ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সংসদে সমালোচনার মুখে অর্থমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০০:২৭, ১৯ জুন ২০১৭

সংসদে সমালোচনার মুখে অর্থমন্ত্রী

সংসদ রিপোর্টার ॥ প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংকে আমানতের ওপর আবগাড়ি শুল্ক ও ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রস্তাব, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর ঘোষণা এবং বিভিন্ন সময়ে দেওয়া ‘বিতর্কিত’ বক্তব্যের জন্য সোমবার জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সমালোচনায় মুখর ছিলেন সরকারি দলের সিনিয়র সংসদ সদস্যরা। অর্থমন্ত্রীকে উদ্দেশ্যে করে তাঁরা বলেছেন, ‘আপনার কিছু কথা-বার্তা আমাদের সরকারকে অনেক সময় বিব্রত অবস্থায় পড়তে হয়। একগুঁয়েমী করে সরকারকে আর বিব্রতকর অবস্থায় ফেলবেন না। আপনি আইএমএফ’র কথা শুনে সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদের হার কমিয়েছেন। এই আইএমএফ কোনো দিনই ভাল চায় না। তাই অনুরোধ- একটু কম কথা বলুন, জনগণের ভাষা জানার চেষ্টা করুন।’ প্রথমে স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং পরে ডেপুটি স্পীকার এ্যাডভোকেট ফজরে রাব্বি মিয়ার সভাপতিত্বে রবিবার জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে তাঁরা এসব কথা বলেন। আলোচনায় অংশ নেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, সাবেক তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, সেক্টর কমান্ডার (অব.) মেজর রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম, সাবেক প্রতিমন্ত্রী এইচ এন আশিকুর রহমান, ফজিলাতুন নেসা বাপ্পি, মাহবুব আলী, মনিরুল ইসলাম, মোসলেম উদ্দিন, নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, ইসরাফিল আলম, জাসদের মইন উদ্দীন খান বাদল, বিএনএফে’র এস এম আবুল কালাম আজাদ, স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মকবুল হোসেন এবং বিরোধী দল জাতীয় পার্টির নাসরিন জাহান, সেলিম উদ্দিন ও মাহজাবিন মোর্শেদ। বাজেট আলোচনার শুরুতে অর্থমন্ত্রী সংসদে উপস্থিত থাকলেও এক পর্যায়ে তাঁর আর অধিবেশনে দেখা যায়নি। আলোচনায় অংশ নেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী শেখ ফজলুল করিম সেলিম অর্থমন্ত্রীর অতিকথনের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, আওয়ামী লীগ জনকল্যানের জন্য রাজনীতি করে। জনগনের কষ্ট হয় সেটা আওয়ামী লীগ মেনে নিতে পারেনা। তাই অর্থমন্ত্রীকে বলবো আবগারি শুল্ক যেটা দিয়েছেন, সেটা প্রত্যাহার করেন। এটা নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। এই আবগারি শুল্কের জন্য গোটা জাতি আওয়ামী লীগ সম্পর্কে খারাপ ধারনা নেবে এটা আমরা চাই না। অর্থমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘আপনার কিছু কথা-বার্তা আমাদের সরকারের অনেক সময় বিব্রত অবস্থায় পড়তে হয়। এই সংসদেই একদিন বলেছিলাম আপনি কথা কম বলেন। আপনার বয়স হয়ে গেছে, কখন কি বলে ফেলেন, হুস থাকে না।’ অর্থমন্ত্রীর সমালোচনা করে তিনি আরও বলেন, যেখানে প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন বাজেটে কোন অসঙ্গতি থাকলে সেটা আমি দেখবো। আর আপনি (অর্থমন্ত্রী) সিলেটে গিয়ে বললেন এক লাখ টাকা যার আসে যে ধনী ও সম্পদশালী! আপনি হলমার্ক কেলেঙ্কারির সময় কি বলেছিলেন? ভুলে গেছেন? তখন বলেছিলেন ৪ হাজার কোটি টাকা কোনো টাকাই না। আর এখন এক লাখ টাকা বেশি টাকা হয়ে গেল? অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব বাজেট পেশ করা। সংসদে ৩৫০ জন সদস্য ঠিক করবে জনগণের কল্যাণে কোনটা থাকবে, কোনটা থাকবে না। এটা আপনি (অর্থমন্ত্রী) সিদ্ধান্ত নেবেন না। আপনার একঘুয়েমি বন্ধ করেন। কথা কম বলেন। আপনি আইএমএফ’র কথা শুনে সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদের হার কমিয়েছেন। এই আইএমএফ কোনো দিনই ভাল চায় না। তারা একবার বলেছিল কৃষিতে ভর্তুকি না দিতে। সেটা করলে কি হতো? ঢালাওভাবে ভ্যাট আরোপেরও কড়া সমালোচনা করেন তিনি। নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার দাবি নাকচ করে দিয়ে শেখ সেলিম বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার সাগরে ডুবে গেছে। এখন বিএনপি নেত্রী চান সহায়ক সরকার। সংবিধানে সহায়ক বলে কোন কিছু নেই। খালেদা জিয়া যতই হুঙ্কার দেন, সংবিধানের বাইরে নির্বাচন হবে না। শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই আগামী নির্বাচন হবে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করবে। পাকিস্তান মার্কা বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শ শুনে কোন লাভ হবে না। এদেশে ১৫ ফেব্রুয়ারি কিংবা ফালু মার্কা কোন নির্বাচন হবে না। খালেদা জিয়াকে শেখ হাসিনার অধিনেই নির্বাচনে আসতে হবে। অন্য কোন পথ নেই। ড. ইউনুস গংরা কখনোই ক্ষমতায় আসতে পারবে না। আন্দোলনের নামে অগ্নিসন্ত্রাস চালালে জনগণ গণপিটুনি দিয়ে আপনাদের দেশ ছাড়া করবে। জাসদের মইন উদ্দীন খান বাদল বলেন, কিছু অন্ধকার এখনও আছে। শত ষড়যন্ত্র, বাধা উপেক্ষা করে শেখ হাসিনা দেশকে কৃষ্ণপক্ষ থেকে শুল্কপক্ষে নিয়ে এসেছেন। মৃত্তিকার কন্যার হাত ধরে আমাদের আরও অনেক দূর যেতে হবে। অর্থমন্ত্রী এমন এমন প্রকল্প নিয়েছে, ইতিহাস এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। যানজটে ঘন্টার পর ঘন্টা চলে যায়, পানিতে রাজধানী ডুবে যায়। মানুষ প্রশ্ন তুলেছে- প্রধান দুই নগরীকেই অর্থমন্ত্রী জলাবদ্ধতা মুক্ত করতে পারে না। মেঘা প্রকল্পের চেয়ে এটাই সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার দেয়া উচিত ছিল। ব্যাংকের জন্য এক হাজার কোটি টাকা মূলধন বরাদ্দের তীব্র সমালোচনা করে মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, অর্থমন্ত্রী এই টাকা কেন দিলেন? কার টাকা দিলেন? যেখানে লুটপাটের মাধ্যমে ব্যাংকের টাকা নয়-ছয় হয়েছে। তাতে ব্যাংকের মূলধনে টান পড়েছে। সেটা নিয়ে তদন্ত না করে উনি নতুন করে মূলধনের টাকা দিলেন। এটা হতে পারে না। তিনি বলেন, বাজেটটা নির্বাচনী হওয়া উচিত ছিল। আমি জানি না অর্থমন্ত্রী কী কারণে কার কারণে নির্বাচনী বাজেট না করে নির্বাচনবিরোধী বাজেটে পরিণত করেছেন। সাবেক তথ্য মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার সমালোচনা করে বলেন, আপনি এক কাপড়ে বিদায় করে দিবেন? মুখে বড় বড় কথা বলে লাভ নেই। আপনারাই তো বিদায় হয়ে গেছেন। জনগন শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে আছে। বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ প্রস্তাবিত বাজেটকে ‘দুঃসাহসী বাজেট’ উল্লেখ করার পাশাপাশি সোলার প্যানেল, তেল ও এলপিজি’র ওপর আরোপিত ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে বলেন, ২০১৮ সালের মধ্যে শতভাগ বিদ্যুতায়ন করার পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুত পেতে হলে আমাদের আরও অনেক দূর যেতে হবে। আগামী বাংলাদেশ হবে ‘গ্রিন ও অদম্য’ বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, অনেক সূচকেই ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। মাত্র আট বছরেই দেশের দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। সারাবিশ্বই বাংলাদেশের এমন উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির প্রশংসা করছেন। জাতীয় পার্টির নাসরিন জাহান রত্মা বলেন, ব্যাংকে অনেক গরীব মায়েরাও তাদের শেষ সম্বল জমা রাখে। এক লাখ টাকার ওপর আবগারী শুল্কারোপ উচিত হয়নি। গণহারে ভ্যাট আরোপ আগামী নির্বাচনে মাঠে প্রভাব পড়বে। দেশের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র চলছে। এদের ফাঁদে পা দিয়ে দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির চাকাকে স্তব্ধ করে দেওয়া উচিত হবে না। সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলাম বলেন, বাজেট পাসে আমাদের (এমপি) কোন ভূমিকা নেই। চিফ হুইপ যেদিকে হাত নাড়ান, আমরাও সেদিকে নাড়াই। এভাবে বাজেট পাস হলে বাজেট বাস্তবায়ন হবে না। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে কিছুটা সংশোধন এনে বাজেটে যদি এমপিদের স্বাধীনভাবে ভোট দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়, তবে অর্থমন্ত্রী এভাবে অনড় অবস্থানে থাকতে পারতেন না। এমপিদের কথা শুনতে হতো।
×