ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

দেখা যাক প্রধানমন্ত্রী শেষ পর্যন্ত কী করেন

প্রকাশিত: ০২:৫৮, ২৩ জুন ২০১৭

দেখা যাক প্রধানমন্ত্রী শেষ পর্যন্ত কী করেন

২০১৭-’১৮ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে যে ‘আওলা’ লেগেছে তার শেষটা কী? শেষটা একমাত্র জানেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি তার নিজ দলের সংসদ সদস্যদের বক্তব্য শুনেছেন এবং শুনছেন। বিরোধীদলীয় সদস্যদের বক্তব্যও তিনি শুনছেন। কার আপত্তি কোথায় তা তার ইতোমধ্যে জানা হয়ে গেছে। মূল বিপত্তি এবার আবগারি শুল্ক নিয়ে। মানুষ এই শুল্কটি দিয়ে আসছে আগে থেকেই। গোল বেধেছে আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি করাতে। এই বৃদ্ধির ফলে সরকার যে বিপুল রাজস্বের মালিক হবে তাও নয়। তবু দেখা যাচ্ছে সংসদের বাইরে ও ভেতরে এই আবগারি শুল্ক নিয়েই যত কথাবার্তা। এর সুরাহা শেষ পর্যন্ত কী হবে তা একমাত্র সংসদ নেতৃত্বই জানেন। মনে হয় বাজেট আলোচনায় কোন দলীয় ‘হুইপ’ নেই। থাকলে এত আলোচনা-সমালোচনা হতে পারত না। এতেই অনেকের প্রত্যাশা প্রধানমন্ত্রী হয়ত শেষ পর্যায়ে এই বিতর্কের একটা ইতিবাচক উপসংহার টানতে পারেন। কিন্তু এতে কী মূল সমস্যার সমাধান হয়ে থাকে? মূল সমস্যাটা কী? বাজেটের আগে মূল আলোচনা ছিল ‘ভ্যাট’ নিয়ে। ‘ভ্যাট’ চালু হোক, কিন্তু সব কিছুতেই ১৫ শতাংশ ‘ভ্যাট’ এটা মানতে রাজি ছিলেন না ব্যবসায়ীরা। তাদের কথা এতে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। বড় মজার কথা। ব্যবসায়ীরা বলছে ভ্যাটের কারণে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। যারা সুযোগ পেলেই জিনিসের দাম বাড়ান তারা বলছেন ভ্যাটের কারণে জিনিসের দাম বাড়বে এবং এই যুক্তিতে তারা আন্দোলনেরও হুমকি দেন। ‘কম্পমান’ অর্থমন্ত্রী দফায় দফায় তাদের সঙ্গে বসেন। সমাধানের কথা বলেন। কী কী করা হবে তার কথা বলেন। আবার বাজেটেও ছোট-মাঝারি ব্যবসায়ীদের কিছুটা রেয়াত দিয়েছেন। ব্যবসায়ীদের মধ্যে শক্তিশালী গ্রুপ গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের আয়করের হার হ্রাস করেন। মনে হয় এতে কাজ হয়েছে। বাইরে ভ্যাটের বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীদের বড় রকমের কোন ‘নড়াচড়া’ নেই। রাস্তায় তারা নেই। বিবৃতিতেও নরম। মনে কী আছে অবশ্য তা আমি জানি না। তবে তাদেরই প্রতিনিধি আছেন সংসদে, সব সরকারেই থাকে। তারা কথা বলছেন বিভিন্ন ইস্যুতে। বলছেন বাজেটের বাইরের অনেক কথা। শেয়ার বাজার হচ্ছে না। ব্যাংকের অবস্থা খারাপ। আমানতের ওপর সুদের হার কম। ঋণখেলাপীদের বিচার হচ্ছে না। ইত্যাদি ইত্যাদি। কড়া, কড়া কথা সব। অর্থমন্ত্রীকে তারা দারুণ চাপের মধ্যে রেখেছেন। ইতোমধ্যেই লক্ষ্য করছি ২০১৭-’১৮ অর্থবছরের বাজেটের মূল বিষয়ের ওপর আলোচনা কম, নেই বললেই চলে। মূল বিষয়গুলো কী? বাজেটের আর্থিক কাঠামো কী, বাজেটের রাজস্ব কার কাছ থেকে সংগ্রহ করা হবে, বাজেটের টাকা কোথায় কোথায় খরচ করা হবে, খরচের অগ্রাধিকার ঠিক আছে কিনা, এক টাকার কাজ দুই টাকায় করা হচ্ছে কিনা, খরচের গুণগত মান কী, যে সমস্ত টার্গেট নির্ধারিত করা হয়েছে তা বাস্তবায়ন করা যাবে কিনা, অধিকতর রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা কী, এত খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরও চালের দাম বাড়ল কেনÑ এসব প্রশ্নের ওপর আলোচনা নেই। যে উন্নতি-অগ্রগতি হচ্ছে তার ফসল সবাই পাচ্ছে কিনা, ‘ইনক্লুসিভ গ্রোথ’ হচ্ছে কিনা, কর্মসংস্থান বাড়ছে কিনা, আমানতের ওপর সুদের হার হ্রাসের ফলাফল কী হতে পারে, সরকারের ঋণ করা উচিত কিনা, করলে কত করা উচিত, কোত্থেকে করা উচিত, বিদেশী ঋণ কত নেয়া উচিত, সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট নেয়া উচিত কিনাÑ এসব কারও আলোচনায় নেই। কীভাবে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা যায়, কীভাবে রেমিটেন্স হ্রাস রোধ করা যায়, কীভাবে মুদ্রা নিবৃত্তির ব্যবস্থা করা যায়Ñ এসবের ওপরও আলোচনা দেখছি না। বড় বাজেট, বাজেটের বাস্তবায়নযোগ্যতা এসব আলোচনা অনেক হয়েছে। যে আলোচনা দরকার তা হচ্ছে রাজস্ব। কীভাবে রাজস্ব বাড়ানো যায়। কীভাবে ধনীদের ট্যাক্সের আওতায় আনা যায় এই আলোচনা দরকার। একজন জর্দা ব্যবসায়ী দেশের সেরা করদাতা হবে এটা কী আমাদের জন্য সুখবর? হাজার কোটি টাকার ব্যবসায়ী সম্পদ কর দেবে নাÑ এটা কী ভাল খবর? এটা কী সুখপ্রদ খবর যে একজন নাগরিক যার বার্ষিক আয় আড়াই লাখ টাকা নয় তিনিও অগ্রিম আয়কর দেবেন? এসব কী বিতর্কের মধ্যে থাকবে না? ধরা যাক এখন শুধু উন্নয়নই হবে, কে কর দিল, কত দিল তা কোন প্রশ্ন নয়। এটাও তো আলোচনা হওয়া দরকার। পরোক্ষ করের আওতা এবং পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। বলা হচ্ছে এটাই কী নীতি। বিদেশে নাকি তাই হয়েছে এবং হচ্ছে। তা হলেও এটা সংসদে আলোচনা হওয়া দরকার নয় কী? সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানো দরকার। এটাও তো বিতর্কের বিষয় হতে পারে। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর আলোচনা সংসদে পাচ্ছি না। অথচ আমরা আলোকিত হতে চাই। জনগণের প্রতিনিধিরা যুক্তি দেবেন, তর্ক করবেন আমরা বাইরে থেকে শুনব, জানব। সাধারণ মানুষের দুঃখ কী, তারা কী চান, এটা তো সংসদ সদস্যরাই ভাল জানেন। তারা কথা বললে আমরা তার ওপর লিখতে পারি। বোরো ধান করতে করতে আমরা একটা জায়গায় এসেছি। এতে প্রচুর সেচের জল লাগে। অথচ এই সেচের জল পাওয়া যাবে না। এটা ভীষণ ব্যয়বহুল। নতুন জাত আবিষ্কারও সেভাবে হচ্ছে না। কৃষকরা ফসলের দাম চায়। বিভিন্ন বিকল্প ফসল তাদের এখন আছে। এমতাবস্থায় চালের দাম কত হওয়া উচিত, সবজির দাম কত হওয়া উচিত, মাছ-মাংস, দুধের দাম কত হওয়া উচিত এসবের ওপর কী আলোচনা হবে না। ‘ব্র্যাক’, ‘আশায়’ চাকরিচ্যুত ঘটছে। ব্যাংকে ব্যাংকে চাকরিচ্যুতি হচ্ছে। এর পরিণাম কীÑ এই বিষয়ের ওপর কী আলোচনা হতে পারে না। প্রাথমিক শিক্ষা আগে, না, অবকাঠামো আগে, স্বাস্থ্যসেবা আগে, না, সরকারী কর্মচারীদের দ্বিগুণ বেতন বৃদ্ধি আগেÑ এসবের ওপর কী আলোচনা করা অন্যায়? বুঝি না এ বিষয়গুলো বাজেট আলোচনায় আসবে না কেন? আলোচনায় নিশ্চয়ই আসবে ‘ভ্যাট’। ‘ভ্যাট’ কোথায় কোথায় বসানো হয়েছে, তা কতটুকু যুক্তিযুক্ত, কোন্ কোন্ ভ্যাট প্রস্তাব প্রত্যাহারযোগ্য এবং তা কেনÑ এই আলোচনা করতে বাধা কোথায়? এখন দেখছি মিডিয়া খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ইস্যু তৈরি করে দিচ্ছে। হাজার হাজার পণ্য। এই তালিকা সবার হাতে নেই। কোন্ পণ্যকে ‘ভ্যাট’ মুক্ত করা হয়েছে, কোন্টাকে করা হয়নি তা রীতিমতো ‘স্টাডি’ করার বিষয়। কে করবে? মাননীয় সাংসদদের কী এসব ‘স্টাডি’ করার ব্যবস্থা বা সুযোগ আছে? মন্ত্রী মহোদয়দের কী আছে? আমার জানা নেই। না থাকলে তার ব্যবস্থা থাকা দরকার। এসবের অনুপস্থিতিতে বাজেট হয়ে পড়ছে আমলাদের ‘কাম’। এটা আমলারাই করবেন। কিন্তু রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা দেবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব। এবারের বাজেট দেখে কেন জানি আমার মনে হয় অনেক প্রস্তাব এমনভাবে করা হয়েছে যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর চিন্তার সঙ্গে মেলে না। যেমন ট্রাক্টর, রাইস রিপার, হার্ভেস্টার ইত্যাদিতে ভ্যাট বসানো হয়েছে। অথচ প্রধানমন্ত্রী চাইছেন কৃষির যান্ত্রিকীকরণ অন্তত এটাই জানা যায়। কিন্তু বাজেটে তার প্রতিফলন পাচ্ছি না। আমার ধারণা, এমন অনেক বিষয় আছে যার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীও চূড়ান্ত বিচারে একমত হতে পারছেন না। যেমন গুলশান, বনানীর বাড়ির মালিক সম্পদ কর দেন না, অথচ একজন চাকরিজীবী দেন। এটা তিনি কী করে মেনে নেবেন? যেমন এক ব্যক্তির বার্ষিক আয় করমুক্ত সীমার নিচে। তার কাছ থেকে অগ্রিম আয়কর কাটা হয়। এটা কী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জানেন? বলাবাহুল্য বাজেটের বিস্তারিত প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তার এত সময় কোথায়? তিনি মূল জিনিস জানেন। এই ফাঁকে কেউ কী এমন জিনিস করিয়ে নিচ্ছে নির্বাচনের আগে, যাতে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। লেখক : সাবেক অধ্যাপক, ঢাবি
×