলেছে। কিন্তু এটা আসলে বিএনপির রাজনৈতিক আদর্শের ধারার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে হয় না। কেননা এই বিএনপি তো মাত্র কিছুদিন আগ পর্যন্ত একাত্ববাদী রাষ্ট্র কায়েমের জন্য একটি ধর্মীয় গ্রুপকে উস্কানি দিয়েছিল। ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতের শাপলা চত্বরে জমায়েত তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। তারপরও আমার ব্যক্তিগত পক্ষ থেকে বিএনপিকে ধন্যবাদ এই কারণে যে তারা বুঝতে পেরেছে, বাংলাদেশের উন্নয়নের মূলমন্ত্র বহুত্বের সমন্বয়বাদিতা। সকল ধরনের কালো আইন বাতিল করা হবে বলে তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কিন্তু কালো আইন করে বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারবর্গের নির্মম ও বিরল হত্যাকাণ্ডের বিচার রোধে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে হত্যার রাজনীতিকে বৈধ স্বীকৃতি দিয়েছে দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। এখন তাদের মুখে কালো আইন বাতিলের কথা শুনতে হয়। কি বিচিত্র অভিজ্ঞতা আমাদের! বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নির্মূলের ঘোষণা দিয়েছে সেই দল যারা ক্ষমতাসীন সময়ে ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ চালু করে কালো অধ্যায়ের সূচনা করেছে। আজ তারা র‌্যাবের বিরুদ্ধে কথা বলছে কিন্তু এই র‌্যাব তাদের আমলে প্রতিষ্ঠিত। ২০৩০ সালের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তিকে উপার্জনের শ্রেষ্ঠ খাতে রূপান্তর করবে বলে বিএনপি ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি যে আয়ের মাধ্যম হতে পারে এই ধারণাকে তো রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করেছে আওয়ামী লীগ। এভাবে প্রতিটি বিষয়ে ধরে ধরে বিএনপির দ্বিচারিতা স্পষ্ট করে প্রতীয়মান করা যায়। সুতরাং বিএনপি আগামী দিনের রাজনীতিতে কি করবে সেটা বলার আগে পেছনের দিনের রাজনীতির জন্য জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়ে ভিশন-২০৩০ ঘোষণা করা উচিত ছিল বলে আমি মনে করি। লেখক : ছাত্র নেতা
×