ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সরকার নয়, নির্বাচন ইসির অধীনেই

প্রকাশিত: ০৬:০১, ১৯ জুন ২০১৭

সরকার নয়, নির্বাচন ইসির অধীনেই

আতঙ্ক আর সংশয় বাড়ে, যখন বিএনপি নেত্রী ঈদের পর জনগণকে (আসলে দলীয় ক্যাডার) রাস্তায় নামার আহ্বান জানান। বলেছেন তিনি-রোজার পর সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ গড়ে তুলতে হবে। এজন্য ছাত্র যুবকদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। বিএনপি নেত্রীর আন্দোলন মানেই পেট্রোলবোমা মেরে, জ্যান্ত হত্যা চালিয়ে এক নৈরাজ্যকর ও সহিংসতার পথ প্রদর্শন। এমনিতেই বেগম জিয়ার একটি রাজনীতি রয়েছে। সে রাজনীতি দেশকে পিছিয়ে দেয়া। যার নমুনা দেশবাসী দেখেছে ২০১৩ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত। অবরোধ ও হরতাল ডেকে দেশব্যাপী যে নাশকতার বিস্তার ঘটিয়েছিলেন তা রাজনীতিকরা ভুলে গেলেও দেশবাসী ভুলে গেছে, তা নয়। পেট্রোলবোমায় জীবন্ত মানুষ দগ্ধ করে হত্যার ঘটনা রাজনীতিকরা ভুলে যেতে পারেন, কিন্তু যারা ভুক্তভোগী কিংবা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, তারা সেসব ভুলতে পারে না। খোদ রাজধানীতে বাসযাত্রী পুড়িয়ে মারার ঘটনার সময় নিরাপত্তাবর্ম হিসেবে গণপরিবহনের যেসব বাসের সামনে ও পেছনে দুটি দরজা ছিল, তার একটি অর্থাৎ পেছনের দরজাটি চিরতরে বন্ধ করে দেয়া হয়। পেছনের দরজা দিয়ে সন্ত্রাসীরা গাড়িতে যাত্রীবেশে উঠে গানপাউডার ছিটিয়ে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটায়। সেই দরজা আর খোলা হয়নি। চিরতরে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যাত্রী উঠানামার সুবিধার্থে বাসে দুটি দরজা রাখা হয়েছিল। বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মালিকদের লাভ, দু’দরজার জন্য দু’জন কন্ডাক্টর বা হেলপার রাখার স্থলে এখন একজনই যথেষ্ট। দরজা বন্ধ হওয়ার কারণে, অনেকে কর্মহীন হয়েছে। এসবই বেগম জিয়ার অবদান। তার নৃশংসতাও নাশকতামূলক কর্মকা-ের চিহ্ন আজও বয়ে বেড়ায় গণপরিবহন। এসব দেখেও মানুষ হয়ত স্মরণ করতে পারে, সেই বীভৎসতার দিনগুলোকে যা রাজনৈতিক দল বিএনপি-জামায়াত জোটের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছে। শতাধিক মানুষের মৃত্যু আর অজস্র মানুষের আহত হওয়ার ঘটনাগুলো রাজনীতিকরা ধামাচাপা দিতেই পারেন। কিন্তু জনমনে তার দুর্বিষহ স্মৃতি মুছে ফেলা যায় না। মানুষ হত্যার এই মহাপাপের বিচার আর হয় না। মামলা হয়েছে। গ্রেফতারও হয়েছে অনেকে। কিন্তু বিচার কাজ আর চলে না। অনেকেই জামিনে মুক্তি পেয়েছে। সরকারী দলের পক্ষ থেকে বার বার বলা হয়েছে, বিচার হবেই। কিন্তু আকস্মিকভাবে বলা হলো, গণআদালতে এর বিচার হবে। এই গণহত্যার বিচার কেন গণআদালতে হবে, তার কোন ব্যাখ্যা মেলে না। এভাবেই রাজনীতিকরা ভুলিয়ে দিয়েছেন ২০০১ সালের নির্বাচনপরবর্তী বিএনপি-জামায়াতের ‘অপারেশন ক্লিনজিং’-এর নামে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ এবং দেশত্যাগে মানুষকে বাধ্য করার ঘটনা। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সেসব ঘটনার উপর তদন্ত চালিয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট দৈনিক জনকণ্ঠ প্রকাশ করেছিল। সেসব নারকীয় ঘটনাগুলো জনসমক্ষে সরকারের পক্ষ থেকে তুলে ধরা হয়নি। কোন মামলাও করা হয়নি। বিচার দূরে থাক। উল্লাপাড়ার পূর্ণিমার ঘটনা দেশবাসীর মধ্যে ঘৃণার আবহ তৈরি করলেও, সেই ঘটনাও চাপা পড়ে গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সরকার মামলা করবে না। ভুক্তভোগীরা চাইলে নিজেরা মামলা করতে পারে। কিন্তু যারা নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তাদের পক্ষে মামলা করার ক্ষেত্রে আইনী সহায়তা প্রদানেও কেউ এগিয়ে আসেনি। এভাবেই বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কেঁদেছে। যেমন কাঁদে পেট্রোলবোমায় নিহতদের স্বজনদের অন্তর। বিএনপিকে কানাডার আদালত দু’দফায় সন্ত্রাসী দল হিসেবে আখ্যায়িত করে রায় দিয়েছে। পেট্রোলবোমায় ঘটনায় অভিযুক্ত বিএনপির দুই কর্মী কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আদালতে মামলা করে। আদালত সব বিচার বিশ্লেষণ করে যে রায় দিয়েছে তাতে বিএনপি নামক সন্ত্রাসী সংগঠনটির এদেশে রাজনীতি করার অধিকার থাকে না। কানাডার ফেডারেল কোর্ট বলেছে, ‘বিএনপি সন্ত্রাসী কাজে লিপ্ত ছিল। লিপ্ত আছে বা লিপ্ত হবে এটি বিশ্বাস করার যৌক্তিক কারণ আছে। ‘এই সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা কানাডার ক্রিমিনাল কোডের ধারা তুলে ধরে বলেছিলেন, ‘বিএনপির ডাকা হরতাল বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। বিএনপি কর্মীদের হাতে মালামালের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও মৃত্যু এবং আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। লক্ষ্য করা গেছে, অতীতে কোন কোন ঘটনায় বিএনপির নেতৃত্ব নিজেদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছে এবং সন্ত্রাসী তৎপরতার নিন্দা করেছে। কিন্তু বিএনপির দাবি-দাওয়া সরকারকে মানতে বাধ্য করতে লাগাতার হরতালের কারণে সৃষ্ট সহিংসতা প্রমাণ করে এটি নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের বাইরে চলে গেছে। বিএনপির কর্মী হিসেবে আবেদনকারী কানাডায় প্রবেশাধিকার পাওয়ার অনুপোযুক্ত। কেননা এই দলটি সন্ত্রাসী কাজে লিপ্ত ছিল, আছে বা ভবিষ্যতে লিপ্ত হবে এমনটি ভাববার যৌক্তিক কারণ আছে।’ কানাডার আইনে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের যে সংজ্ঞা দেয়া আছে, তার আলোকে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতেই বিচারক হেনরি এস ব্রাউন আরও উল্লেখ করেছিলেন। ‘রাজনেতিক প্রতিবাদ হিসেবে বিএনপির হরতাল ডাকার পেছনে সুনির্দিষ্ট একটি উদ্দেশ্য ছিল এবং তা হচ্ছে বিশেষ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য অর্থনৈতিক কর্মকা- ব্যাহত করে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। এই হরতালে বিএনপি কর্মীদের দ্বারা অব্যাহত সন্ত্রাস সৃষ্টির ঘটনাও ঘটেছে। বিএনপি নেতৃত্ব হরতালে সহিংসতাকে নিরুৎসাহিত করেছে। তার সামান্যই প্রমাণ পাওয়া যায়। বিএনপি নেতৃত্ব একবারই সন্ত্রাসের নিন্দা করেছেন, যখন বাসে আগুন দিয়ে মানুষ পোড়ানোর দায়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। বিএনপি তার কর্মীদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের নিন্দা করেছে, তার কোন প্রমাণ এই আদালতের সামনে নেই।’ বিচারকের পুরো বক্তব্য উদ্ধৃত করা গেল না দীর্ঘ হয়ে যাবার কারণে এটা স্পষ্ট করে বলা যায় বাংলাদেশের সরকার বিএনপির বিরুদ্ধে কোন শক্ত অবস্থান নিতে আগ্রহী নয়। বরং মনে হয়, বিএনপির অনেক অপকর্মকেই আড়াল দিতে আগ্রহী। তাই ২০০১ সালের নারকীয়তা এবং ২০১৪, ২০১৫ ও ২০১৬ সালের নাশকতামূলক কর্মকা-ের জন্য তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই নেয়া হচ্ছে না। পঁয়তাল্লিশ দিন টানা অবরোধ চালিয়ে বেগম জিয়ার নেতৃত্বে দেশকে ধ্বংস করার জন্য যেসব সন্ত্রাসী ক্রিয়াকলাপ চালিয়েছে, সরকারী দল সেসব বিষয়ে কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। শুধুই বক্তৃতা বিবৃতিতে নিন্দা করার মধ্যেই প্রসঙ্গটিকে তুলে আনে। কানাডার আদালত যাকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া না হলে সন্ত্রাসের মাত্রা আরও বাড়তে বাধ্য। যা ঈদের পর শুরু হবে বলে বেগম জিয়ার হুংকারের পর আশঙ্কা জাগে দেশবাসীর মনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ছিলেন প্রফেসর আহমদ শরীফ। বিএনপি সম্পর্কে তার মূল্যায়নটি এখানে প্রণিধানযোগ্য। রাজাকার ও ইসলামপন্থীদের নিয়ে সেক্যুলার রাষ্ট্রকে ইসলামী ও মুসলিম আবরণে ও আভরণে সজ্জিত করে বাঙালী সত্তার ও মুক্তিযুদ্ধের অবমাননা করে বিজয়ের উল্লাস অনুভব করে বিএনপি। সন্ত্রাস ও নাশকতা চালিয়ে বিএনপি নামক দলটি অন্ধকারের পথে ধাবিত হওয়ার কারণে শান্তিপূর্ণ স্বাভাবিক আন্দোলন করায় ক্ষমতা ও সাহস হারিয়ে ফেলেছে। মাঠে নামার শক্তি আর নেই। বিলাস, আদর্শহীনতা তাদের এমনভাবে পেয়ে বসেছে যে, পথে নেমে লাঠি, টিয়ারগ্যাস খাওয়ার সাহস বিলুপ্ত প্রায়। বরং মনে করে বরং আদর্শ খুইয়ে ক্ষমতায় ফেরার ভ্রান্ত পথই ভাল। বেগম জিয়া যেহেতু এখনও বিশ শতকের রাজনৈতিক ধারায় রয়ে গেছেন। তাই কোন ধারণায়ই তার আসে না, দেশের কৃষক, শ্রমিক সাধারণ মানুষ হাসিনাকে কিভাবে ঘরের স্বজন মনে করে। মানুষের যত সমর্থন শেখ হাসিনার প্রতি বাড়ছে। ততই বিএনপি নেত্রী ঈর্ষান্বিত হচ্ছেন, তাই মানুষের ভালবাসা হারিয়ে বোমাবাজি, গুপ্তহত্যায় নেমেছিলেন। শুধু তাই নয়, যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্য সহিংসতার আশ্রয়ও নিয়েছিল বিএনপি। জনগণ তাদের হিংস্রতাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। বিএনপির বুদ্ধিজীবীরাও বলেছেন, দলের সব সিদ্ধান্ত বেগম জিয়ার উপর ছেড়ে দিয়ে দলটি ভুল করেছে। খালেদা জিয়া না থাকলেও দল চলবে। তবে উনি রাস্তায় না থাকলে বিএনপি কখনই ক্ষমতায় যাবে না। কিন্তু আন্দোলনের ঘোষণা দিলেও বেগম জিয়া রাজপথে নামবেন না। বোমা মেরে মানুষ হত্যা করে তিনি যে জনরোষের শিকার, সেখানে জনতার ভয়ে তিনি সেই সাহস আর সঞ্চয় করতে পারেননি বলে রাজপথকে ভয় পান। ঘরে বসে তিনি হুমকি-ধমকি দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে আসছেন। রাজনীতির যে একটা মানবিক মুখ রয়েছে। বেগম জিয়া সেই মুখ দেখতে পান না। বরং মানবিক মুখ এর উল্টো মুখটাকেই আলিঙ্গন করতে চান। বেগম জিয়া মহাসচিব তো ক’দিন আগেই ঘোষণা করেছিলেন, সুযোগ মতো আবার রাজপথে নামবে বিএনপি। জীবনের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাব। বিএনপির পক্ষ থেকে ‘রাজপথে যুদ্ধ করছি। এই যুদ্ধে সফল হবোই। তার এই বক্তব্য বেশ সাহসী বলে মনে হয়। কিন্তু বাস্তবে সন্ত্রাসীদের রাস্তায় নামিয়ে তারা যে পন্থা বেছে নিয়েছিলেন নাশকতার, তাকে যুদ্ধ বলে অভিহিত করার মধ্যে এক ধরনের বীরত্ব থাকলেও কানাডার আদালত একে সন্ত্রাসী বলেই অভিহিত করেছে। অথচ সরকারী দল এই বিষয়টিকে জনগণের সামনে তুলে ধরে না। এতে মনে হতে পারে, বর্তমান সরকার আসলেই বিএনপিবান্ধব। বেগম জিয়ার সন্ত্রাসী কর্মকা-ের প্রতিও তারা সহানুভূতিশীল। আর সম্ভবত সেই কারণে বেগম জিয়ার হাতে নানা তুরুকের তাস তুলে দেন। বিএনপিকে ভুল শোধরানোর জন্য চাপ প্রয়োগ করেন না তারা। চৌদ্দ দলের সভায় আওয়ামী লীগের উর্ধতন নেতা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনাকালে বললেন, সংবিধান অনুসারে শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন হবে। আবার এ কথাও বলেছেন, চেনা একটি মহল আবারও নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্রের খেলায় মেতেছে। কিন্তু এই খেলার সুযোগ কারা করে দিয়েছে। নেতার তো জানা যে, নির্বাচন সরকারের অধীনে হয় না গণতান্ত্রিক দেশে। এমনকি সরকার নির্বাচন পরিচালনাও করে না। নির্বাচন আয়োজন, ভোটগ্রহণ ফলাফল ঘোষণা সবই নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত। এই সময়ে যারা সরকারে থাকেন, তাদের অন্তর্বর্তী সরকার’ হিসেবে বিবেচ্য হন। রুটিন কাজ ছাড়া আর কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। নির্বাচনকালীন স্বতন্ত্র, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করবে বলে সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে। সরকারের অধীনে কেন নির্বাচন হবে? আওয়ামী লীগ তথা ১৪ দলের কতিপয় নেতার বক্তব্য বিভ্রান্তি যেমন ছড়িয়ে, তেমনি বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক, সহায়ক সরকার দাবিকে বাজারজাত করার সুযোগ এনে দেয়। সরকার ও রাজনৈতিক দলের কাজ নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করা। যে কাজ শেখ হাসিনা ও সরকারের নয়, আওয়ামী নেতারাও সেই কাজ কেন কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে বিএনপিকে উদ্বুদ্ধ করছেন কুহেলিকাময় পরিবেশ তৈরি করার জন্যই? জনগণ যাতে নির্বিঘেœ ভোট দিতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করা সব দলের দায়িত্ব। কিন্তু নির্বাচন পরিচালনার সব কাজই কমিশনের। অন্য কারও নয়, এটা সর্বজনবিদিত।
×