ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

হাফিজ বিন রহমান

মানবতার ধর্মে জঙ্গীবাদের ঠাঁই নেই

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ১৯ জুন ২০১৭

মানবতার ধর্মে জঙ্গীবাদের ঠাঁই নেই

ঈদ মানে খুশি। আনন্দ। বন্ধুত্ব। মানবতাবোধে জাগরিত হওয়া। ঈদ মানে অসাম্প্রদায়িকতা। শৃঙ্খলা, শান্তি। মানুষে মানুষে নেই ভেদাভেদ। নেই ভ্রান্তি। ঈদ মানে প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ব পালন। ভাল কাজে থাকবে না কোন ক্লান্তি। তাই ঈদ-উল-ফিতরের কথা মনে এলেই কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার কথা মনে পড়ে, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ/ আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাকিদ।’ এখানে আসমানী তাকিদ শুনতে বলা হয়েছে। এই শব্দের অর্থ খুঁজতে পারলেই ইসলামের সুমহান আদর্শ ও ঈদের মর্মার্থ বোঝা যাবে। শেষ নবী হযরত মোহাম্মদের (সা) সময় কাফেররা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালন করত। সাহাবীরা মোহাম্মদকে (সা) এ বিষয়ে বলেন, আমাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান না থাকায় সাংস্কৃতিক চর্চা থেকে মুসলিমরা দূরে সরে যাচ্ছে। তখন আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে দুটি ঈদ পালনের নির্দেশ আসে। পৃথিবীসহ এই মহাবিশ্বের একমাত্র স্রষ্ঠা মহান আল্লাহ। তিনি অসাম্প্রদায়িক। সমগ্র জীবজগত তাঁর সৃষ্টি। হিন্দু-খ্রীস্টান-বৌদ্ধ-মুসলমানসহ সব ধর্মের মানুষই তাঁর সৃষ্টি। আলো, বাতাস, ফুল-ফল সবার জন্য। জোছনা রাতের স্নিœগ্ধতা সবার জন্য উন্মুক্ত। এগুলো তাঁর রহমান নামের বদৌলতে। আবার ইমান-আমল, ধন-দৌলত, শিক্ষা-দীক্ষা প্রভৃতি অর্জন করে নিতে হয়। এগুলোও তিনি দেন তাঁর রহিম নামের গুণে। তাহলে আসমানী তাকিদ হলো আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হওয়া। আর আল্লাহর গুণ হচ্ছে আল্লাহ অসাম্প্রদায়িক। আরও একটি বিষয় হচ্ছে মোহাম্মদ (সা) হচ্ছেন আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। এমনকি যত নবী-রাসুল এসেছেন সবার মধ্যেই শ্রেষ্ঠতম। সেই বিশ্ববিশ্রুত মানুষটির কথা আল্লাহ পাক বলছেন, ‘আমি আপনাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।’ এখানেও স্পষ্ট, আল্লাহ তাকে মানবজাতির নবী হিসেবে পাঠিয়েছেন। তিনি শুধু মুসলমানের নবী নন। তাহলে আল্লাহ নির্দেশিত ধর্ম শুধু মুসলমানের জন্য নয়। নবী প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত ধর্মও শুধু মুসলমানের নয়। আল্লাহ নির্দেশিত ও নবী প্রকাশিত ঈদও তাহলে শুধু মুসলমানের জন্য নয়। সুতরাং যারা মনে করেন মুসলমান ছাড়া পৃথিবীতে আর কারও বেঁচে থাকার অধিকার নেই তারা মনে হয় আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের চেয়ে বেশি বোঝেন। কোরান ও হাদিসের চেয়ে চটি বই তাদের কাছে বেশি প্রিয়। মহাপবিত্র কোরানে ৬০০০-এর বেশি আয়াত রয়েছে। একটি শব্দও কেউ দেখাতে পারবেন না যে, নিরপরাধ মানুষ হত্যা করা যাবে। লাখ লাখ হাদিস রয়েছে। একটিও কেউ দেখাতে পারবেন না যে, নিরপরাধ কোন মানুষকে হত্যার নির্দেশ আছে। সে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ যাই হোক। তথাকথিত একটি ধারণা আছে। সেটি হলো, আল্লাহর দ্বীন কায়েমের জন্য দেদার মানুষ হত্যা করা যায়। আল্লাহকে ভালবেসে এটা করা হয়। আল্লাহকে পাওয়ার জন্য এটি করা হয়। হাস্যকর! চরম হাস্যকর!! আল্লাহর নবী মোহাম্মদ (সা) তো এটি বলেননি। তাহলে মোহাম্মদ (সা)-এর চেয়ে আমরা আল্লাহকে বেশি ভালবাসি। দ্বীন ইসলামকে বেশি ভালবাসি। ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য বেশি কাজ করি। এসব ভ্রান্ত ধারণা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কোথা থেকে কে শেখালো তা নিয়ে গবেষণা করলে একটি ইতিহাস রচিত হতে পারে। ইসলামের বিধান সবার জন্য উন্মুক্ত। জাকাত প্রতিবেশীর হক। প্রতিবেশী যদি অমুসলিম দরিদ্র হয় তাহলে কি তার হক নেই! অবশ্যই আছে। ধর্ম কত উদার! আর আমরা কত অনুদার! তবে গুরুভক্তি থাকতে হবে। গুরুর শিষ্যত্বও নেব, আবার গুরুকে গালিও দেবÑ এই স্ববিরোধিতা চলবে না। আল্লাহকে মানব না। কোরান-হাদিসে বিশ্বাস নেই। কোনদিন পড়বও না। আবার ঈদ এলে আনন্দের সীমা থাকবে না। এটি অগ্রহণযোগ্য। চরম ভ-ামি। ফেতনা সৃষ্টিকারীর বৈশিষ্ট্য। অশান্তি সৃষ্টিকারী। এরাই এক সময় জঙ্গী হয়। মানুষ মারে। সমাজ ধ্বংস করে। দেশের উন্নয়নের পথে প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়। জঙ্গীবাদী চিন্তা-চেতনা ইসলামের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে সাংঘর্ষিক। জঙ্গীরা ইসলামের শত্রু। মানবতার শত্রু। বাংলাদেশের শত্রু। কেউ কেউ আবার আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে শহীদ (?) হচ্ছে। মনে হয়, আত্মঘাতী হামলা যারা চালায় এরা আত্মহত্যা করছে। এরা শহীদ হচ্ছে, না কাফের হচ্ছে তা বিজ্ঞ পাঠকের বিচারের ওপর ছেড়ে দিলাম। তৎকালীন আবু জেহেল মোহাম্মদকে (সা) জেল খাটিয়েছে। বারংবার হত্যার ষড়যন্ত্র করেছে। হিজরত করতে বাধ্য করেছে। তায়েফের ময়দানে রক্ত ঝরিয়েছে। নিজ হাতে পিটিয়ে আহত করেছে। মক্কার লোকেরা তো আবু জেহেলকেই তখন সহযোগিতা করেছে। মক্কা বিজয়ের পর নবী তো সব মাফ করে দিলেন। অথচ সামান্য প্রতিশোধ নিলেও তো সব নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত! তায়েফের ময়দানে নবীকে রক্তাক্ত করা হলো। জিব্রাইল (আ) আল্লাহর নির্দেশে হাজির হয়ে বললেন, আপনি বলুন ‘আমি দুই পাহাড়কে এক করে তায়েফবাসীকে নিশ্চিহ্ন করে দিই।’ নবী বললেন, ‘তাহলে আমি ইসলামের দাওয়াত কাকে দেব। মানুষই যদি না থাকল তাহলে আমার ধর্মে কে দীক্ষিত হবে?’ এজন্যই মানবতার ধর্ম ইসলামে মানুষ হত্যা জায়েজ নয়। এই ধর্মে মানুষে মানুষে নেই কোন ভেদাভেদ। নেই সাম্প্রদায়িকতার এতটুকু ছোঁয়া। এরপরও যারা ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষ হত্যা করে, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াতে চায়, তারা নবীর চেয়ে যেন ইসলাম বেশি বোঝে! আর জঙ্গীরা যদি সবাইকে এভাবে মেরেই ফেলে তাহলে ধর্মের আর প্রয়োজন হবে কোথায়? মানুষ না বাঁচলে ধর্ম কি গাছপালা, জীবজন্তু‘কে শাসন করবে? এ সব নালায়েক মূর্খ, ধর্মান্ধ, গোঁড়ারদের জানা উচিত, পৃথিবীতে আগে মানুষ এসেছে, এরপর ধর্ম। ধর্ম হচ্ছে মানুষকে পরিচালনার একটি গাইডলাইন। মানুষ না থাকলে ধর্মের কোন প্রয়োজন হবে না। জাতীয় কবির ‘ফণি-মনসা’ কাব্যের ‘যা শত্রু পরে পরে’ কবিতা থেকে বলা যায়, ‘ঘর সামলে নে এই বেলা তোরা ওরে ও হিন্দু-মুসলেমিন!/ আল্লা ও হরি পালিয়ে যাবে না, সুযোগ পালালে মেলা কঠিন!/ ধর্ম-কলহ রাখো দুদিন!’ সত্যিই ধর্ম কলহে জড়িয়ে পড়ে দেশের সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করা মীরজাফরী ছাড়া আর কিছু নয়। কেন এতটা অর্বাচীন হচ্ছি আমরা? মানবিক বোধে জাগ্রত হয়ে অসাম্প্রদায়িক সমাজ বিনির্মাণে ষোল কোটি মানুষকে এক হয়ে কাজ করা দরকার। না হলে প্রতিযোগিতার বিশ্বে অর্থনৈতিকভাবে পেছনে পড়তে হবে। কাজী নজরুলের একই কবিতার আর একটি উদ্ধৃতি, ‘ভায়ে ভায়ে আজ হাতাহাতি করে কাঁচা হাত যদি পাকিয়েছিস,/ শত্রু যখন যায় পরে পরে- নিজের গ-া বাগিয়ে নিস্!/ ভুলে যা ঘরোয়া দ্বন্দ্ব-রিষ।/কলহ করার পাইবি সময়,/ এ সুযোগ দাদা হারাবার নয়!/ হাতে হাত রাখ, ফেল হাতিয়ার, ফেলে দে বুকের হিংসা- বিষ!/ নব-ভারতের এই আশিস!’ কবি বেঁচে থাকলে অনুরোধ করতাম ‘ভারতের’ স্থলে ‘বাংলার’ শব্দ প্রতিস্থাপন করতে। আসলেই তাই। ভায়ে ভায়ে হানাহানি করে আজ আমরা দেশকে পিছিয়ে দিচ্ছি। (অ) মানুষ হয়ে মানুষের বুকে ছুরি ধরছি। জঙ্গী হয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষ বুনছি। ধর্মের মূল আদর্শ থেকে বিচ্যুত হচ্ছি। ঈদের শিক্ষা থেকে বিচ্যুত হচ্ছি। আবার ঈদের আনন্দে হৃদয় আলোড়িত হচ্ছে। এসবই হচ্ছে নিজের সঙ্গে প্রতারণা। মানবতার সঙ্গে প্রহসন। ধর্মের ওপর কালিমা লেপন। এসবের দ্বারা শান্তির ধর্ম ইসলাম হচ্ছে বিতর্কিত। তাই জঙ্গী নিয়ে সরকার ভাবছে। এধরনের বিশৃঙ্খলকারীদের ব্যাপারে সরকারের পদক্ষেপ অত্যন্ত কঠোর, প্রশংসনীয় এবং ধর্মানুগ। তবে এটাকে কাজে লাগিয়ে কোন স্বার্থান্বেষী গ্রুপ যাতে ফায়দা না লোটে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা দরকার। দেশ ধর্ম ও মানবতার নিকৃষ্টতম শত্রু জঙ্গীবাদ। এই জঙ্গীবাদকে কঠোর হাতে দমন এখন সময়ের দাবি। ঈদের প্রকৃত শিক্ষা যেন এবার বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছায়। অসাম্প্রদায়িক একটি সমাজ, মানবতাবোধে সমুজ্জ্বল একটি সমাজ আমাদের স্বপ্ন। সেই সমাজ প্রতিষ্ঠিত হোক এই কামনা। লেখক : বাংলাদেশ বেতারের গীতিকার [email protected]
×