ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নিরঞ্জন রায়

ঘাটতি বাজেট এবং নিরুৎসাহিত অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়

প্রকাশিত: ০৬:৩৯, ২০ জুন ২০১৭

ঘাটতি বাজেট এবং নিরুৎসাহিত অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়

অর্থমন্ত্রী ২০১৭-১৮ বছরের জন্য ৪ ট্রিলিয়ন টাকার এক বিশাল বাজেট জাতীয় সংসদে পেশ করেছেন। প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ধার্য করা হয়েছে প্রায় ১.১২৩ ট্রিলিয়ন টাকা, যার ৫৪% অর্থাৎ ৬০৪ বিলিয়ন টাকা অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় সংগ্রহের মাধ্যমে জোগার করা হবে। বাংলাদেশে ঘাটতি বাজেট প্রণয়ন নতুন কিছু নয়। আমার জানা মতে দেশে কখনই ভারসাম্য (ব্যালান্স) বাজেট বা উদ্বৃত্ত বাজেট প্রণীত হয়নি। সবসময়ই ঘাটতি বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। এই ঘাটতির পরিমাণে তারতম্য থাকতে পারে, তবে দেশবাসী সবসময়ই ঘাটতি বাজেট দেখে আসছে। ঘাটতি বাজেট ও সুদের হার দেশে যদি অর্থনৈতিক মন্দা বিরাজ করে বা দেশটি যদি উন্নয়নশীল হয় তাহলে ঘাটতি বাজেট প্রণয়ন করা ছাড়া কোন গত্যন্তর থাকে না। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশে যেহেতু ব্যাপক উন্নয়ন সম্ভাবনা রয়েছে তাই ঘাটতি বাজেট প্রণয়নই বাস্তবসম্মত এবং হয়েছেও তাই। কিন্তু ঘাটতি বাজেট প্রণয়ন সত্ত্বেও অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় সংগ্রহকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে দারুণভাবে, যা মোটেই ভাল লক্ষণ নয়। ঘাটতি বাজেটের অর্থই হচ্ছে সরকারের বাজেট বাস্তবায়নের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে হবে জনগণের কাছে বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্র বা বিনিয়োগ বন্ড বিক্রি করে। প্রস্তাবিত বাজেটে মোট ঘাটতির প্রায় ৫৪% বা ৬০৪ বিলিয়ন টাকা এইভাবে সংগ্রহ করতে হবে, যে কারণে সঞ্চয়পত্রের বা অন্যান্য সরকারী বিনিয়োগ বন্ডের উপর সুদের হার বেশি থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে প্রস্তাবিত বাজেটে সঞ্চয়পত্রের উপর সুদের হার কমানোর ইঙ্গিত করা হয়েছে। একইভাবে বাজেটে বেসরকারী খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির কথাও বলা হয়েছে। বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে গেলেই বিনিয়োগযোগ্য অর্থের চাহিদা বেড়ে যাবে এবং এজন্য দেশীয় সঞ্চয় বা ব্যাংক আমানতের উপর সুদের হার বাড়াতে হবে। এটাই অর্থনীতির নিয়ম। কিন্তু বাস্তবে আমাদের দেশে ব্যাংক আমানতের উপর সুদের হার নিম্নমুখী এবং বর্তমানে সর্বনিম্ন পর্যায় বিরাজ করছে। সুতরাং একদিকে ঘাটতি বাজেট প্রণয়ন এবং বিনিয়োগ উৎসাহিত করার উদ্যোগ গ্রহণ, অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রসহ ব্যাংক আমানতের উপর সুদের হার হ্রাসÑকোনভাবেই অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মের মধ্যে পড়ে না। অথচ কৌশল হিসেবে এই বিপরীতধর্মী ব্যবস্থাই যথারীতি গৃহীত হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। মূলত আমাদের দেশের অর্থনীতির অবস্থাই এমন যে, এখানে অর্থনীতির প্রচলিত নিয়ম খুব একটা কাজে আসে বলে মনে না। ঝুঁকিমুক্ত এবং ঝুঁকিপূর্ণ সঞ্চয়ের উপর সুদের হার সঞ্চয়পত্রের উপর প্রদত্ত সুদের হারকে সাধারণত ঝুঁকিমুক্ত (রিস্ক ফ্রি) সুদ বা মুনাফা বলা হয়ে থাকে। কেননা এই সঞ্চয় প্রকল্পগুলো সার্বভৌম (সাভারাইন) বন্ড। তাই এতে কোনরূপ ঝুঁকি থাকে না। অথচ অন্য যে কোন প্রকার সঞ্চয় স্কিম এবং ব্যাংক আমানত কিছুটা হলেও ঝুঁকিপূর্ণ। মুদ্রাবাজারের স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী ঝুঁকিমুক্ত সঞ্চয় প্রকল্পের চেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সঞ্চয়ের উপর সুদের হার বেশি থাকে। কেননা অর্থনীতির সংজ্ঞা অনুযায়ী গৃহীত ঝুঁকির মূল্যই হচ্ছে অর্জিত সুদ বা মুনাফা। তাই বিশ্বের সর্বত্রই সরকারী সঞ্চয়ী স্কিমের চেয়ে বেসরকারী সঞ্চয়ী মাধ্যমের উপর সুদের হার তুলনামূলক বেশি। এমনকি সরকারী ব্যাংকের আমানতের চেয়ে বেসরকারী ব্যাংকের আমানতের উপর সুদের হার সাধারণত বেশি হয়ে থাকে। আমাদের দেশেও সবসময়ই এই ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। মাত্র কিছু দিন হলো অবস্থা বিপরীত আকার ধারণ করেছে, যেখানে সরকারী সঞ্চয় মাধ্যমের চেয়ে বেসরকারী ব্যাংক আমানতের উপর সুদের হার কম। ব্যাংকগুলো সুদের হার বলতে গেলে কিছুটা জোরপূর্বক হ্রাস করার কারণে এমন অসামঞ্জস্য দেখা দিয়েছে সঞ্চয়পত্রের এবং ব্যাংক আমানতের উপর সুদের হারের ক্ষেত্রে। ব্যাংক আমানতের উপর এত নগণ্য সুদ বা মুনাফা প্রদান করার কারণে ব্যাংকগুলো তারল্য সঙ্কটে পড়ার কথা। আপাতত সেই অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে না, কারণ ব্যাংকগুলো এখন আর সেভাবে নতুন ঋণ বিতরণ করছে না। সব ব্যাংকই একরকম খেলাপী ঋণ আতঙ্কে ভুগছে। তাই কোন ব্যাংকই এখন স্বউদ্যোগে ঋণ প্রদান করতে আগ্রহ দেখায় না। যে সকল ক্ষেত্রে প্রভাবশালী মহলের প্রচণ্ড চাপ থাকে কেবল সেসব ক্ষেত্রেই কিছুটা বাধ্য হয়ে ব্যাংকাররা নিজেদের চাকরির স্বার্থে নতুন ঋণ প্রদান করে থাকে। কোন সাধারণ ব্যবসায়ী বা বিনিয়োগকারী খুব সহজে এখন আর ব্যাংক থকে ঋণ পায় না। এ কারণেই দেখা যায় মাত্র দশ লাখ টাকার ঋণ অনুমোদন করতে কত কাগজ, কত কৈফিয়ত এবং কত কঠোর নিয়ম কানুনের প্রয়োগ, অথচ শত শত কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন হয়ে যায় মুহূর্তের মধ্যে। এটা মোটেই ভাল লক্ষণ নয় এবং এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব দেশের ব্যাংকিং খাতের এবং অর্থনীতির উপর বেশ খারাপভাবেই পড়তে বাধ্য। ব্যাংকগুলোর এহেন সঙ্কুচিত ঋণ নীতির কারণেই কিছুটা জোরপূর্বক ব্যাংক আমানতের উপর সুদের হার কমিয়ে রাখা হয়েছে। ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে কর্পোরেট গবর্ননেন্স অর্থাৎ পরিচালনা পর্ষদ এবং ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট দায়িত্ব, কর্তব্য এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা না গেলে শুধুমাত্র মুদ্রানীতি দ্বারা এই ব্যবস্থার উত্তরণ সম্ভব নয়। আমানতের উপর আবগারি শুল্কের মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতিই বেশি সঞ্চয়পত্রের এবং ব্যাংক আমানতের উপর সুদের হার হ্রাসের পাশাপাশি ব্যাংক আমানতের উপর আবগারি শুল্কের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে, যা ক্ষুদ্র সঞ্চয়কে নিরুৎসাহিত করবে মারাত্মকভাবে। আমানতের পরিমাণ এক লাখ টাকা হলেই আবগারি শুল্ক দিতে হবে ৮০০ টাকা। এ যেন মরার উপর খাঁড়ার ঘা। এমনিতেই ব্যাংকে টাকা রেখে এখন আর তেমন সুদ বা মুনাফা পাওয়া যায় না। তার উপর এই বাড়তি টাকা আবগারি শুল্ক হিসেবে সরকারকে প্রদান করতে হবে। যখন সঞ্চয়ের উপর সুদের হার নিম্নমুখী এবং বর্তমানে সর্বনিম্ন পর্যায় আছে, তখন জনগণের সঞ্চয়ী স্পৃহা কিছুটা হলেও ধরে রাখার জন্য আবগারি শুল্কসহ অন্যান্য ফি বা চার্জ প্রত্যাহার করাই ছিল সবচেয়ে বেশি যুক্তিসঙ্গত এবং বাস্তবসম্মত। সরকার সে দিকে না যেয়ে উল্টো ব্যাংক আমানতের উপর আবগারি শুল্কের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে, যা আমানতকারীদের দারুণভাবে ক্ষব্ধ করবে। আমাদের মনে রাখা উচিত এই আবগারি শুল্কের কারণে আমানতকারীদের যত না আর্থিক ক্ষতি হবে, তার চেয়ে অনেক বেশি মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতি হবে। অথচ ব্যাংক আমানতের উপর এই আবগারি শুল্ক আরোপ করে সরকার খুব সামান্য অর্থই সংগ্রহ করতে পারবে। তাই দেশের আমানতকারীদের বৃহত্তম স্বার্থ, বিশেষ করে মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতির দিকটি বিবেচনা করে খুব সহজেই এটি বাদ দেয়া যেত। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মানুষের আর্থিক বিষয়ের পাশাপাশি মনস্তাত্ত্বিক বিষয়টিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে যারা সরাসরি জড়িত, তারা যদি বিষয়টি বিবেচনায় রাখেন, তাহলে জনগণও যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, তেমনি সরকারকেও সমালোচনার সম্মুখীন হতে হবে না। জোরপূর্বক সুদের হার হ্রাসের পরিণতি বর্তমান প্রেক্ষাপটে সুদের হার কমিয়ে রাখা দেশের ব্যবসা বাণিজ্য ও অর্থনীতির জন্য কতটা সহায়ক, তা অবশ্য অর্থনীতিবিদ ও নীতি নির্ধারকরাই ভাল বলতে পারবেন। তবে এর যে একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে, তা মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায়। কেননা বিপুলসংখ্যক অবসরে থাকা চাকরিজীবী, অসংখ্য বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী এবং আত্ম-কর্মসংস্থানে নিয়োজিত ব্যক্তিরা তাদের জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে সঞ্চয়পত্র এবং ব্যাংক আমানতের সুদের উপর নির্ভর করে থাকে। সুদের হার কমে যাওয়ায় এই জনগোষ্ঠী তাদের জীবনযাপনে যথেষ্ট সমস্যায় পড়বেন। তাছাড়া এই স্বল্প সুদের হারের সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন ভুঁইফোড় অপ্রাতিষ্ঠানিক সংস্থা বা তথাকথিত এনজিও গড়ে উঠতে পারে, যারা অধিক সুদের হারের লোভ দেখিয়ে সহজ সরল আমানতকারীর অর্থ জমা নিয়ে নানারকম আর্থিক কেলেঙ্কারির জন্ম দিতে পারে। এ রকম অঘটনের নজির আমাদের নিকট অতীতে একেবারে কম নেই। তাছাড়া বিকল্প মুনাফার আশায় আমানতকারীরা শেয়ার বাজারের দিকেও ঝুঁকতে পারে। দেশের শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে ভাল লক্ষণ। তবে সব ধরনের সঞ্চয় বিশেষ করে ক্ষুদ্র আমানতকারীর অর্থ শেয়ার বাজারের জন্য মোটেই উপযুক্ত নয়। কেননা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে যথেষ্ট ঝুঁকি আছে। যেজন্য বিনিয়োগকারী অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। এই কারণেই ক্ষদ্র আমানতকারীর কষ্টার্জিত সঞ্চয় যাতে ঝুঁকিপূর্ণ শেয়ারবাজারে প্রবেশ করতে না পারে, সেই প্রচেষ্টা সবসময় সরকারের পক্ষ থেকে গ্রহণ করা উচিত। উচ্চ সুদের হার বিনিয়োগের পথে অন্তরায় হিসেবে উল্লেখ করে এর বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা থাকলেও এটাকে জোরপূর্বক কমানোর চেষ্টা কখনই শুভ হয়নি। এর আগে ২০০৪-২০০৫ সালের দিকে জোরপূর্বক সুদের হার কমানোর চেষ্টা বুমেরাং হয়ে দেখা দিয়েছিল। কেননা দেশের মুদ্রাবাজারে তখন তারল্য সঙ্কট চরমে পৌঁছে। ফলে কলমানি রেট এক পর্যায় ৬০%-৭০% পর্যন্ত গড়ায়। সরকার ১.১২৩ ট্রিলিয়ন টাকা ঘাটতিসহ প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন টাকার বাজেট প্রণয়ন করেছে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য। বাজেটে বিনিয়োগ বৃদ্ধির উপরও যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। বাজেট বাস্তবায়ন এবং এর লক্ষ্য অর্জনের স্বার্থে অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় সংগ্রহ নিরুৎসাহিত হয় এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করা ঠিক হবে না। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয় যে, সঞ্চয় সংগ্রহের ক্ষেত্রে মানুষের আর্থিক সক্ষমতার চেয়ে সঞ্চয়ী মনোভাব বা স্পৃহা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই সঞ্চয়ী স্পৃহা গড়ে উঠে দীর্ঘদিন ধরে সঞ্চয় করার অভ্যাস থেকে। আমাদের দেশের মানুষের দীর্ঘদিনের অভ্যাস এই সঞ্চয়ী স্পৃহা একবার নষ্ট হয়ে গেলে, তা আর সহজে গড়ে উঠবে না। সুতরাং সঞ্চয়ী স্পৃহা নষ্ট হয় এমন উদ্যোগ আপাতদৃষ্টিতে যত ভালই হোক, তা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন। তাই ব্যাংক আমানতের উপর আবগারি শুল্ক প্রত্যাহারসহ সঞ্চয়পত্র এবং ব্যাংক আমানতের উপর সুদের হার যাতে সহনীয় পর্যায় থাকে, সেই বিবেচনা থেকেই সরকার প্রস্তাবিত বাজেটের প্রয়োজনীয় অংশটুকু সংশোধন করবে বলেই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। লেখক : ব্যাংকার, টরনটো, কানাডা [email protected]
×