ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পপি দেবী থাপা

মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কটের কেন্দ্রে কাতার

প্রকাশিত: ০৬:৩৯, ২০ জুন ২০১৭

মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কটের কেন্দ্রে কাতার

বিশ্বের সবচেয়ে ধনী এবং সম্পদশালী রাষ্ট্র কাতার। যার রফতানি আয়ের ৮৫ শতাংশ আসে পেট্রোলিয়াম থেকে, রয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাসও। গত ২৩ মে দেশটির আমির শেখ তামিম বিন হামাস আল থানির বক্তব্যকে কেন্দ্র করে গত ৫ জুন এ যাবতকালের সবচেয়ে ভয়ানক রাজনৈতিক সঙ্কটে পড়েছে দেশটি। তার বক্তব্যে তিনি সমালোচনা করেন যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের। ইরানকে সহায়তা প্রদান ছাড়াও ইরানের প্রতি আরব দেশগুলোর পক্ষপাতমূলক আচরণের বিরোধিতাও করেন। এ ছাড়া সমর্থন ব্যক্ত করেন হামাস ও মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি। ২০ মে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সৌদি সফরে পাওয়া সবুজ সঙ্কেত এবং কাতারের আমিরের এই বক্তব্য। প্রথমে বাহরাইন, পরে সৌদি আরব এবং মিসর, ইয়েমেন, ইউএই, লিবিয়া ও মালদ্বীপ কাতারের সঙ্গে সব রকম সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা দেয়। এমনকি প্রতিবেশী ৩টি দেশ এটাও জানিয়ে দেয় ১৪ দিনের মধ্যে কাতারের নাগরিকদের ওই সব দেশ ত্যাগ করতে হবে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো যেন এত দিন এ সুযোগের অপেক্ষায়ই ছিল। বিপরীতে দোহা দ্বন্দের রেশ না বাড়ানোর জন্য কূটনেতিক সম্পর্ক ছিন্নকারী দেশগুলোর নাগরিকদের কাতার ছাড়তে হবে না বলে জানায়। সৌদির আরবের সঙ্গে কাতারের সম্পর্কের এ টানাপোড়েন আগে থেকেই। কাতার মনে করে চরমপন্থী সংগঠনের জনসমর্থন অর্জনের যে অধিকার রয়েছে তারা সেটা ভোগ করুক। কিন্তু সৌদির আপত্তি সেখানেই। তাই ২০১৪ সাল থেকেই কাতারকে বিরত রাখার চেষ্টা করে তারা। জিসিসি সনদসহ বিভিন্ন বিষয়ে দেশটিকে পিছিয়ে রাখার জন্য ২০০২ থেকে ২০০৮ অবধি একের পর এক চাপ প্রয়োগ করে। প্রত্যাহার করে নেয় রাষ্ট্রদূত। অবশ্য ৯ মাস পরেই এ দ্বন্দের অবসান ঘটে। এ ছাড়া ২০১৫ সালে কাতার রাজ পরিবারের ২৬ জনকে আল কায়েদা জিম্মি করলে ১ বিলিয়ন ডলার খরচ করে তাদের ছাড়ানো হয়। আর এ ঘটনাকে সৌদিসহ অন্যান্য আরব দেশ সন্ত্রাসকে পরোক্ষ মদদ দেয়ার শামিল বলেই মনে করে। ওদিকে হামাস সম্প্রতি তাদের নতুন সনদ ঘোষণা করে দোহারের শেরাটন হোটেলের বলরুমে যা থেকে কাতারের সঙ্গে হামাসের সম্পর্কের মজবুত ভিত এবং সংগঠনের নেতাদের আশ্রয় দেয়ার বিষয়টি প্রকাশ পায়। চাপের মুখে পড়েও কাতার এখনও হামাসের কোন নেতাকে দেশ ছাড়তে বলেনি। এ বিষয়ে কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন ‘আমরা হামাসকে নয় ফিলিস্তিনী জনগণকে সমর্থন করি। ফিলিস্তিন সঙ্কট নিরসনের লক্ষ্যেই হামাস নেতাদের কাতারে আশ্রয় দেয়া হয়।’ আসলে আরব বিশ্বে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতেই সৌদি আরব এমন পদক্ষেপ নিয়েছে। বর্তমানে কাতার ও ইরানের মধ্যে সুসম্পর্ক রয়েছে। উপসাগরীয় অঞ্চলে গভীর সমুদ্রে দেশ দুটির মধ্যে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র। সৌদি আরব দোহা ও তেহরানের এ সম্পর্কে অনেকটাই নাখোশ। কাতার কয়েক বছর থেকেই সবচেয়ে ধনী দেশ এবং বিশ্ব বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু। সৌদি আরব নিজের দেশে বাণিজ্যিক নগরী করার সিদ্ধান্ত নিলেও সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতারের কারণে তা যেন সম্ভব হয়ে উঠছে না। আর ইরান বর্তমানে শিল্প, সংস্কৃতি, অর্থ, বাণিজ্য, সব দিক থেকেই বিশ্বে তাদের প্রভাব বৃদ্ধি করে চলেছে যা হয়ে উঠেছে সৌদি আরবের চক্ষুশূল। তাই দোহা-তেহরান জোট ভেঙ্গে দিয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব বহাল রাখতে চায় তারা। সৌদি ক্ষোভের আর এক কারণ হচ্ছে কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল আল জাজিরার সৌদি রাজ পরিবার নিয়ে কটাক্ষপূর্ণ খবর প্রচার। এ ছাড়াও ফিলিস্তিনে ইসরাইল দখলদার বাহিনীর অপকর্মের কথা, মিসরের স্বৈরাচারী মুবারকসহ অন্য আরব শাসকদের মুখোশ উন্মোচন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন আরব বসন্তের খবর প্রচার। যা সৌদি রাজ পরিবারের ক্ষমতার আসন কাঁপিয়ে দিয়েছে। তাদের খবর প্রচার নিয়ে হোয়াইট হাউসেরও ক্ষোভ রয়েছে। তাই কণ্ঠ রোধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে আল জাজিরার। সেই সঙ্গে দেশটির মূল বাণিজ্য বিমান ব্যবসাও ভেঙ্গে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতিদিন বাতিল হচ্ছে কয়েক ডজন ফ্লাইট। প্রতিবেশীদের আকাশপথ পরিহার করতে হচ্ছে বিধায় বেড়েছে গমন পথ। শুধু তাই নয় কাতারের ২৫ লাখ অধিবাসীর বেশিরভাগই প্রবাসী শ্রমিক। এই নিষেধাজ্ঞার কারণে বিপদে পরেছে তারাও। যার প্রভাব পরবে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপিন্স ইত্যাদি দেশের ওপর। বিঘিœত হতে পারে ২০২২ সালে ফুটবল বিশ্বকাপকে ঘিরে উন্নয়নের কাজগুলো। কাতারের এই পরিস্থিতি হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজা ভূখ-কে সঙ্কটে ফেলবে নিঃসন্দেহে। বন্ধ হয়ে যাবে আর্থিক সহযোগিতা, আর শত কোটি ডলারের নির্মাণাধীন প্রকল্পগুলো। আরব দেশগুলোর এই বিভক্তি সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে ফিলিস্তিনীকে। পিছিয়ে পড়বে তাদের আকাক্সক্ষার স্বাধীনতার বাস্তবায়ন। মাত্র কয়েকটা দিন পেছনে গেলে বিষয়টা বোঝা একটু সহজ হবে। গত ২০ মে ২০১৭ তারিখে ডোনাল্ড ট্রাম্প সৌদি আরব সফর করেন। তিনি তার ভাষণে গোষ্ঠীগত দাঙ্গা উসকে দেয়ার জন্য অইএসের পরিবর্তে ইরানকে দায়ী করে সৌদি-ইরান দ্বন্দ্বটাকেই উস্কে দিয়ে যেন ছাই চাপা আগুনে ফুঁ দিলেন। একজন সফল বাণিজ্যিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিশ্ব রাজনীতির সর্বোচ্চ শিখরে বসেও ব্যবসায়িক চাল চাললেন তিনি। এক মুখে কাতারের উদ্দেশে তিনি বলছেন ‘মানুষকে অন্যদের হত্যা করতে শেখানো বন্ধ করুন... আমরা আপনাদের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ অবস্থায় দেখতে চাই।’ অথচ সেই তিনিই সৌদি আরবের সঙ্গে ১১ হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র চুক্তি করলেন এবং তা কাতারের সামরিক সরঞ্জাম কেনার প্রস্তাবের পর। এ সম্পর্ক চির ধরার পেছনে তার ক্রেডিট রয়েছে এটা তিনি সগৌরবে শিকার করছেন। অর্থাৎ চোরকে বলছেন চুরি করতে আর গৃহস্থকে বলছেন সজাগ থাকতে। কিন্তু মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন কাতারের ওপর বিধিনিষেধ শিথিল করতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। তা ছাড়া তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান শুরু থেকেই কাতারের ওপর থেকে সব ধরনের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার পক্ষে কথা বলে আসছেন। শুধু তাই নয় সেনাঘাঁটি স্থাপনের কথাও বলেছে তুরস্ক। কাতারের পক্ষে বরাবরই রয়েছে ইরান। এরই মধ্যে ফলমূল ও শাক-সবজি ভর্তি বেশ কয়েকটি কার্গো বিমান পাঠিয়েছে ইরান। কাতার ব্যবহার করছে ইরানের বিমান পথ। জাতিসংঘ কাতারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের কথা বলেন। কুয়েত মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে। জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিগমার গ্যাব্রিয়েল কাতারের ওপর থেকে সামুদ্রিক ও আকাশ পথের অবরোধ প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন। যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখব ১৯৬৭ সালের ৫ জুন, শুরু হওয়া ৬ দিনের আরব ইসরাইল যুদ্ধে ফিলিস্তিনীর পশ্চিম তীর ও গাজা ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। সেই থেকে ফিলিস্তিনী জনগণ দিনটিকে নক্সা দিবস বা দুর্যোগের দিন হিসেবে পালন করে আসছে। দীর্ঘ ৫০ বছর পর একই দিনে কাতারকে জলস্থল অন্তরীক্ষে অবরুদ্ধ করেছে কাতারেরই প্রতিবেশী দেশ। ঘটনাটি একবার ভাল করে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে কাতারকে নিষিদ্ধ করলে চাপে পড়বে গাজা। যা সুবিধাজনক হবে ইসরাইলের জন্য। কাতারকে যে অপরাধে দোষী করা হলো তেমন ঘটনার বিশ্বে আরও নজির রয়েছে। সিরিয়া লিবিয়া ও মিসরে সরকার উৎখাতে বিভিন্ন চরমপন্থী সংগঠন ও জনগোষ্ঠীকে সহায়তা দিয়েছে সৌদি। মুসলিম ব্রাদার হুডের পতন ঘটিয়ে অব্দেল ফাতাহ আল সিসিকে নীরব শোষণ করে চলেছে। ইয়েমেনে শিয়াপন্থীদের হটাতে অর্থ ঢালছে। টুইন টাওয়ার আক্রমণের জন্য সৌদি আরবকে দায়ী করে ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। অথচ সন্ত্রাসে অর্থ দেয়ার অভিযোগে একঘরে করা হলো কাতারকে। কাতারকে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বলা হচ্ছে অথচ সৌদি জোটের সব দেশ ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক বহাল রেখেছে। ইরানকে বলা হচ্ছে সব অনিষ্টের মূল অথচ সেই ইরানই হচ্ছে আমিরাতের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। এদিকে সন্ত্রাসীদের মদদ দিচ্ছে বলে যে দেশের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ সেই কাতারেই রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি কমান্ড সেন্টার। তাহলে কেন এই দেখানো নাটক? এর আসল রহস্য কোথায়? সৌদি জোটের মূল ক্ষোভের কারণ হচ্ছে গাজায় ইসরাইলী দখলদার বাহিনীর একমাত্র প্রতিরোধ শক্তি হামাসের প্রতি কাতারের সমর্থন। মাঝ থেকে সুবিধা নিল ইসরাইল। একটি বুলেট খরচ না করেও আরব দেশের জোট দিয়েই গাজাকে সর্মথনকারী দেশ কাতারকে শায়েস্তা করতে সক্ষম হয়েছে ইসরাইল। যার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে গাজার ওপর। যাকে অভিহিত করা যায় ঢিল ছাড়াই দুই পাখি মারার শামিল। সৌদি জোটের একটি বড় ধরনের ভুল হচ্ছে কাতারকে কোণঠাসা করার জন্য ট্রাস্পের ওপর নির্ভর করা। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আসলে কি চান তা বুঝতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে সিআইএ, এফবিআই, পেন্টাগনসহ খোদ অমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন। সেই ট্রাম্প যে সহসা মোড় নেবেন না সে বিষয়ে কতটা ভরসা রয়েছে! সৌদি আরব, আমিরাত এবং মিসরের বিদ্যুত এবং জ্বালানি কেন্দ্রগুলো চলে মিসরের গ্যাস দিয়ে। কাতার এবং আরব আমিরাতের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ হলো ১৫ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে মিসরের ৬০% গ্যাস সরবরাহ আসে কাতার থেকে। এই দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য বন্ধ হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সবাই। তাই নিজের নাক কেটে কাতারের যাত্রা ভঙ্গের চেষ্টা, পাছে নিজেদেরই ক্ষতির কারণ না হয়ে দাঁড়ায়। অবরোধ আর হুমকি দিয়ে কাতারকে পদানত করার যে স্বপ্ন আমিরাত ও সৌদি আরব দেখছে তা কতটা সম্ভব সেটাই এখন দেখার বিষয়। লেখক : বেসরকারী সংস্থায় কর্মরত
×