ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সুমিষ্ট অর্থকরী ফল লিচু

প্রকাশিত: ০৭:১৪, ১৮ জুন ২০১৭

সুমিষ্ট অর্থকরী ফল লিচু

রসাল ও সুস্বাদু ফল লিচুর বৈজ্ঞানিক নাম খরঃপযর পযরহবহংরং কথিত আছে- দক্ষিণ চীন থেকে লিচু নিয়ে সুদূর উত্তর চীনে অষ্টম শতকে চীনা সম্রাট হুয়ান সাংও লিচু উপহার দিয়ে বেগমের মন জয় করেছিলেন। তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে- লিচুর আদি নিবাস চীনে। বর্তমানে বিশ্বের বহু স্থানে লিচু চাষ করা হয়। ইতিহাস বিশ্লেষণে দেখা গেছে- বিশ্বের অনেক রাজা-বাদশাহ রানী-বেগমদের মন জয় করতে যুগে যুগে লিচু ফল উপহার দিতেন। হয়ত বা সে কারণেই লিচুকে বলা হয়া বিশ্বের সবচেয়ে রোমান্টিক ফল। যতদূর জানা যায়, প্রায় দুই হাজার বছর ধরে ফলটি এ মর্যাদা পেয়ে আসছে। বাংলাদেশের সব স্থানেই লিচু হয়, তবে উত্তরবঙ্গের রাজশাহী ও দিনাজপুর অঞ্চলের ফলন ভাল হয়। কিশোরগঞ্জ জেলার মঙ্গলবাড়িয়ার লিচু বড় আকার ও সুস্বাদের জন্য খুব জনপ্রিয়। ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে লিচুগাছে ফুল আসে ও মে-জুন মাসে লিচুর পাকা ফল সংগ্রহ করা হয়। সাধারণত লিচুগাছে তিন থেকে ছয় বছর পর ফল ধরে। তবে ২০-৩০ বছর বয়স পর্যন্ত লিচুগাছে ফলন বাড়তে থাকে। সাধারণত প্রতিটি গাছ থেকে বছরে ৮০-১৫০ কেজি বা ৩২০০-৬০০০টি লিচু পাওয়া যায়। লিচুর পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা ব্যাপক। এটি চাহিদা সম্পন্ন ফল; বিধায় চাষের মাধ্যমে সহজেই বাড়তি মুনাফা অর্জন সম্ভব। লিচুর এ্যান্টিঅক্সিডেন্টা ব্রেস্ট ক্যানসার নিরাময়ে সহায়তা করে, হার্ট ভাল রাখে এবং চোখে সহজেই ছানি পড়তে দেয় না। লিচুতে থাকা অলিগনাল নামক বিশেষ উপাদান নাইট্রিক এসিড উৎপাদন করে যা, শরীরে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখে। হজম ক্ষমতার উন্নতি ঘটাতে লিচুর ভূমিকা অনেক। বিজ্ঞানীরা নানা জাতের লিচু উদ্ভাবন করেছেন। দেশে যেসব জাতের লিচু পাওয়া যায় সেগুলো হলোÑ বোম্বাই, মাদ্রাজি, চায়না-৩, মঙ্গলবাড়ি, মোজাফ্ফরপুরী, বেদানা লিচু, বারি লিচু-১, বারি লিচু-২, বারি লিচু-৩ ইত্যাদি। বোম্বাই লিচু টকটকে লাল, মাদ্রাজি আগাম জাত, সবচেয়ে ভাল জাত চায়না-৩। এই জাতের গাছে প্রতি বছরই ভাল ফল ধরে। বেদানা নাবী জাত। বারি লিচু-১ আগাম জাত, বারি লিচু-৩ মাঝ মৌসুমি জাত। কিন্তু বারি লিচু-২ নাবী জাত। লাগানোর জন্য এসব জাত থেকে যে কোন জাত নির্বাচন করা যেতে পারে। সাধারণত লিচুগাছে তিন থেকে ছয় বছর পর ফল ধরে। দিনাজপুর জেলা লিচুর জন্য বিখ্যাত। এ জেলায় বাংলাদেশের সেরা লিচু উৎপন্ন হয়। জ্যৈষ্ঠ মাসের মধু ফল হিসেবে দিনাজপুরের লিচু সবার কাছে পছন্দের। দিনাজপুরের বিরল উপজেলার মাধববাটি, করলা ও মহেশপুর গ্রামের প্রত্যেক কৃষকেরই রয়েছে একাধিক লিচু বাগান। এসব বাগানে বেদানা, চায়না-থ্রি ও বোম্বাই জাতের উৎকৃষ্ট লিচু চাষ করে চাষীরা প্রতিবছর লাখ লাখ টাকা আয় করছেন। এ তিন গ্রাম থেকে প্রতিবছর প্রায় ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকার লিচু বিক্রি হয়। দিনাজপুরের ৩ হাজার ২০০ হেক্টর জমি থেকে চাষীরা এ বছর প্রায় ১৫০ কোটি টাকার লিচু বিক্রি করেন। গ্রাম তিনটিতে আনুমানিক ৮০০ থেকে ৯০০ একর জমিতে লিচু বাগান রয়েছে। ঈশ্বরদীতে এবার ২ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে লিচুর চাষ হয়। মৌলভীবাজারে পাহাড়ী টিলাবেষ্টিত এলাকা থাকায় এখানে এই ফসলের ফলন হয় বেশি। মৌলভীবাজার শহরতলির বর্ষীজোড়া এলাকা উঁচু-নিচু পাহাড়ী টিলায় টিলায় গড়ে উঠেছে লোকালয়। জানা যায়, মৌলভীবাজার শহরতলির, সোনাপুর, বর্ষীজোড়া নতুনবাজার, বাংলাটিলা, সালামি টিলা, বড়টিলা, মাতারকাপন এলাকায় জাল দিয়ে আচ্ছাদিত করে রাখা হয়েছে ছোট আকারের লিচুতে ভরা গাছ। এ লোকালয়ে লিচু হয়ে উঠেছে এ এলাকার মানুষের জীবন-জীবিকার প্রধান অবলম্বন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, জেলার সদর উপজেলা, শ্রীমঙ্গল, কুলাউড়া, জুড়ী বড়লেখা, রাজনগর ও কমলগঞ্জ উপজেলার মোট ২৮০ হেক্টর জমিতে লিচু চাষ করা হয়। গত বছর উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ১৬ টন। যার বাজারমূল্য ছিল প্রায় ২৮ কোটি টাকা। এবার বিভিন্ন নামের লিচুর মধ্যে চায়না-৩, বোম্বে, মঙ্গলবারি, বারি-৩, ৪, বেদানাসহ দেশী প্রজাতির লিচু চাষ করা হয়েছে। গাজীপুরের লিচু যাচ্ছে ইউরোপ মধ্যপ্রাচ্যে। এ অঞ্চলের ভাওয়াল পরগনার লালমাটির পাহাড় ও লালমাটির সমতল ভূমিতেও লিচুর আবাদ বেশি হয়। উপজেলার শীতলক্ষ্যা নদী ঘেঁষা দুর্গাপুর ইউনিয়নের ২৮টি গ্রামে সবচেয়ে বেশি লিচুর চাষাবাদ হয়। গাজীপুরে উৎপাদিত লিচুর মধ্যে সবচেয়ে সুস্বাদু ও প্রকৃতির আসল ফ্লেবার যুক্ত কাপাসিয়ার লিচু এখন দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি হচ্ছে- সৌদি আরব, দুবাই, কাতার, বাহরাইন, কুয়েত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া ও মালদ্বীপ।
×