ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অরুণ কুমার বিশ্বাস

প্রকৃতি যখন প্রতিশোধপ্রবণ!

প্রকাশিত: ০৬:৪৬, ২৫ জুন ২০১৭

প্রকৃতি যখন প্রতিশোধপ্রবণ!

বলা হয়ে থাকে, নেচার নেভার পেজ। অর্থাৎ প্রকৃতির কাছে ক্ষমা নেই। প্রকৃতি যখন যতটুকু আহত হয়, ঠিক ততটুকুই সে ফিরিয়ে দেয়। উদার হস্তে ভাল কিছু নয়, প্রকৃতি বরং বুঝিয়ে দেয় আমাকে কাঁদালে নিস্তার নেই। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। আমি পার্বত্য জেলাগুলোর দুর্ভোগের কথা বলছি। আমি পাহাড়ধসের কথা বলছি। ফিবছর অন্তত পাঁচটি পার্বত্য জেলায় পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। হয়ত এর অভিঘাত প্রতিবছর একরকম নয়। প্রাণহানির সংখ্যা কম-বেশি হয়ে থাকে, কিন্তু প্রতিবারই প্রকৃতি জানান দেয়, সে ফুঁসছে। অথচ আমরা তাকে সমীহের বদলে খেপিয়ে তুলি। প্রকৃতি তাই ক্রমশ প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। যে বসুধা আমাদের আশ্রয় দেবে, সে যেন আমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। বলতে চায়, মানুষ, তোমরা ক্ষমার অযোগ্য। এই ভূমিবক্ষে তোমাদের কোন স্থান নেই। মাত্র কদিন আগে পার্বত্য জেলাসমূহে পাহাড়ধসে দেড় শতাধিক মানুষ মারা গেল। ঘুমের ঘোরে, কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই। তার মানে এই নয় যে, পাহাড়ধসের ঘটনা দেশে এই প্রথম ঘটল। আমরা আশঙ্কা করি এমনটি হতে পারে, অথচ জেগে জেগে ঘুমাই আমরা। যেন অন্ধ হলে প্রলয়ও বন্ধ থাকবে। এসব অঞ্চলে শুধু ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী নয়, বাঙালীও থাকে প্রচুর। বলতে গেলে এখন প্রায় সমানে সমান। কথা সেটি নয়, কথা হলো আর কত প্রাণসংহার হলে আমাদের চেতনা জাগবে! এরাও তো বাংলাদেশের মানুষ, আমাদের নিকটজন, ভাই-ভগ্নি কিংবা সুপ্রিয় স্বজন। এদের প্রাণের কি কোনই মূল্য নেই! পূর্বেই বলেছি, প্রকৃতি এখন ক্ষুব্ধ। তার সইবার মতো ইচ্ছে বা সক্ষমতা কোনটাই আর নেই। পাহাড় কেটে কেটে বসুধার অঙ্গচ্ছেদ করা হচ্ছে, রক্তাক্ত প্রকৃতি তাই এখন সংহারমূর্তি ধারণ করেছে। পাহাড়ে ক্রমশ মানুষের চাপ বাড়ে, অথচ সেই তুলনায় বাড়ছে না আবাসস্থল। যত্রতত্র পাহাড় কেটে সমতল করে সেখানে বসতবাড়ি গড়ে উঠছে। শুধু বসতভিটা তো নয়, সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাটা হচ্ছে বনভূমি, গাছপালা। বাঁশের ঝোপজঙ্গল উজাড় করে বানানো হচ্ছে ঘরের কাঠামো, আসবাবপত্র ইত্যাদি। মৃত্তিকাবিজ্ঞান বলে, মাটির জোর কিন্তু তার গঠন প্রকৃতি আর আটকে রাখার শেকড় বাকড়ে। গাছপালা না থাকলে সেই জোর কোত্থেকে আসবে! প্রসঙ্গত অবৈজ্ঞানিকভাবে জুম চাষের বিষয়টিও এসে যায়। একটু খেয়াল করে দেখবেন, জুম চাষের ফলে মাটির উপরের যে আঠালো অংশ তা আলগা হয়ে যায়। তারপর যখন অঝোরে বৃষ্টি নামে, তখন অবশিষ্ট জোরটুকুও নিমিষে ভেসে যায় পানির তোড়ে। তার মানে জুমিরা কি জমি চাষ করবে না! তাহলে খাবে কী! সেক্ষেত্রে চাষিদের আরও বিচক্ষণ হতে হবে। ভূ-প্রকৃতির মেজাজ-মর্জি বুঝে তারপর বসুধার বুকে আঘাত হানতে হবে। নইলে প্রকৃতি ফুঁসে উঠবে। এর কোন ব্যত্যয় নেই। ‘এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘন ঘোর বরিষায়!’ আহা! রবিঠাকুরের এই মন আনচান করা গান কি পাহাড়িদের কানে মধুবর্ষণ করে আর! বরং আদতে ঘটছে ঠিক তার উল্টো। পাহাড়বাসী যারা, বৃষ্টি এলেই তারা প্রমাদ গুনতে শুরু করে। এই বুঝি সব ধসে গিয়ে চাঙ্গা পড়ি মাটির তলায়। বর্ষা মানেই প্রকৃতির নিষ্করুণ প্রতিশোধ। ওই শোনা যায় অশনি সংকেত! আগে থেকেই আলগা হয়ে যাওয়া বালুমেশানো কমজোরি মাটি বৃষ্টির পানির ছোঁয়া পেলে দ্রুতই দ্রবীভূত হয়। তদুপরি ভারি বৃষ্টি হলে তার ধ্বংসাত্বক অভিঘাত হয় আরো মারাত্মক। ঝুরঝুরে পাহাড়ী মাটিতে বৃষ্টিবাণ যেন তীক্ষèধার বর্শার মতো বিঁধে। সেখানে বসবাসরত আমাদের স্বজনেরা তখন মৃত্যুর প্রহর গোনে। আসলে এর দায় কার! যারা সেখানে থাকছে তাদের, নাকি আমাদেরও কিছু দায়-দায়িত্ব আছে! জটিল প্রশ্ন, সন্দেহ নেই। যখন দুর্ঘটনা ঘটে, এই নিয়ে তখন মিডিয়াপাড়া থেকে শুরু করে টকশো, এমন কি আমজনতারও দুশ্চিন্তার অন্ত থাকে না। কিন্তু দুদিন বাদেই আবার সেই গোল্ডফিশ প্রবৃত্তি ধার করে আমরা সব ভুলে যাই। কিচ্ছু মনে রাখি না। এখানে একটি বিষয় কেউ কেউ অনুমান করেন, পাহাড়বাসীরা হয়ত ঠিক ততটা চিন্তিত নয়, যতটা আমরা তাদেরকে নিয়ে ভাবছি। নইলে এবারে পাহাড়ধসের প্রথমপর্ব সারা হলে তাদের সমতলে নেমে আসার আহ্বান জানিয়েও খুব একটা সাড়া পাওয়া যায়নি কেন! প্রশাসনের তরফে মাইকিংসহ বেশ কিছু ব্যবস্থা নেয়া হলো। কিন্তু পাহাড়ীরা যেন তাদের অবশিষ্ট ভিটেমাটি আঁকড়ে ধরে থাকতেই বেশি আগ্রহী। এর পেছনে হয়ত বড় কোন মনস্তাত্ত্বিক কারণ রয়েছে। হতে পারে, তারা তাদের শেষ ভরসাস্থলটুকু হারাতে চায় না। সোজা কথায়, তারা উদ্বাস্তু হবে না। বস্তুত এখানে পাহাড়ী-বাঙালী ক্যাঁচাল খুঁজে লাভ নেই। আগে পাহাড় বাঁচুক, তারপর দুতরফে ঠেলা-ধাক্কা অনেক সওয়া যাবে। এ-কথা মিথ্যে নয় যে, পাহাড়ের যারা অধিবাসী পাহাড় রক্ষার মূল দায়িত্ব তাদের উপরেই বর্তায়। আপনি যদি ডালের আগায় বসে গোড়া কাটতে চান, তাহলে শুধু পাহাড় কেন সবাই আপনাকে দূর দূর করবে। এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের সুনির্দিষ্ট আইন রয়েছে, কোনো অবস্থাতেই পাহাড় কাটা যাবে না। কিন্তু সে-আইন মানছে কে! মনুষ্যসৃষ্ট আইন না মানলে হয়ত পার পাওয়া যায়, কিন্তু প্রকৃতির আইন লঙ্ঘনের শাস্তি হয় মারাত্মক। পাহাড়ধসের এই গল্প কিন্তু মোটেও নতুন নয়। এর পেছনে সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে। শুরুতে ছিল জবরদখলের প্রতিযোগিতা। আর সাম্প্রতিক সময়ে পাহাড় যখন বিপন্ন, তখন শুরু হয়েছে মুনাফাখোরদের নতুন বাণিজ্য। পাহাড়ধসে মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে যখন খোলা আকাশের নিচে রাতযাপন করছে, তখন কুড়ি টাকার আলু একশ টাকা বেচে মেলা মুনাফা কামাচ্ছে কিছু মানুষরূপী ভ-। প্রশ্ন হলো, সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের এখনে কী করণীয়। তারা শুধু বসে বসে ক্ষতিগ্রস্তদের কান্না শুনবেন, নাকি এদের পুনর্বাসনসহ আর যাতে পাহাড় ধ্বংস না হয় সেই উদ্দেশ্যে বাস্তবানুগ কিছু করবেন! বলতে নেই, পাহাড় কাটার এই আত্মঘাতী মহোৎসব কিন্তু তাদের নাকের ডগায় চোখের সামনেই ঘটেছে। এমন নয় যে চুপিচুপি রাতের অন্ধকারে পাহাড় নিজে থেকে ক্ষয়ে গেছে। বস্তুত, আইন আছে, কিন্তু তার প্রয়োগ নেই। আমরা পাহাড়ী এলাকায় আর কোন লাশের স্তূপ দেখতে চাই না। পার্বত্য অঞ্চলে আরও কিছু অমূল্য প্রাণ ঝরে যাবার আগেই যেন পাহাড়ধসের দৃশ্যমান সুরাহা হয়, এই প্রত্যাশা করি। লেখক : কথাসাহিত্যিক
×