ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

প্রজাপতির লীলালাস্য ও ঘাতক দেশকাল

প্রকাশিত: ০৩:৩৪, ১০ জুলাই ২০১৭

প্রজাপতির লীলালাস্য ও ঘাতক দেশকাল

জাফর ওয়াজেদ ॥ প্রজাপতির মতোনই তিনি উড়ে বেড়ান। ঘুরে ঘুরে এই ফুল, সেই ফুলের গাছে বসেন। আবার ডিগবাজি দেন পায়রার মতো। আজ এ বাড়ি তো কাল ও বাড়িতে ঘুরপাক খান। উড়তে ফিরতে ঘুরতে বোধহয় বেশ ভালই বাসেন। অনেকটা সদ্য প্রয়াত শিল্পী সবিতা চৌধুরীর গাওয়া এবং সলিল চৌধুরী নির্মিত সেই গানের মতোই, ‘প্রজাপতি, প্রজাপতি আমার ইচ্ছে হয়ে বনে বনে ঘুরে ফিরে আর উড়ে।’ রং বদলাতেও তিনি পারদর্শী। বিচিত্র বর্ণ তাকে আঁকড়ে থাকে। রঙে রঙে রং মশাল জ্বালাতে না পারলেও বোলতার মতো হুল ফোটাতে ভালবাসেন। এর মধ্যেই তার আনন্দ উচ্ছ্বাস আর পরম ভাললাগা খুঁজে পান। সঙ্গীত, নাটক, কবিতা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, কলাম রচনা- হেন কাজ নেই, যাতে তিনি অনুরাগ বিবর্জিত নন। একই সঙ্গে ব্যবসায়ী, কৃষিবিদের তকমাও গায়ে সেঁটে আছেন। সব সময় আলোচিত হতে ভালবাসেন, নিজেও আলোড়িত হন নানাভাবে। একতারা হাতে গেরুয়া বসনে নেচে ওঠেন বাউলের মতো। আবার ধর্ম-কর্ম নিয়ে মাতোয়ারাও হয়ে ওঠেন। সমাজতন্ত্র, কমিউনিজমের অনুসারী হিসেবে নিজেকে পরিচিত করে তোলায় সচেষ্ট হতেও দেখা গেছে। ব্যঙ্গ বিদ্রূপ এবং অপরকে হেয় করার ভাষাটাও তার আয়ত্তে। অনায়াসে সবকিছুকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চান। আজ যার সমালোচনা করছেন, কাল তার কণ্ঠলগ্ন হয়ে পড়ার স্বভাবটি তার একান্ত নিজস্ব। কোন কিছুতে স্থির থাকা সম্ভব নয় বলে অস্থিরতার অভ্যন্তরে বসবাস করে ওলোটপালট কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়তে দ্বিধা করেন না। তার কার্যকলাপ তাকে যেমন বিতর্কিত, সমালোচিত করে, তেমনি সন্দেহের শীর্ষে নিয়ে যায়। জনমানুষের আশা-আকাক্সক্ষাকে ভূলুণ্ঠিত করে দেয়ার কায়দা-কানুন রপ্ত বলে অনেক সত্যকে তিনি অসত্যে রূপান্তরিত করেন। আবার অসত্যকে সত্যে পরিণত করার জন্য প্রাণপণ প্রলাপে মাতেন। চিন্তা-চেতনায় জটিলতাকে নানাভাবে ধারণ করেন বলে কোন স্বকীয় ভাবনাকে আর সামনে আনতে পারেন না। বিভ্রান্তির চোরাবালিতে হাবুডুবু খান আর ‘বাঁচাও, রক্ষা কর’ বলে চেঁচিয়েও ওঠেন। এমনটাও মনে হয় যে, পানির মতোই, যে পাত্রে রাখা যায়, সেই পাত্রের আকার ধারণ করেন। আজ যে তত্ত্ব হাজির করেন, ক’দিন পর সেই তত্ত্বকে খ-াতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আর হাজির করেন নয়া তত্ত্ব। কখনও মার্কসবাদ, কখনও ধর্মকে বর্ম করে নানা কিসিমের পণ্য ফেরি করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। এটা তার বৈশিষ্ট্য এবং স্বভাবজাত। কৃষক, শ্রমিকের পক্ষে কথা বলে তিনি নিজেকে শ্রেণীচ্যুত করেছেন-এমন দাবির বিপরীতে বাস্তবে কিছুই মেলে না। নয়া কৃষি প্রবর্তনার নামে কৃষি জমি কেনার নেশা এবং চাষাবাদে মগ্ন হতেও দেখা যায়। উৎপাদিত চাল, ডাল বিক্রিও করেন চড়া দামে। এক শ’ টাকা কিলোগ্রামের নিচে কোন চাল মেলে না তার চালের আড়তে। টাঙ্গাইল, খুলনা, যশোরে জমি কিনে নয়া কৃষি কাজ চালিয়ে আসছেন। জমিজমা নিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কোন বিরোধ হওয়ার কথা শোনা যায়নি। আবার কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ার লালন আখড়ার বিপরীতে আরেকটি আখড়া স্থাপন করে সেখানে গান-বাজনার আয়োজন করে আসছেন। সে নিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে রয়েছে দ্বন্দ্ব। বহুমুখী ধারাতে নিজেকে সংস্থাপন করার প্রতিভা (!) তার। যেখানেই হাত রাখেন, সেখানেই সোনা ফলে; তা নয়। অনেক কিছুই ছাইভস্ম হয়ে যায়। নাটকও লিখেছেন তিনি। মহিলা সমিতির মঞ্চে তার প্রদর্শনীও হয়েছে। তবে সেই নাটকগুলোর প্রসঙ্গ তিনি এড়িয়ে যান, কোথাও উল্লেখ করেন না। নিজের পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে হয়ত সে সব চাপা দিয়ে রেখেছেন। তবে নাটুকেপনা থেকে এক পা-ও সরে আসেননি। ফরহাদ মজহার; বাংলাদেশে এখন আলোচিত নাম। স্বাধীনতার পূর্ব হতেই অর্থাৎ ষাটের দশকের শেষ দিকে তিনি কাব্যচর্চা শুরু করেন। একই সঙ্গে সশস্ত্র রাজনীতিতে হাতেখড়ি দেন। পূর্ব পাকিস্তানের সর্বহারা পার্টির সঙ্গে তিনিসহ তার অপর বন্ধু কবি হুমায়ূন কবির ও প্রাবন্ধিক আলী মনোয়ার ওতপ্রোত জড়িত শুধু নয়, সক্রিয়ও ছিলেন। পার্টির তাত্ত্বিক বিষয়গুলো নিয়ে দলে আলোচনা চালাতেন। ১৯৭২ সালে তত্ত্ব নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে কবি হুমায়ূন কবির, ছিলেন যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তরুণ প্রভাষক, খুন হন ইন্দিরা রোডের বাসার সামনেই। এই হত্যাকা-ে ফরহাদ মজহার সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন বলে সে সময়েই প্রচারণা ছিল। মামলার যথাযথ তদন্ত হয়নি বলেই খুনীদের নাম অজ্ঞাতই রয়ে গেছে। বিচারের বাণী এখানেও কেঁদেছে। স্টেনগান খুব প্রিয় ছিল ফরহাদ মজহারের কাছে। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর দেশ হানাদারমুক্ত হওয়ার পর পরই স্টেনগান কাঁধে ফরহাদ ঢাকা বেতারে প্রবেশ করেছিলেন। বিষয়টি সে সময় খুব আলোচিত হয়েছিল। পঞ্চাশ ও ষাট দশকের দুই কবিকে খুঁজতে তিনি বেতার কেন্দ্রে প্রবেশ করেন। হত্যা করার উদ্দেশ্য ছিল কিনা, তা জানা যায়নি। ওই দুই কবি পাকিস্তানী হানাদার দখলকৃত ঢাকায় বসবাস করতেন। একজন রুশ দূতাবাসে চাকরি করতেন। দূতাবাসটি পাকিস্তানীরা বন্ধ করে দিলে বেকার হয়ে যান এবং অপর বোহেমিয়ান কবি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতেন। তাদের এই করুণ অবস্থা থেকে উদ্ধার করেছিলেন বেতারকর্মী কবি শামসুল ইসলাম। ঢাকা বেতারে অনুবাদের কাজ জুটিয়ে দেন। সে সুবাদে ‘ডান্ডিকার্ড’ (পরিচয়পত্র) পাওয়ায় হানাদারদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার পথ সুগম হয়েছিল। ওই কবিদের প্রতি নাখোশ হয়ে উঠেছিলেন ফরহাদ। পাকিস্তানীদের দালাল হিসেবে তাদের চিহ্নিতও করতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ঘোরবিরোধী হিসেবে নিজেকে জাহির করতেন। সাতই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেছিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, আমি চাই বাংলার মানুষের মুক্তি।’ এই ভাষ্যকে বিদ্রূপ করে ফরহাদ কবিতা লিখলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, আমি বুড়ো আংলা।’ কবিতাটি তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘খোকন ও তার প্রতিপুরুষ’-এর প্রথমেই ঠাঁই পেয়েছে। তিনি দেশ ছেড়ে পালানোর পর ১৯৭৪ সালে বর্ণবীথি নামে প্রকাশনী সংস্থা গ্রন্থটি প্রকাশ করেছিল। বঙ্গবন্ধুর সরকার যেহেতু মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিশ্বাসী ছিল, তাই কবিতাটি সম্পর্কে কোন উচ্চবাচ্য করা হয়নি, গ্রন্থ নিষিদ্ধ দূরে থাক। স্বাধীনতার পর ফরহাদ নাটক লিখলেন ‘প্রজাপতির লীলালাস্য’। মহিলা সমিতির মঞ্চে ‘বহুবচন নাট্যগোষ্ঠী’-এর মঞ্চায়ন করে। স্বাধীনতা পরবর্তী সরকার ও তার কার্যক্রমকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে রচিত নাটকটি ছিল প্রতীকীধর্মী। বঙ্গবন্ধু সরকার নাটকটি মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে কোন বাধা-বিঘ্ন তৈরি করেনি। ফরহাদের প্রজাপতির লীলালাস্য তার জীবনের পরতে পরতে ছেয়ে আছে। নিজেই প্রজাপতির মতো উড়ে ঘুরে ফেরার আমেজে মুগ্ধ থাকতেন। এখনও তিনি সেই প্রজাপতি রয়ে গেছেন, রং পাল্টায় শুধু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের ছাত্র ছিলেন ফরহাদ। তার সহোদরা রোকেয়া হলের ছাত্রী থাকা অবস্থায় হলের সামনে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন। এই মর্মান্তিক ঘটনা ১৯৮০ সাল পর্যন্ত হলের পক্ষ থেকে স্মরণ করা হতো। পালিয়ে সস্ত্রীক নিউইয়র্কে যাওয়ার পর সেখানে রাজনৈতিক অর্থনীতি বিষয়ে পড়াশোনা করেন। একই সঙ্গে সঙ্গীত বিষয়েও অধ্যয়ন করেন। মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল তাহেরকে যেদিন ফাঁসি দেয়া হয়, সেদিনও ছিলেন নিউইয়র্কে। বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়েছিলেন সঠিক খবর জানার জন্য। প্রথমে ফাঁসির আদেশ কার্যকর করার সংবাদ দূতাবাস প্রকাশ করতে চায়নি। কিন্তু অনেক পীড়াপীড়ির পর তিনি জানতে পারলেন আসল তথ্য। উল্লেখ করেছেন তার ‘একটি গানের জন্ম’ নিবন্ধে; ‘দূতাবাস থেকে বেরিয়ে আমার হঠাৎ মনে হলো, চতুর্দিক ঘিরে এক গভীর অন্ধকার নেমে আসছে এবং একটা দীর্ণ বিধ্বস্ত যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যভাগ ভেদ করে চলে যাওয়া পথ ধরে আমি অনন্তকাল হাঁটছি। সেই অবিনশ্বর হেঁটে যাওয়ার ভেতর হঠাৎ আবৃত্তির মতোন গেয়ে উঠেছিলাম, ‘আমি সৈনিক আমাকে ফের ফিরতে হবে যুদ্ধক্ষেত্রে।’ এই কবিতাকে পরে তিনি দীর্ঘ গানে পরিণত করেন। বাল্যকালে মাদ্রাসায় পড়া ওয়াজের সুর ভালই রপ্ত করেছিলেন, সেই সুরে তিনি গানটি বেঁধেছিলেন। জিয়াউর রহমান নামক সেনাশাসককে তিনি ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে গানে উল্লেখ করেছেন। তেমনি মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধীদের অপতৎপরতায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন এই গানে। ফরহাদের স্বকণ্ঠে এই গান শুনেছিলাম ১৯৭৭ সালে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে আসা একদা সর্বহারা পার্টির নেতা ফরহাদকে বাজারজাত করতে এগিয়ে আসেন জাসদের তৎকালীন তাত্ত্বিক আহমদ ছফা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসে থাকতেন ছফা। সেখানে ফরহাদ এসে আড্ডা দিতেন। ক্যাম্পাসে তখন আমাদের সদর্প পদচারণা ছিল সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে। জিয়ার সাময়িক শাসনের বিরুদ্ধে তখন সবাই এককাট্টা। ছফার মাধ্যমে ফরহাদের সঙ্গে পরিচয় ঘটে আমাদের। আমরা জানলাম ফরহাদ একজন গীতিকার, সুরকার ও গায়ক। ছফা ‘রক্তকরবী’ নামে একটি কাগুজে সংগঠনের ব্যানারে ফরহাদের গানের আসর করার আয়োজন করেন। কলাভবনের প্রধান ফটকের সামনে সকালবেলা আয়োজন করা হয় ফরহাদ মজহারের একক গানের আসর। কার্ড ছেপে তা বিতরণের কাজ করেন আলী রীয়াজ। মাইক ভাড়া করে আনার ও চেয়ার-টেবিল সাজানোর কাজটি আমার ওপর বর্তেছিল। গানের আগে তরুণ কবিরা কবিতা পাঠ করেছিলাম। গান শুরুর সঙ্গে শ্রোতার সংখ্যা বাড়তে থাকে। টেপ রেকর্ডে গান ধারণ করেছিলেন ফরহাদের অনুজ সহপাঠী ফয়সল মোকাম্মেল হক। ওইসব গানের বক্তব্য ও সুর শ্রোতাসহ আমাদের মুগ্ধ এবং উদ্বুদ্ধ করেছিল। গানের লিরিক ও সুরের নতুনত্বের কারণেও বৈকি। জাসদের তাত্ত্বিক আহমদ ছফা ফাঁসিতে নিহত তাহেরের প্রাণদানকে মহিমান্বিত করে বক্তব্য রেখেছিলেন। জাসদ নেতা মুক্তিযোদ্ধা তাহেরের ফাঁসির ঘটনা ফরহাদকে আলোড়িত করেছিল, সে কথাও জানালেন গান শুরুর আগে। গোটা দশেক গান পরিবেশন করেছিলেন, যার অধিকাংশই সামরিক শাসক জিয়ায় দুঃশাসনকে চিহ্নিত করে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শ্রোতারা গান শুনেছিল। প্রথম গানটি তাহেরের ফাঁসি নিয়ে। যাতে জিয়ার শাসনামল এবং মৌলবাদীদের উত্থান ফুটে উঠেছে। সুর ছিল ওয়াজের। ফরহাদ গাইলেন, ‘রক্তাক্ত হয়েছে আমার মানুষ, মৃতদেহে ইতিহাস আচ্ছন্ন/যারা খুনী, যারা যুদ্ধবাজ যারা শিশু হত্যায় পারদর্শী/তারা আজ শান্তির কথা বলছে/তারা ছুরি শানাচ্ছে আমার দিকে তাকিয়ে/তারা আমাকে স্তব্ধ করে দিতে চায়/অন্ধকারে যারা আমাদের ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে পড়েছিল/আজ তারা ঈমান ধর্মগ্রহণ ন্যায়নীতির কথা বলছে/এত অন্ধকার/বুটে ও খাকিতে কেটে যাচ্ছে সবার দিন/অথচ পঁচিশে মার্চের রাত্রির কথা কারও মনে নেই/যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই স্টেনগান রেখে দিয়েছে মুক্তিযোদ্ধা/মুখের মুখোশ পাল্টে লোকালয়ে ফিরে এসেছে বিশ্বাসঘাতক/মানুষ তাদের অভিবাদন জানাচ্ছে; এত অন্ধকার/এত অন্ধকার আমি এর আগে আর কখনও দেখিনি প্রিয়তমা।/একজন সৈনিক তার পোশাক উপহার দিয়েছে চাষীকে/অথচ বিপ্লবীরা তার অর্থ বুঝতে অক্ষম/বিশ্বাস করো, আমি একজন দেশপ্রেমিককে দেশদ্রোহী বলে ফাঁসি দিতে দেখেছি/সাক্ষী ছিল সারা দেশ/অথচ একজনও তার প্রতিবাদ করেনি/এত অন্ধকার, আমি এর আগে কখনও দেখিনি প্রিয়তম/আমার শৈশব কেটেছে দাঙ্গায়; আমার যৌবন যাচ্ছে যুদ্ধে/পেছনে আজ অগ্নিদগ্ধ লোকালয়/আমার সময় যাচ্ছে হিংসায়; আমার সময় যাচ্ছে হত্যায়/মহাকাল আজ আমার বিপক্ষে/’ তার এই গান আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল সেদিন সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনকে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে। এক স্থানে তিনি গেয়েছেনও ‘আমাকে লড়তে হবে/ জলপাই পোশাক পরা খুনী বদমাশদের বিরুদ্ধে।’ ফরহাদ মজহারকে কেন্দ্র করে জাসদ ও তার ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা সংঘবদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন সেদিন। এদের মধ্যে অনেকে শিষ্য হয়ে উঠেছিলেন ফরহাদের। জাসদ সমর্থিত সাহিত্য ও সাময়িকীগুলোতে তখন ফরহাদের জয়জয়কার। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের তাত্ত্বিক ব্যাপারে ফরহাদ মাঠে নেমেছিলেন। তার গানে মুগ্ধ হয়ে শেষতক আহমদ ছফা ও সহপাঠী কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ উদ্বুদ্ধ হয়ে সঙ্গীতচর্চায় মনোনিবেশ করেছিলেন। জান্তা শাসক জিয়া তার সতীর্থ তাহেরকে ফাঁসি দিয়েছিলেন। যা সে সময় দেশজুড়ে সমালোচিত হতে থাকে। ফরহাদ নাটক লিখলেন ‘ঘাতক দেশকাল’। সামরিক জান্তা, ধর্মান্ধ মৌলবাদী, ধর্ম ব্যবসায়ীদের মুখোশ উন্মোচন করে মুক্তিযোদ্ধাদের অসহায় অবস্থাকে তুলে ধরেন নাটকে। বহুবচন নাট্যগোষ্ঠী নাটকটি মঞ্চায়ন করেছিল। নাটকে ফরহাদ গানও ব্যবহার করেছিলেন। সাহসও জুগিয়েছিলেন এই বলে যে, ‘এই দুঃসময়ে আমি তোমার কাছে চাই সাহস/আমার বুক থেকে মুছে দাও রক্তের দাগ/আমি সৈনিক, আমাকে ফের ফিরতে হবে যুদ্ধক্ষেত্রে/’। ঘাতক দেশকাল পরবর্তীতে বহুবচনের নাট্য পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। কিন্তু গ্রন্থাকারে বের হয়নি। ততদিনে অপর সামরিক জান্তা এরশাদ দৃশ্যপটে আবির্ভূত হলো। আর ফরহাদ উবিনীগ নামে এনজিও চালু করে দেন। জাসদের যেসব নেতারা তার অনুরক্ত ছিলেন, তারা ফরহাদকে ‘সিআইএ’র এজেন্ট হিসেবে অভিহিত করেন এবং ফরহাদেরও জাসদপ্রীতি লুপ্ত হয়ে যায়। তার এই এনজিওটা মার্কিনী সহায়তায় গড়ে উঠে বলে প্রচার হতে থাকে। উবিনীগ থেকে প্রবর্তনা, নারী গ্রন্থ প্রবর্তনা ইত্যাদি এনজিওর আত্মপ্রকাশ ঘটতে থাকে। ‘চিন্তা’ নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশ শুরু করেন। এরপর নয়া কৃষি প্রবর্তনা চালু করেন। টাঙ্গাইলসহ দেশের অন্যান্য স্থানে কৃষি জমি ক্রয় করে চাষাবাদ শুরু করেন। মনসান্তোর এবং মাহিকো নামে দুটি মার্কিনী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন অপর একটি মার্কিনী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হয়ে। বিটি বেগুনের কড়া সমালোচক শুধু নয়, এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শানিয়ে তুলেছিলেন। ফরহাদের মতে, বিটি বেগুনের স্বত্বাধিকারী মনসান্তোর। কিন্তু বাস্তবে এই অধিকার তাদের ছিল না। আশি ও নব্বইয়ের দশকে মার্কস, এঙ্গেলস, হেগেলস নিয়ে প্রচুর লেখালেখি করা ফরহাদ একান্নব্বই সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে সেদিকে ঝুঁকে পড়েন। বিএনপির বুদ্ধিজীবী হিসেবে নিজের অবস্থান গড়ে তোলেন। প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়ার সঙ্গে চীনও সফর করেন। কিন্তু হানিমুন টেকেনি। ১৯৯৫ সালে বিএনপি সরকার তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করে। পরে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পান। এরপর ক্রমশ জামায়াতের প্রতি নিবেদিত হয়ে পড়েন। তাদের পত্রপত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন, যা আজও অব্যাহত। ২০১৩ সালে হেফাজতের প্রতি সমর্থন জানিয়ে মাঠে নেমে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বক্তব্য রাখা শুরু করেন। জঙ্গী তৎপরতাকেও সমর্থন করে বক্তৃতা দিয়েছেন। প্রজাপতি ফরহাদ মজহার রঙিন হয়ে উঠেছেন আবারও প্রজাপতির লীলালাস্য থেকে ঘাতক দেশকাল পেরিয়ে অপহরণ নামক নাটকের মঞ্চায়নে। এ্যাবসার্ড নাটকের চরিত্রে তিনি যে অভিনয় করে যাবেন, তা বোঝা যায়। কাহিনীটি ঠিকঠাক মতো সাজাতে হয়তো আরও কিছুদিন সময় নেবে। অনেকে মেধা ও জ্ঞান নিয়ে ফরহাদ মজহার বিভ্রান্তির চোরাবালিতে আটকে পড়ে আছেন। এখান থেকে তাকে উদ্ধার করবে কে? হেফাজত বা জঙ্গীরা তার প্রতি সদাশয় হলেও শেষ পর্যন্ত ফরহাদ কতটা অনুগত থাকবেন তাদের প্রতি তা এখনই বলা যায় না। প্রজাপতির মতো অন্য কারও ইচ্ছে হয়ে উড়ে ঘুরে ফিরছেন কিনা তিনি তা অচিরেই জানা যাবে। ইতিহাস ফরহাদ মজহারকে কতটুকু ক্ষমা করবে, কে জানে। কিন্তু জাতি বাঙালী তার নষ্ট-ভ্রষ্টতাকে বেশিদিন সমীহ করবে বলে মনে হয় না। অপহরণ কাহিনী প্রকাশিত হলে প্রজাপতির আরেক রঙ-এর দেখা মিলবে।
×