ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

জুতা-স্যান্ডেল এখন আর হাতে ওঠে না

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ১৫ জুলাই ২০১৭

জুতা-স্যান্ডেল এখন আর হাতে ওঠে না

বর্ষায় হাঁটু কাদা ঘেঁটে এখন আর হাটবাজার, সংযোগ সড়ক কিংবা উপজেলা সদরে যেতে হয় না অন্তত ৮০ ভাগ মানুষকে। শিশু, কিশোর-কিশোরীদের স্কুল-কলেজে যেতে কাউকে পেরোতে হয় না কাদা। স্যান্ডেল-জুতা আর হাতে থাকে না। শুধু বর্ষা নয়। দুর্যোগকালীন আশ্রয় নেয়ার জন্যও জীবন শঙ্কায় থাকতে হয় না। পর্যটন সমৃদ্ধ সাগরপারের কলাপাড়া উপজেলায় সেকালের সেই বিদ্ঘুুটে জনপদে অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। এমন কোন ওয়ার্ড নেই যেখানে স্কুল কাম সাইক্লোন শেল্টার কিংবা ছোটখাটো স্থাপনা না হয়েছে। রয়েছে মাইলের পর মাইল পাকা সড়ক। বর্ষাকাল আর শুকনো মৌসুম সব সময় স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচল করছে মানুষ। ষাটোর্ধ শাহজাহান মিয়া। বাড়ি বড়বালিয়াতলী গ্রামে। ২০০৭ সালের প্রকৃতির বুলডোজারখ্যাত সুপার সাইক্লোন সিডরের কথা আজও ভোলেননি। আশ্রয়কেন্দ্র অনেক দূরে থাকায় সবাইকে নিয়ে চরম ঝুঁকির মধ্যে এ মানুষটি বাড়ির দেড় তলা টিনশেড ঘরেই ছিলেন। কোনমতে রক্ষা পেয়েছেন। তবে ঘরটি কাত হয়ে গেছে। এ মানুষটি এখন ঘূর্ণিঝড়কালীন আশ্রয় নিয়ে দুশ্চিন্তামুক্ত। পাঁচ মিনিটের পথ, তাও পাকা সড়ক পেরিয়ে যেতে পারেন এমন দুটি বহুতল আধুনিক বহুমুখী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কাম আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ হয়েছে বাড়ির পাশে। বড়বালিয়াতলী গ্রাম ছাড়াও আশপাশের অন্তত তিন হাজার মানুষের আশ্রয় নেয়ার সুযোগ রয়েছে। একই মন্তব্য লেমুপাড়া আদর্শ গ্রামের নূর আলমের। সিডরে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। শুধু তাই নয়, এখন মাদ্রাসা-স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা পাকা রাস্তায় যানবাহনে চড়ে নির্বিঘেœ, আয়েসে পৌঁছে যায় গন্তব্যে। ধূলাসার ইউনিয়নের গঙ্গামতী এলাকার বেড়িবাঁধের বাইরের মানুষকে এক সময় খেয়া নৌকা পেরিয়ে ধোলাই মার্কেট হয়ে যেতে হতো চার/পাঁচ কিলোমিটার দূরের চাপলী বাজারে। নিত্যপণ্য সামগ্রী, মাছ বেচাকেনা করতে ছিল অন্তহীন সমস্যা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও ছিল না। বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে স্থানীয়দের চার/পাঁচ কিলোমিটার হাঁটু-কোমর সমান কাদা পেরিয়ে চরচাপলী প্রাইমারি কিংবা চাপলী ইসলামিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যেতে হয়েছে। এখন সেই গঙ্গামতীর এক হাজার পরিবারের নেই দুর্ভোগ নেই আর ভোগান্তি। গার্ডার ব্রিজ হয়েছে। পাকা সড়ক হয়েছে। হয়েছে দু’টি স্কুল কাম সাইক্লোন শেল্টার। সিডরেও আশ্রয় নেয়ার জায়গা ছিল না। এখন আশ্রয় নেয়ার মতো দু’টি ভবন হয়েছে। জুতা-স্যান্ডেল পায়ে স্কুলে যায় শিশুরা। স্থানীয়রা পাকারাস্তায় মুহূর্তেই যানবাহনে ছুটছে বাজার সওদা করতে। যাচ্ছে চিকিৎসা সেবা নিতে। সবই করছে স্বাচ্ছন্দ্যে। গঙ্গামতী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল লতিফ জানান, এখানে স্কুল খোলা হয়েছে। তার বিদ্যালয়ে ২৯৭ শিক্ষার্থীর প্রাথমিক শিক্ষার সমস্যা কেটে গেছে। পাশাপাশি অনগ্রসর গঙ্গামতীর জেলে পরিবারগুলো এখন স্বস্তিতে জীবনযাপন করছে। লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। এখন গাড়িতে পর্যটক-দর্শনার্থী আসছে গঙ্গামতী এলাকায়। দুর্গম ছিল ধুলাসার ইউনিয়ন। আজ সেখানে গড়ে উঠেছে ডিগ্রী কলেজ। বাড়ির খেয়ে কলেজে যায় ছেলেমেয়েরা। উচ্চশিক্ষা নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অজপাড়া গাঁয়ের কৃষক-কামলা-হাইলা শ্রেণীর মানুষের সন্তান লেখাপড়ার সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছে। আলহাজ জালাল উদ্দিন কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সিআইপি ইঞ্জিনিয়ার তৌহিদুর রহমান। এমপিওভুক্ত হয়েছে কলেজটি। সেখানে সরকারীভাবে হয়েছে একাধিক আধুনিক সাইক্লোন শেল্টার। এইচএসসি উত্তীর্ণ মেধাবী শিক্ষার্থী মিনারা বেগম, হাফসা, আফজাল হোসেন ও হাসান জানায়, এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠা না হলে তাদের লেখাপড়ার কোন সুযোগ ছিল না। এরা সবাই হতদরিদ্র। লালুয়ার দুর্যোগ ঝুঁকিতে বসবাস গ্রামের মানুষ বানতিপাড়ায় সিডর আইলায় যাদের ভাসতে হয়েছে জলোচ্ছ্বাসে। অস্বাভাবিক জোয়ার যাদের নিত্য দুর্যোগে পরিণত হয়। সিডরে এসব মানুষ হারিয়েছে তরতাজা প্রাণ। তাদের এলাকায় নির্মিত হয়েছে কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে আধুনিক বহুমুখী আশ্রয় কেন্দ্র। যেটিতে পরিচালিত হচ্ছে মাদ্রাসা শিক্ষার কার্যক্রম। শিক্ষানুরাগী মিয়া মোহাম্মদ চান খান জানান, তাদের এলাকার মানুষ এখন দুর্যোগকালীন ঝুঁকি থেকে মুক্ত। ইসলামপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কালীনাথ হালদার জানালেন, সিডরের সময় কোন আশ্রয় কেন্দ্র না থাকায় এখানকার তিন গ্রামের মানুষ চরম ঝুঁকি নিয়ে বাড়িঘরে অবস্থান করে। তাঁর ঘরটিও বিধ্বস্ত হয়। এখন বহুতল আধুনিক আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। যেখানে স্বাচ্ছন্দ্যে শিশুরা লেখাপড়া করছে। এছাড়া ইসলামপুর, নেয়ামতপুর, ছলিমপুরের মানুষ দুর্যোগকালে নিরাপদ আশ্রয় নেয়ার সুযোগ পেয়েছে। গৈয়াতলা গ্রাম সংলগ্ন বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত হয়ে জলোচ্ছ্বাসে দুই শিশুর প্রাণহানি হয়েছিল। নীলগঞ্জ ইউনিয়নে তখন আটজনের প্রাণহানি হয়। সিডরের তা-বে মানুষ চরম বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতির শিকার হয়েছিল। তখন কোন আশ্রয় কেন্দ্র ছিল না। বর্তমানে সেখানে দক্ষিণ গৈয়াতলা স্কুল কাম বহুমুখী সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করা হয়েছে। হয়েছে পাকা সড়ক। এভাবে চাকামইয়ার কাছিমখালী গ্রামে বহুতল আধুনিক আশ্রয়কেন্দ্র করা হয়েছে। চরচাপলী গ্রামটিতে সবচেয়ে ঘনবসতি। সাগরের কোলঘেঁষে গ্রামটি। এখানকার একটি মাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন ছিল। ছিল জরাজীর্ণ একটি আশ্রয়কেন্দ্র। সিডরে সেখানকার তিনজনের প্রাণহানি হয়। আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষ আশ্রয়ের সঙ্কুলান হতো না। বর্তমানে আধুনিক সাইক্লোন শেল্টার করেছে এলজিইডি বিভাগ। স্কুলকাম সাইক্লোন শেল্টারে যেতে পাকা সড়কের কাজও শেষের পথে। বিদ্যুতের বাতি জ¦লছে। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। সন্ধ্যার পরে নারী-পুরুষ সারা দিনের কাজ শেষে টিভি দেখে। -মেজবাহউদ্দিন মাননু, কলাপাড়া থেকে
×