ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

গোলাম সারওয়ার

বাঙালী মুসলমানের ঈদ আনন্দের ইতিকথা

প্রকাশিত: ০৬:৪৭, ২৫ জুন ২০১৭

বাঙালী মুসলমানের ঈদ আনন্দের ইতিকথা

পৃথিবীতে বর্তমানে মানুষ আছে প্রায় সাত শ’ ত্রিশ কোটি আর ধর্ম আছে প্রায় চার হাজার দু’শটি। বিশ্বের মানুষ এসব ধর্ম বিশ্বাস মতে জীবন যাপন করে। কিছু মানুষ অবশ্য এসব কোন ধর্মকেই মানেন না। তারা পালন করেন মানব ধর্ম। মানুষগুলো যে বিশ্বাসেরই হোক না কেন প্রতিটি মানুষ আনন্দ, উল্লাস আর উচ্ছ্বাস পালন করে থাকে। বিভিন্ন ধর্মের আছে বিভিন্ন পর্ব, পার্বণ, উৎসব । ধর্মীয় বিশ্বাসের অনুসারী মানুষের সংখ্যা মোতাবেক পৃথিবীর প্রধান চারটি ধর্ম হলো খ্রীস্টান, ইসলাম, হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্ম । পৃথিবীতে ইসলাম ধর্মের অনুসারী আছেন প্রায় ১৬০ কোটি। সে হিসেবে পৃথিবীতে প্রতি এক শ’ জনে মুসলমান আছেন প্রায় ২২ জন । তারমানে পৃথিবীর অন্তত ১৬০ কোটি মানুষের একটি একক উৎসব হলো মুসলমানদের ঈদ। মুসলমানদের ঈদ হলো দুটি। একটি ঈদ-উল-ফিতর অন্যটি ঈদ-উল-আযহা। একমাস রোজা পালনের পর পহেলা সাওয়াল ঈদ-উল-ফিতর অনুষ্ঠিত হয়। এর দু’মাস দশ দিন পর অনুষ্ঠিত হয় ঈদ-উল-আযহা। সাওয়াল একটি আরবী মাসের নাম। ঈদ শব্দটির অর্থ হলো ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ আনন্দ-উৎসব। ঈদ অর্থ বার বার ফিরে আসাও বুঝায়। ঈদ নামকরণ করা হয়েছে এ কারণে যে, তা প্রতিবছর নতুন সুখ ও আনন্দ নিয়ে আমাদের কাছে ফিরে আসে। নবুয়তের প্রথম দিকে এক সঙ্কটময় মুহূর্তে ইসলামের প্রিয় নবীকে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করতে হয়। সে ঘটনা থেকে আরবীতে হিজরী সন গণনা করা হয়। হিজরী বর্ষপঞ্জি অনুসারে রমজান মাসের শেষে শাওয়াল মাসের তারিখে ঈদ-উল- ফিতর উৎসব পালন করা হয়। হিজরী মাস গণনা করা হয় চাঁদ দেখা সাপেক্ষে। ঈদের আগের রাতটিকে ইসলামী পরিভাষায় বলা হয় লাইলাতুল জায়জাযার অর্থ হলো পুরস্কার রজনী। আমাদের দেশে ঈদের আগের রাতটিকে বলে ‘চাঁদ রাত’। মুসলমানদের জন্য ঈদের পূর্বে পুরো রমজান মাস রোজা রাখা ফরজ হলেও ঈদের দিনে রোজা রাখা নিষিদ্ধ বা হারাম। মুসলমানরা যে ঈদ পালন করে থাকে তা শুরু হয় মূলত মদিনাতে রাসুলের হিজরতের পর। তখন মদিনাতে দুটি উৎসব হতো। একটি নওরোজ এবং অন্যটি মিহিরজান । জাহেলিয়াতের যুগে আরবের পৌত্তলিকরা এসব উৎসবে সীমালঙ্ঘন করত। তারা অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ কাজ এবং আদিম উচ্ছলতায় মেতে উঠত। তার পরিবর্তে ইসলামের প্রিয় নবী মুসলমানদের উপহার দিলেন ঈদ উৎসব। মুসলমানদের ঈদ আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে ইবাদতের আমেজও বহন করে। ঈদের নামাজের পর ধনী-দরিদ্র, উঁচু-নিচু, সাধারণ-অভিজাত সবাই কোলাকুলি করে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়। এ যেন শ্রেণী বৈষম্য-বিবর্জিত, পঙ্কিলতা ও অশালীনতামুক্ত ইবাদতের আমেজমাখা সুনির্মল আনন্দের উৎসব । ঐতিহাসিক বিভিন্ন গ্রন্থ ও সূত্র থেকে জানা যায় মুসলমান সংস্কৃতির সঙ্গে বাঙালী পরিচিত হয়েছিল মুসলমানদের রাজত্ব কায়েম হওয়ার বহু পূর্বে। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতক থেকেই বাংলায় মুসলমানরা আসতে থাকে। পাহাড়পুরের মহাস্থানগড়ে খননকালে খলিফা হারুনর রশিদের আমলের রৌপ্য মুদ্রা (৭৮৮ তে উৎকীর্ণ) পাওয়া যায়। এ থেকে সে সময়কালে বাংলাদেশে মুসলমানদের আগমনের সত্যতা পাওয়া যায়। বাংলাদেশে আরবদের আগমনের ইতিহাস জানা যায় ‘তাযকিরাতুল সোলহা’ নামে এক গ্রন্থ থেকে। শেখউল খিদা নামের এক আরব সুফি সাধক হিজরী ৩৪১ সনে ইংরেজী ৯২১ খ্রিস্টাব্দে ধর্ম প্রচারের মানসে ঢাকায় এসেছিলেন। অনুমান করা হয়, শেখউল খিদা সম্ভবত চন্দ্রবংশীয় রাজা শ্রীচন্দ্রের আমলে (৯০৫-৯৫৫ খ্রি.) বাংলায় আসেন। বাংলায় ইসলাম আগমনের পূর্বে আরও কিছু সুফি সাধক এ অঞ্চলে এসেছিলেন। তাদের মধ্যে শাহ মুহাম্মদ সুলতান রুমি ১০৫০ খ্রিস্টাব্দে নেত্রকোনা অঞ্চলে এবং বাবা আদম শহীদ বিক্রমপুর পরগনার রামপালে আস্তানা গেড়ে ধর্ম প্রচার শুরু করেন। এরা ব্যক্তিগত জীবনে এবং সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে নামাজ, রোজা ও ঈদ পালন করতেন। এভাবে ক্রমে ক্রমে আসা মুসলমান বণিক, ধর্ম সাধক ও ইসলাম প্রচারক গোষ্ঠীর প্রভাবে এ অঞ্চলের মানুষ ইসলাম ধর্মকে গ্রহণ করেন। নতুন ধর্মান্তরিত মুসলমানরাও ক্রমে রোজা, নামাজ ও ধর্মীয় আচার আচরণ পালন করতে শুরু করেন । ১২০৪ সালে বঙ্গদেশ মুসলিম অধিকারে আসার পর থেকে বাংলায় মুসলিম শাসনের শুরু। ১২২৯ সালে দিল্লীর সুলতান ইলত্তুমিশ যখন ক্ষমতায়, সে সময় থেকে পূর্ব বাংলায় নামাজ, রোজা, ঈদ ও অন্য মুসলিম উৎসব ধীরে ধীরে শুরু হতে থাকে। ঢাকা ও আশপাশের এলাকার ঈদ এবং রোজার ইতিহাস পাওয়া যায় ‘বাজাস্তানী গাইবী’গ্রন্থে। বইটি লিখেছেন মির্জা নাথান। মির্জা নাথান ঢাকায় আসেন ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে সুবেদার ইসলাম খাঁর সঙ্গে। আমাদের মনে আছে ইসলাম খাঁ মুঘল শহর ঢাকা প্রতিষ্ঠা করেন ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে। ষোড়শ শতকের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ও সপ্তদশ শতকের কবি ভারত চন্দ্রের কবিতায় মুসলমানদের রোজা পালন সম্পর্কে সুস্পষ্ট দৃষ্টি পাওয়া যায়। মুকুন্দরামের বর্ণনায় শরিয়তী ইসলামের প্রতি প্রগাঢ় নিষ্ঠা পাওয়া যায় তার চণ্ডীমঙ্গলে। যেমন একটি চরণ এমন-‘প্রাণ গেলে রোজা নাহি ছাড়ে’। ভারত চন্দ্রের কবিতায় ধর্মের সঙ্গে ধর্মের মিলনের কথার মাঝে পাওয়া যায় রোজার কথা। যেমন-‘দেবদেবী পূজা বিনা কি হবে রোজায়’- অন্নদামঙ্গল । মুঘল আমলে ঈদের চাঁদ দেখা ছিল এক আনন্দময় ব্যাপার। চাঁদ দেখা যাওয়ার বিষয়টি মানুষকে জানানোর জন্য তোপধ্বনি করা হতো। আর দূর-দূরান্তের মানুষকে চাঁদ দেখা যাওয়ার সংবাদ জানানোর জন্য ভারি কামান দাগা হতো। ঈদের নামাজ আদায়ের জন্য ঈদগাহ নির্মাণের কৃতিত্বও মুঘলদের। ঢাকার ইতিহাস বিশেষজ্ঞ হাকিম হাবীবুর রহমান বলেন, বাংলার সুবাদার শাহ সুজার নির্দেশে তাঁর প্রধান অমাত্য মীর আবুল কাশেম ১৬৪০ সালে ঢাকা শহরের ধানমণ্ডি এলাকায় একটি ঈদগাহ নির্মাণ করেন। এর দৈর্ঘ্য ছিল ২৪৫ ফুট ও প্রস্থ ১৩৭ ফুট। ভূমি থেকে উচ্চতা বারো ফুট। মুঘল যুগে ঈদের দিন যে হইচই বা আনন্দ হতো তা মুঘল ও বনেদি পরিবারের উচ্চপদস্থ এবং ধনাঢ্য মুসলমানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তখন গরিবদের জন্যে ঈদের আনন্দ ছিল না। মানুষ ছিল কৃষিজীবী, অভাবী। ঈদের আনন্দ করার মতো মানসিকতা বা সামর্থ্য তাদের ছিল না। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের যারা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন, তারা ছিলেন নিম্নবর্ণের হিন্দু। শান শওকতের সঙ্গে ঈদোৎসব করার মতো এদের সঙ্গতি ছিল না। তবে ধীরে ধীরে তারা তাদের মতো করে নিজস্ব সংস্কৃতির মিশেলে ঈদের আনন্দে হা-ডু-ডু খেলা, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, লাঠিখেলা, বর্ষাকালে ঈদ হলে নৌকা বাইচ জুড়ে দিয়ে আনন্দ করত । ঢাকায় তিনটি উৎসবে আনন্দ মিছিল হবে এগুলো হলো হিন্দুদের জন্মাষ্টমী মিছিল, শিয়াদের মহররমের তাজিয়াসহ মিছিল এবং ঢাকাবাসীর ঈদ মিছিল। বাংলায় এখন ঈদের অর্থনীতিই সবচেয়ে বড় ব্যাপার। অনেক ব্যবসায়ীর সারাবছরের ব্যবসার প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে রোজার মাস, যা রোজা এবং ঈদকে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশে এখন পনেরো রোজার পর থেকে মার্কেটগুলো জমে উঠে। এর কারণ হলো মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হাতে এখন প্রচুর অর্থ। যে কোন দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণী যখন কোন উৎসবে, পার্বণে অংশগ্রহণ করে তখন সে উৎসব হয়ে উঠে ওই অঞ্চলের প্রাণের উৎসব। আবার টিভি চ্যানেলগুলো সাত দিন যাবত অনুষ্ঠান প্রচার করে। তার মানে বাঙালীরা সংস্কৃতিগতভাবেও ঈদকে আপন করে গ্রহণ করেছেন। ইদানীং একটি কথা প্রায়ই শোনা যায়। ধর্ম যার যার উৎসব সবার। এই মন্ত্রবাণী যদি মধ্যবিত্ত শ্রেণী গ্রহণ করে তবে সামাজিক অসহিষ্ণুতা দূর হয়ে রাষ্ট্রে শান্তি ফিরে আসবে। ঈদ বয়ে আনুক অনাবিল আনন্দ আর স্বস্তিময় বিশ্ব। লেখক : সাংবাদিক [email protected]
×