ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

এক তরুণ স্থপতির গল্প

প্রকাশিত: ০৭:২৩, ২০ জুন ২০১৭

এক তরুণ স্থপতির গল্প

একটি সার্থক জীবনের প্রথম সোপান হতে পারে একটি স্বপ্ন- যে স্বপ্ন আশার পথ দেখায়, সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দেয়। আমাদের তরুণ প্রজন্ম স্বপ্ন দেখে বাংলাদেশকে নিয়ে। তাই এগিয়ে যাচ্ছে তারুণ্য। তেমনি এক স্বপ্নবাজ তরুণ রজন দাশ। প্রচার বিমুখ এই তরুণ তার স্থাপত্য কর্মের মাধ্যমে একের পর এক কাজ করে যাচ্ছেন। তার স্থাপত্য কর্ম ইতোমধ্যে বেশ সুনাম অর্জন করেছে। তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ সালে অর্জন করেছেন ও ঈঊ-ঞঙউঅঞ- অছটঅ চঅওঘঞ ওঘঞঊজওঙজ উঊঝওএঘ অডঅজউ তার করা কাজের মধ্যে সিলেটের মদন মোহন কলেজ প্রাঙ্গণে করা ভিন্ন আঙ্গিকের শহীদ মিনার, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মিত শহীদ মিনার ‘সূর্যালোকে বর্ণমালা, সিলেট সরকারী কলেজ প্রাঙ্গণে নির্মিত স্মৃতিসৌধ- ‘আশ্রয়’, সুনামগঞ্জ জেলার উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে ভারত-সীমান্ত লাগোয়া ধর্মপাশা উপজেলায় মহিষখোলা গ্রাম নির্মিত শহীদ মিনার ‘সব ক’টা জানালা খুলে দাও না’, শ্রীমঙ্গলের কুটুমবাড়ি রেস্তরাটি বেশ প্রশংসা অর্জন করেছে। রাজন দাশের জন্ম সুনামগঞ্জ জেলার ধনপুর গ্রামে। মা অনিমা দাস আর দীপক রঞ্জন দাশের অনুপ্রেরণায় গড়ে ওঠা। ছোটবেলা পার করেছেন সিলেট শহরের রামেরদীঘির পারে। বাবার কর্মক্ষেত্রের সুবাদে সিলেট শহরে বেড়ে ওঠা। স্কুল জীবনে পড়ালেখা করেছেন সিলেট সরকারী পাইলট বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে, কলেজ জীবন পারি দিয়েছেন মুরারী চাঁদ কলেজ সিলেটে। আর স্নাতক সম্পন্ন করেন স্থাপত্য বিভাগ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তার ভিন্নধর্মী কাজ সবাইকে আকৃষ্ট করে। রাজন দাশের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেনÑ আমি মূলত কোন বিল্ডিং ডিজাইনে ইটকে বেশি গুরুত্ব দিতে চেষ্টা করি। অর্থাৎ কোন ভবনের বহিরাঙ্গে ও অন্তর অঙ্গে পলেস্তারাবিহীন ইট গাঁথুনি ব্যবহার করি। ছাত্রাবস্থায় আর্কিটেক্ট ল্যুই আই কানের একটা কথা আমার কানে লেগে গিয়েছিল- ঊাবহ ধ নৎরপশ ধিহঃং ঃড় নব ংড়সবঃযরহমৃ’। অস্তিত্বশীল প্রত্যেক বস্তুই তার ভেতরে একটা সত্তাকে ধারণ করে এবং সে সত্তা বস্তুটির পার্থিব বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এক বা একাধিক ইচ্ছাকে লালন করে। যেমন একটা কলসি-সে সর্বদা পানি দ্বারা পূর্ণ হতে চায়। সে চায় তার থেকে কেউ যেন জল ঢেলে খায়, আবার খালি হলে নদী, পুকুর বা কলতলা থেকে তাকে ভরাট করে নিয়ে আসে। মানুষের তৃষ্ণা নিবারণের আশ্রয় হতে চায় সে। আসলে আমাদেরই পূর্বপুরুষ যে শিল্পী প্রথম ‘কলসি’ নির্মাণ করেছিলেন তিনিই তার মধ্যে এসব চাওয়া-পাওয়ার আকাক্সক্ষা ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন হয়ত। এভাবে আমরাই আমাদের ইচ্ছাকে আরোপ করে রেখেছি সর্বত্র। হাতের ইচ্ছা ‘হাতা’য়, পায়ের ইচ্ছা ‘পায়া’য় আরোপ করেছি। আমাদের লেখার ইচ্ছা, কলমেরও ইচ্ছা। আমাদের ফুঁ দিয়ে সুর তোলার ইচ্ছা, বাঁশিরও ইচ্ছা। যে বাঁশিতে কেউ কোনদিন ঠোঁট লাগায়নি, সে তো বাঁশি নয়, হলেও ব্যর্থ বাঁশি। কেউ তো ব্যর্থ হতে চায় না। বাঁশি তখনই ‘বাঁশি’ হয়ে উঠে যখন সে ‘বাঁশি’ হতে চায়। মানুষ তখনই মানুষ , যখন সে ‘মানুষ’ হতে চায়। একইভাবে ‘ইট’, সেও তো কিছু একটা হতে চায়। আমার কাছে পরিসর নির্মাণের ক্ষেত্রে আমাদের আবহমান লোক-স্থাপত্য, লোক-সাহিত্য, মিথলজি পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে। নকশায় আমাদের লোকজ পরিসরের ধারাবাহিকতা আনার চেষ্টা করছি। সিলেটের জলবায়ু, ভূ-প্রকৃতি, ভাষা, সংস্কৃতি, লোকাচরণ ইত্যাদি বিষয় মাথায় রেখে কাজ করছি। আমি কাজের ক্ষেত্রে এ অঞ্চলে সহজলভ্য, সুলভ নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করি। ফেশোনেবল চকচকে আমদানিনির্ভর নির্মাণ উপকরণ পরিত্যাজ্য মনে করি। একটি ১২০ বছরের পুরনো দালান (সিলেটের বিখ্যাত জিতু মিয়ার বাড়ি) সংরক্ষণের কাজ করতে গিয়ে আমাদের পুরনো দিনের নির্মাণকৌশল কিছুটা শিখেছি এবং চুন-সুরকির রসায়নে সিক্ত হয়েছি। ‘সূর্যালোকে বর্ণমালা’ শহীদ মিনারটি সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকের পাড়ে ছোট্ট টিলার ওপরে নির্মিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রবেশদ্বার অতিক্রম করলেই দূর থেকে টিলার উপরস্থিত শহীদ মিনারটি চোখে পড়ে। টিলার পাদদেশে পৌঁছালে মিনারের শিরভাগ দর্শনার্থীকে আকর্ষণ করবে এবং সেখান থেকেই সিঁড়িপথের যাত্রা শুরু। অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙ্গে ক্রমশ এগোলে মিনারটি পূর্ণাবয়ব পেতে শুরু করবে। শহীদ মিনারের দেয়ালগুলোর মধ্যকার অল্পস্বল্প ফাঁকটটুকু আমাদের মাতৃভাষার বর্ণমালায় ভরে আছে। বর্ণমালায় কোন বর্ণ বড়, কোন বর্ণ ছোট। দেখে মনে হবে শিরদাঁড়া টান করে দাঁড়ানো উর্ধমুখী দেয়ালগুলো যেন প্রতিবাদমুখর। আর তারা যুথবদ্ধ হয়েছে বর্ণমালার একতার ঐকতানে। মিনারটি উত্তর পশ্চিমমুখী আর বর্গাকৃতি চত্বরের উত্তর দক্ষিণে পাঁচ ফুট উচ্চতার পাঁচিলে বর্ণমালা খচিত রয়েছে। চত্বরে দাঁড়ালে মনে হবে চারদিকে বর্ণমালার ব্যঞ্জনা, যেন ‘ক-খ-গ-ঘ-র’ উঠানে দাঁড়িয়ে আছি। যেদিকে চোখ পড়বে হয় বর্ণমালা, নয়ত আকাশ। আমাদের হাজার বছরের বাংলা ভাষার সঙ্গে প্রাচীনতম সূর্যের এক অনির্বচনীয় কথোপকথন চলবে প্রতিদিন। তাই এই মিনারের শিরোনাম ‘সূর্যালোকে বর্ণমালা’। সিলেট সরকারী কলেজ প্রাঙ্গণে নির্মিত স্মৃতিসৌধ-‘আশ্রয়’ এই স্মৃতিসৌধটি সাতটি খড় বিছানো হেলানোতলকে পাশাপাশি বিন্যস্ত করে এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যাতে সবগুলোকে একত্রে দেখলে একটি কুঁড়েঘর মনে হয়। প্রতিটা হেলানো তল এক একজন বীর শহীদের মৃত্যুচিহ্ন (বঢ়রঃধঢ়য)। এরাই বাংলা মায়ের বুক-খালি-করা দামাল ছেলের দল। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই যে পল্লীমায়ের সন্তান তা বলাইবাহুল্য। তারা সেদিন কুঁড়েঘরের আশ্রয় ছেড়ে জীবনের বিনিময়ে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল আমাদের। ৭১-এ ওদের এনে দেয়া স্বাধীনতাই আজ আমাদের একমাত্র আশ্রয়। এই সৌধটি মাটির দিকে ঝুঁকে আছে। উচ্চতা খুব বেশি নয়। ফুট পনেরোর মতো। এর সামনে দাঁড়ালে মনে হবে আমাদের পাড়াগাঁয়ের কোন ভিটের সামনের উঠোনে দাঁড়িয়ে আছি। মনে হবে এই বুঝি সাত-রাজার-ধন মানিকেরা বেরিয়ে আসবে। ইচ্ছে হবে ‘মা’ বলে ডাক দেই। একলা এর সম্মুখে দাঁড়ালে খালি বাড়ির শূন্যতা আপনাকে ঘিরে ধরবে। মনে হবে কারা যেন নেই, যাদের হয়তো এখানেই থাকার কথা ছিল। ‘সব ক’টা জানালা খুলে দাও না’ সুনামগঞ্জ জেলার উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে ভারত-সীমান্ত লাগোয়া ধর্মপাশা উপজেলায় মহিষখোলা গ্রাম। মহিষখোলা নদীর পূর্বপাড় ঘেঁষে একখানা প্রায় নিশ্চিহ্ন টিনের ঘর। সেই ঘরে ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধের ফাঁকে ফাঁকে বিশ্রাম নিতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ অঞ্চলটি ছিল ১১নং সেক্টরের ১ নম্বর সাবসেক্টর। যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে পাক বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের এক ভয়াল সংঘর্ষ হয়। অনেক যোদ্ধা মারা যান। মহিষখোলা নদীর পাড়ঘেঁষা বাড়িটি ধ্বংস হয়ে যায় তখনই, শহীদ যোদ্ধাদের গণকবর রচিত হয় তারই এদিক-ওদিক। পূর্ব-পশ্চিম বরাবর সমান্তরাল দুটি সুউচ্চ দেয়াল ‘ন’ ফুট বেদীর ওপর এসে দাঁড়ায়, তার উপর ছায়া হয়ে ছাদ এসে বসে। সিড়ি ভেঙ্গে পূর্বদিকের প্রবেশ বিন্দুতে চোখ রাখলে পশ্চিমের নদী আর তার গায়ে-এসে-পড়া আকাশ দেখা যায়। পূর্ব-পশ্চিম হওয়ায় দুই দেয়ালের ঘর রচিত হয়ে যায়। ‘যারা এই দেশটাকে ভালবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ’, তারা তো বদ্ধ ঘরে থাকে না, যে ঘরে দরজা-জানালায় অর্গল টানা, যে ঘরে আলোর ঝলক নেই, দোলা নেই, সে ঘরে স্বাধীনতা প্রবেশ করে না। সেই ঘর অন্ধকারের অধীন। তাই ‘সব কয়টা জানালা’ই খুলে আছে। বেদীর তিন দিক ঘিরে রয়েছে পানির আধার যা পশ্চিমে নদীর সঙ্গে সংযুক্ত। প্রতি বর্ষাতেই মেঘালয়ের পাহাড়ী ঢল নামলে নদী উপচে বেদীর তলায় কিছুক্ষণের জন্য হাঁটু জল জমে যায়। এটা হাওড় অঞ্চেলের চেনা দৃশ্য। এভাবেই হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে ‘সব ক’টা জানালা’ খুলে আমাদের ডাকছে ওরা, যারা এই দেশটাকে ভালবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ’।
×