ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনির মেলব্যাগ ॥ ঈদ ॥ সবকিছু ছাপিয়ে হোক সর্বজনীন

প্রকাশিত: ০৬:৪৮, ২৫ জুন ২০১৭

সিডনির মেলব্যাগ ॥ ঈদ ॥ সবকিছু ছাপিয়ে হোক সর্বজনীন

ঈদের আর মাত্র ক’দিন বাকি। বাংলাদেশে উৎসবের কোন জাত-পাত নেই। সেটা ধর্মীয় হোক আর সামাজিক হোক, মানুষ মেতে উঠবেই। তবে এবারের ঈদের আগে পাহাড়ে যে অঘটন, হাওড়ে যে অনটন, সেটা উৎসবের আনন্দকে কিছুটা হলেও ম্লান করেছে। রাজনীতি দায়িত্ব নিয়ে দাঁড়াতে পারেনি। বিশেষত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদেশে থাকায় মনে হয়েছে সরকার আসলে অসহায়। কেউ ঠিকমতো ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় পৌঁছুতে পারেনি। সে সুযোগ নিতে পারত মাঠে না থাকা বিএনপি। তারাও তা করেনি। যখন তাদের নাটকের শেষদৃশ্য চলছিল তখন দেখলাম গাড়িবহরে হামলার নাটক। কে কাকে হামলা করল বা কে এর পেছনে সেটা কি আসলে কোনদিন জানা যাবে? যাক বা না যাক আমাদের মানতে হবে এখন ঈদের সময়। যারা অনেককিছু হারিয়েছে তাদের জীবন ভরিয়ে তোলার সময়। যতটা পারা যায় যতটা সম্ভব তাদের পাশে দাঁড়ানো জাতির জন্য জরুরী। এই বাস্তবতায় ঈদ নিয়ে লেখার এই প্রয়াসে বাদ সাধছে বাংলা বানান। ঈদ নিয়ে লেখাও এখন সমস্যা বৈকি। বাংলা একাডেমি সম্প্রতি ঈদ বানানকে ইদ করে দিয়েছে। এতে করে উৎসব বা আনন্দের কমতি পড়বে না জানি, তবে আমাদের মনে দাগ পড়বে বৈকি। আমি ভাষাবিজ্ঞানী নই। ভাষা বিষয়ে ভাসাভাসা জ্ঞান নিয়ে কিছু বলাও অনুচিত। তবে বিস্ময় মানছি কি কারণে শ’ শ’ বছর ধরে আমরা ভুল বানানে ঈদ করলাম? এইসব ইদ বা ঈদের কথা বাদ দিয়ে আসুন আমরা আনন্দ অবগাহনের এই উৎসবে আমাদের অতীত ও বর্তমানকে একটু মিলিয়ে নেই। আমি জন্মেছি বড় হয়েছি মানুষ হওয়ার চেষ্টা করেছি-এর সবকিছুতে যারা আমার পাশে ছিল আছে থাকবে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান। বাঙালী মুসলমান। ঈদের আগের দিন আমাদের বাড়ি-ঘরেও উত্তেজনার ঢেউ এসে লাগত। শুধু নামাজ পড়া আর ঈদগাহে যাওয়া ছাড়া বাকি আনন্দের কোথাও কোন কমতি ছিল না। আমার মা বরাবরই ব্যতিক্রমী মহিলা ছিলেন। তিনি কি বুঝতেন জানি না, তবে ঈদের দিনও স্নান সেরে পোশাক পাল্টে সেমাই পায়েস রান্না করে রাখতেন। আমরা খাব বলে। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি যেসব বন্ধুদের বাড়িতে যাওয়া হতো তারা কেউ ছিলেন কট্টর, কেউ পরিমিত, কেউ বা প্রচলিত আচারে অবিশ্বাসী। অথচ এ নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না কারও। আলাপগুলোও হতো ভিন্ন ধরনের। যেমন কে কোন লেখা পড়েছে, কাদের বাড়ির কোন পদ চমৎকার কিংবা ব্যক্তিগত কোন বিষয়। সে আমলে কি দল ছিল না? ছিল না রাজনীতি? ছিল না আন্তর্জাতিক বা ঘরের মস্তানি? সব ছিল। কিন্তু তা নিয়ে ভেদাভেদ করার পলিটিক্স ছিল না। সময় বদলেছে। এমন এক সময় যখন আমরা বলছি প্রযুক্তি ও গতি নাকি যে কোন সময়ের চাইতে শীর্ষে আছে। তা বটে। মানুষের হাতে হাতে মোবাইল। মুঠোয় দুনিয়া। যার মানে ব্যাপ্ত বেড়েছে। বেড়েছে মানুষের মন ও চোখের সীমানা। কিন্তু এর ফলাফল কি? একদিকে অন্ধত্ব আরেকদিকে হিংসা। আজকের বাংলাদেশে এখন বেশিরভাগ মানুষই ঈদকে সম্প্রদায়গত মানুষের উৎসবের বাইরে কিছু ভাবতে পারে না। এটা তাদের দোষ নয়। সন্তর্পণে তাদের মনে বিষ ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। একবন্ধু দুঃখ প্রকাশ করছিলেন তার বানানো ইফতারি নিয়ে গিয়েছিল অফিসে। সবাই মিলে খাবে বলে। সময় এলে দেখে বেশিরভাগ মানুষ উধাও। পরে সে জেনেছে তার ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে এই ঘটনা। আবার ঈদের ক’দিন আগে সিডনির এক ইফতার মাহফিলে আমাকে বসতে দেয়া হয়েছিল। যিনি দোয়া পড়লেন, যিনি ইমামের কাজ করলেন তাঁর ঠিক পাশের আসনে। এমন এক পরিবেশ আমিই যেন অন্যতম রোজাদার বা ধার্মিক। ফলে আমাদের বুঝতে হবে যে জায়গাটায় ষড়যন্ত্র বা নিজেদের সংকীর্ণ করার কাজ চলছে, সেটা আসলে কাদের হাতে। ঈদের একটা বড় বিষয় সর্বজনীনতা। বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানে নব্বই শতাংশ মানুষ যেহেতু মুসলমান, তাদের উৎসবই হবে জাতীয় উৎসব। আর জাতীয় উৎসব মানে উৎসব যার বা যে ধর্মের হোক না কেন আনন্দ সবার। সে আনন্দে কেউ যেন বাগড়া দিতে না পারে। দুঃখের বিষয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী সরকারী দল এখন ধার্মিক সাজতে চাইছে। তাদের কাছে আনন্দও যেন একতরফা। বাদবাকি রাজনীতি ধর্ম নিয়ে খেলতে খেলতে ক্লান্ত। তবে সাধারণ মানুষের এতে কিছু আটকায় না। ক্রিকেট নিয়ে এত যুদ্ধ, এত পাক প্রীতি, এত ভারত বিরোধিতা অথচ একজন মানুষও লাহোর বা ইসলামাবাদের ঈদ শপিং করতে যায়নি। লাখের ওপর মানুষ ছুটেছে কলকাতা বা ভারতে। আমরা এমন এক ধরনের জাতি যাকে কোন অন্ধ ফ্রেমে বাঁধা যায় না। যারা তা করে তারাই ছিঁটকে পড়ে। আমার কাছে ঈদ মানে আমার বন্ধুদের পবিত্র মুখ। আমার স্বজন ও পরিচিতদের প্রার্থনা, তাদের বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি। সে জায়গাটা এখনও আমার কাছে ভরসার। বাংলাদেশের মানুষ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে। সন্ধ্যায় তারা সবাই মিলে যখন ঈদের আয়োজনগুলো দেখতে থাকে বা ঈদ সংখ্যার লেখাগুলো পড়তে থাকে, তখন কি আসলেই কেউ মনে রাখে, কার কি পরিচয়? সংস্কৃতি আমাদের ধর্মীয় উৎসবেও একযোগে একসূত্রে ধারণ করে। আজ প্রবাসেও বাঙালীর জীবনে এই উৎসব নিয়েছে সবচেয়ে বড় জায়গা। দেশে দেশে আমাদের মানুষেরা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে এই আনন্দে শরিক হয়। ভাবগম্ভীর পরিবেশের পাশাপাশি থাকে বিনোদন। বিদেশের মাটিতে এক টুকরো বাংলাদেশ একফালি ঈদের আনন্দময় বাস্তবতা যেন মৌলবাদের খপ্পরে না পড়ে যেন থাকে উদার। সেই আমাদের শক্তি। শুভ হোক ঈদ উৎসব। ঈদ মোবারক। [email protected]
×