ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সংসদে অর্থমন্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়েছেন সব সিনিয়র সহকর্মী

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ২৩ জুন ২০১৭

সংসদে অর্থমন্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়েছেন সব সিনিয়র সহকর্মী

সংসদ রিপোর্টার ॥ মাত্র দু’দিনেই পাল্টে গেছে জাতীয় সংসদ অধিবেশনের দৃশ্যপট। গত পহেলা জুন বাজেট পেশের পর থেকেই কয়েকটি ইস্যুতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বিরুদ্ধে সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা সমালোচনায় মুখর থাকলেও গত দু’দিনে সেই চিত্র বদলে গেছে। শুরুটা করেছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ; বাজেট আলোচনায় অর্থমন্ত্রীর সমালোচনার জবাবে সরব হয়ে উঠেছেন তার জ্যেষ্ঠ সহকর্মীরা। এর ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু অর্থমন্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে গত কয়েকদিনে অর্থমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সংসদে মন্ত্রী-এমপিদের বক্তব্যের কড়া ভাষায় জবাব দিয়েছেন। এমনকি খোদ বিরোধী দলের সদস্যরাও বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ‘টুঁ’ শব্দটিও বলেননি। প্রথমে স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং পরে ডেপুটি স্পীকার এ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়ার সভাপতিত্বে বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী মুহাঃ ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সরকারী দলের আবদুল মতিন খসরু, জাহিদ আহসান রাসেল, নুরুল মজিদ হুমায়ুন, মোর্শেদ আলম, আখতার জাহান, রহিম উল্লাহ, আবু রেজা মোহাম্মদ নিজামউদ্দিন, আয়েশা ফেরদৌস, বেগম শামসুন্নাহার, ওয়ার্কার্স পার্টির বেগম হাজেরা খাতুন, জাসদের সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, রেজাউল করিম তানসেন ও জাতীয় পার্টির নুরুল ইসলাম ওমর। আলোচনা শেষে সংসদ অধিবেশন আগামী ২৮ জুন বিকেল ৪টা পর্যন্ত মুলতবি করা হয়। বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা ও শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন, ভ্যাট নিয়ে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে। এই বাজেট সর্বসম্মতিক্রমে মন্ত্রিসভায় পাস হয়। তখন কেউ কোন আপত্তি করেননি? প্রস্তাবিত বাজেটে ১ হাজার ৪৩টি পণ্যের ওপর থেকে ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধির অগ্রযাত্রা অক্ষুণœ আছে। সেদিকে সংসদ সদস্যদের কোন নজর নেই। অথচ তারা অর্থমন্ত্রীকে ব্যক্তিগতভাবে কটাক্ষ করে এবং আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিয়েছেন। এটা অত্যন্ত অনভিপ্রেত, দুঃখজনক এবং অনাকাক্সিক্ষত। অর্থমন্ত্রীর সমালোচনাকারীদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটকে কেউ কেউ নির্বাচনী বাজেট হিসেবে সমালোচনা করছেন। কেউ কেউ ইতোমধ্যে বাস্তবায়নের সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন। অথচ উন্নয়ন প্রত্যাশা ঘিরে একটি রাজনৈতিক দলের কর্মকা- হওয়া উচিত। আওয়ামী লীগের জনগণের পালস বোঝার ক্ষমতা রয়েছে। ভ্যাট নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। কিন্তু যখন ভ্যাট আইন পাস হয় তখন কিন্তু সর্বসম্মতভাবে আইনটি পাস করা হয়। তিনি বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য বিভিন্ন সময় যারা ক্ষমতায় ছিলেন বাজেট সমালোচনার মাধ্যমে অর্থমন্ত্রীকে ব্যক্তিগতভাবে কটাক্ষ করে এবং আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিয়েছেন। বাজেটের অনেক খারাপ-ভাল দিক থাকতে পারে। আমরা সেই আলোচনা করছি। আলোচনার মাধ্যমে যেটা ভাল, সেটাই বেরিয়ে আসবে। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনায় বাজেট পরিপূর্ণতা আসবে এটাই নিয়ম। কিন্তু সেই জন্য অপেক্ষা না করে, আজকে যারা আলোচনার-সমালোচনার নামে এমনিভাবে কটাক্ষপূর্ণ, কটূক্তিপূর্ণ কথা বলছেন এটা সত্যিই দুঃখজনক। এ ধরনের কথা বলা ঠিক নয়। স্বৈরাচারী শাসনের ফলে যাদের সৃষ্টি হয়েছে, তাদের চিন্তাধারা সেই ধরনেরই থেকে যায়। আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গ তুলে ধরে শিল্পমন্ত্রী বলেন, আজকে যারা নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলছেন, তারা কারা? এদের পরিচয় কি? এটা আমাদের বুঝতে হবে। এরা তারাই যারা (বিএনপি) এই নির্বাচন প্রক্রিয়াকে সর্বপ্রথম ‘হ্যাঁ-না’ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছিল। হ্যাঁ না ভোটের ব্যবস্থা করেছিল। তারা অবৈধ ক্ষমতাকে বৈধ করার জন্য এক তৃতীয়াংশ আসন নিতে ব্যস্ত ছিলেন। হেফাজতের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক নিয়ে সমালোচনাকারীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, হেফাজতের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক নিয়ে অনেকে কথা বলছেন। বুঝতে হবে প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রধানমন্ত্রী। তার কাছে যে কোন সংগঠনের আবদার আবেদন নিবেদন করার অধিকার রয়েছে। তাই কওমী মাদ্রাসার পক্ষ থেকে তারা যদি এসে কথা বলেন এটা প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই শ্রবণ করবেন এবং সেটা কিভাবে করা যায় বা না যায় এটা তো তাঁর এখতিয়ার। কিন্তু আলোচনায় ক্ষতিটা কোথায় আমরা বুঝতে পারলাম না। এখানে জাত যাওয়ার কি হলো? আজকে যারা সমালোচনা করছেন এই হেফাজত যখন সরকার বিরোধী আন্দোলন করেছিল তখন তো তারা হেফাজত বিরোধী কথা বলেন নাই। হেফাজতের সমালোচনা করেন নাই। যারা ধর্মভিত্তিক দলে বিশ্বাসী বা ধর্মভিত্তিক কর্মকা-ে রয়েছে তাদের যদি ঐক্যবদ্ধ করে জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে একটা অবস্থান নেয়া যায় তাতে ক্ষতি কি? স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বিএনপির ‘সহায়ক সরকার’ দাবি নাকচ করে দিয়ে বলেন, বাংলাদেশ কেন, পৃথিবীর কোন গণতান্ত্রিক দেশেই সহায়ক সরকার বলে কিছু নেই। খালেদা জিয়া গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন না বলেই নির্বাচনে ভয় পান। খালেদা জিয়ার জনগণের প্রতি কোন আস্থা নেই কেন? আপনি যদি সত্যিই জনপ্রিয় হন, আমরা যদি ব্যর্থ হই- তাহলে জনগণ তো আপনাকেই ভোট দেবে। তাই সাহস থাকলে নির্বাচনে আসুন। ভোটের মাঠে নামুন, দেখি জনগণ কার পক্ষে রায় দেয়। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কনসেপ্ট খালেদা জিয়াই ধ্বংস করেছেন। তাই নির্বাচন নিয়ে আর কোন এক্সিপেরিমেন্ট নয়। দেশ চলবে সংবিধান অনুযায়ী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই আগামী নির্বাচন হবে। তিনি বলেন, ৫ জানুয়ারি দেশে নির্বাচন না হলে দেশে মার্শাল ল’ থাকত। তাই গণতন্ত্রের বিকল্প গণতন্ত্র, নির্বাচনের বিকল্প নির্বাচনই। দেশের মানুষ শান্তি, কাজ ও উন্নত জীবন চায়। হরতাল-অবরোধ, সহিংসতা দেখতে চায় না। দেশের জনগণ খালেদা জিয়ার জঙ্গী শাসন, হাওয়া ভবনের শাসন, অন্ধকার যুগের শাসনের সঙ্গে থাকবেন, নাকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন-সমৃদ্ধি-শান্তি ও অগ্রগতির শাসনে থাকবেন- জনগণকেই সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, জনগণ আবারও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষেই রায় দেবে। বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, উনি (মওদুদ) অবৈধভাবে বাড়ি দখল করেছিলেন। তার লজ্জা হওয়া উচিত। আবার নাটক করেন। উনার নাকি খাট নেই। চাইলে খাট পাঠিয়ে দেব। চাইলেই পাঠিয়ে দেব। মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ধারাবাহিকভাবে টানা ৯ বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় রয়েছেন বলেই দেশ আজ সমৃদ্ধি-অগ্রগতির মহাসড়ক দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সারাবিশ্বের সামনে উন্নয়নের নেত্রী হলেন শেখ হাসিনা। তাই দেশবাসীকে অনুরোধ করব- আরও দশ বছর প্রধানমন্ত্রীকে সময় দিন, দেখুন দেশের উন্নয়নের সিঁড়ি কোথায় চলে যায়। স্বাস্থ্যখাতে বাজেটে বরাদ্দ আরও বাড়ানো উচিত মন্তব্য করে তিনি বলেন, বাজেটে যে সকল ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী তা সংশোধন করা হবে। কিন্তু অর্থমন্ত্রীকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বক্তব্য রাখা সত্যিই দুঃখজনক। তবে বাজেটের ওপর সংসদে প্রাণবন্ত আলোচনা হচ্ছে। গালিগালাজ নয়, বিরোধী দল গঠনমূলক সমালোচনা করছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল নিরাপত্তাখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি জানিয়ে বলেন, প্রধানমন্ত্রী নিজে স্বপ্ন দেখেন জাতিকেও স্বপ্ন দেখান। তাঁর কারণেই আজ বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। সারাবিশ্ব যখন জঙ্গী আতঙ্কে কম্পমান, তখন আমরা শক্তহাতে জঙ্গী দমন ও নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছি। তদন্তের মাধ্যমে দেখেছি সকল জঙ্গীবাদের সুতো একখানে। প্রধানমন্ত্রীর ডাকে সারা বাংলাদেশের মানুষ জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে একাত্ম হয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে। অভিভাবকরাই আজ জঙ্গীবাদে জড়িত সন্তানদের নিজেরাই ধরিয়ে দিচ্ছেন। আমরা কখনই জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেই না, দেব না। আগে পুলিশ মানেই ছিল আতঙ্কের নাম, এখন তা হয়েছে নিরাপত্তার নাম। পুলিশ বাহিনীর আমূল পরিবর্তন হয়েছে। বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী মুহা. ইমাজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বঙ্গবন্ধুর খুনী ও একাত্তরের ঘাতকদের অট্টহাসি এখন কোথায়? বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ছিলেন বলেই শত ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও একাত্তরের সেই ঘাতকদের বিচার হয়েছে, অনেককেই ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হয়েছে। গ্রামে মাটির বা খড়ের ঘরগুলো এখন আর নেই, সব ইটের পাকা বাড়ি হয়ে গেছে। সারাদেশের চিত্রই পাল্টে গেছে। আগে আমার এলাকায় কোন পাকা রাস্তা ছিল না, বিদ্যুত ছিল না। আওয়ামী লীগ সরকারের মাত্র ৮ বছরেই এখন পুরো এলাকায় বিদ্যুত গেছে, প্রায় সব রাস্তাই পাকা হয়ে গেছে। সারা দেশের চিত্র একই। তিনিও ব্যাংক আমানতের ওপর থেকে আবগারি শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত স্থগিতের দাবি জানান। সাবেক আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু অর্থমন্ত্রীকে কটাক্ষ করে বক্তব্য প্রদানকারীদের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, তার (অর্থমন্ত্রী) প্রাজ্ঞ, অভিজ্ঞ ও আপাদমস্তক একজন সৎ মানুষকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে যেভাবে কথা বলা হয়েছে তা সত্যিই দুঃখজনক। তিনি বলেন, দেশে অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখলের আর কোন সুযোগ নেই। কেউ করার চেষ্টা করলে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে মৃত্যুদ-ের বিধান সাংবিধানিকভাবেই রয়েছে। জাতীয় পার্টির নুরুল ইসলাম ওমর বলেন, আগে অর্থমন্ত্রী যখন বাজেট ঘোষণা করেন তার ১০ মিনিটের মধ্যে ‘মানি না, মানব না’ ব্যানার নিয়ে মিছিলের রাজনীতি বর্তমান বিরোধী দল করে না। আমরাই একমাত্র বিরোধী দল যে বাজেট নিয়ে অপরাজনীতি বন্ধ করেছি। সংসদেই বাজেটের আলোচনা-সমালোচনা করছি। সরকার ভ্যাটের আওতা বাড়াচ্ছে, কিন্তু প্রত্যক্ষ করের আওতা বাড়াতে পারছে না। বিপুল সংখ্যক বিত্তবান কর ফাঁকি দিচ্ছে, এদের করের আওতায় আনতে হবে। সরকার আগে থেকে সতর্ক হলে ব্যাসিক ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে এভাবে টাকা লুন্ঠন হতো না।
×