ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সোহেল তানভীর

ক্যাম্পাসে ইফতার আয়োজন

প্রকাশিত: ০৭:১২, ১৮ জুন ২০১৭

ক্যাম্পাসে ইফতার আয়োজন

সূর্য পশ্চিম দিগন্তে হেলে কেবল বিকেল হয়ে আসছে। এরই মাঝে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সবুজ চত্বরে দলবদ্ধ হয়ে ছোট-বড় জটলা পাকিয়েছেন হাজারো তরুণ-তরুণী। কেউ ইফতার কিনে আনছেন, কেউবা আনছেন পানি আবার কেউ সবুজ মাঠে পেপার বিছিয়ে বসার ব্যবস্থা করছেন। তাদের হাতে যেন দুমিনিট দাঁড়ানোর সময় নেই। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অথবা এফএম রেডিও শুনে চলে ক্ষণ গণনা। রমজানে মাগরিবের আজানের আগ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণকেন্দ্র টিএসসি সবুজ চত্বরে হাজার হাজার তরুণ-তরুণী ইফতারের মহোৎসবে মেতে ওঠার নিত্যনৈমিত্তিক দৃশ্য এমনটিই। রমজান ও গ্রীষ্মকালীন ছুটি থাকায় অনেকে ক্যাম্পাস ছেড়ে নাড়ির টানে পাড়ি জমিয়েছেন। কিন্তু যাদের খ-কালীন চাকরি, রাজনীতি, টিউশনি ও পরীক্ষা আছে তারা এক প্রকার নিরুপায় হয়ে এখনও ক্যাম্পাসে রয়েছেন। দীর্ঘ দেড় মাসের ছুটিতে ক্যাম্পাস কেমন যেন ফাঁকা হয়ে পড়েছে। কিন্তু বেলা গড়িয়ে ইফতারের সময় আসলে ক্যাম্পাস বন্ধ বলে মনে হয় না। ইফতারকে কেন্দ্র করে যেন উৎসবের চাদরে ঢেকে যায় পুরো ক্যাম্পাস। বেলা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান অনেকে আসে ইফতার করতে। রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও ভিড় জমায় এখানে। আসে বিভিন্ন বয়স ও শ্রেণী-পেশার মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে। এ ছাড়া এলাকাভিত্তিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনও ইফতার পার্টির অয়োজন করে থাকে। ইফতারের সময় তিল ধারণের জায়গা থাকে না টিএসসির ভেতরে ও বাইরে। বেলা ঘনিয়ে আসা থেকে শুরু হয় ইফতারের প্রস্তুতি। তাদের প্রথম কাজ টিএসসির ভেতরের মাঠে জায়গা দখল। আয়তনের তুলনায় জনসমাগম বেশি হওয়ায় অনেকে বসে পড়েন ভেতরে এবং বাইরের করিডরে। এরপর দলবদ্ধ হয়ে গোল করে বসে সবাই। কোন দলে চারজন আবার কোন দলে বিশ থেকে ত্রিশ জন। সামনে থাকে বাহারি রকমের ইফতার সামগ্রী। সবুজ মাঠে পত্রিকা বিছিয়ে চলে বিভিন্ন আইটেম মাখানোর কাজ। এই আয়োজনে থাকে মুড়ি, ছোলা, খেজুর, জিলাপি, বেগুনি, পেঁয়াজু, চিকেন চপ, পাকুড়া, বুরুন্দা, আলুর চপ ইত্যাদি। থাকে বিভিন্ন রকমের পানীয়, জুস, কলা, আপেলসহ নানা জাতের ফল। জনপ্রতি চাঁদা তুলে চলে ইফতারের এ মহান আয়োজন। আবার অনেকে হল অথবা বাসা থেকে রান্না করে নিয়ে আসেন বন্ধুবান্ধবকে খাওয়াতে। এসব ইফতার পার্টিতে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ করা হয়। ইফতারের আগে সেরে নেয়া হয় নিজেদের সংগঠন, কর্মপন্থা, সমস্যা এবং সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, প্রত্যেকের হাতে খাবারের প্যাকেট, পানির বোতল এবং বসার জন্য খবরের কাগজ। যে যার মতো ঘাসের সবুজ চত্বরে জায়গা নিয়ে বৃত্তাকার হয়ে বসছে। প্যাকেট খুলে মাঝখানে সাজানো হচ্ছে নানা রকম ইফতারি। ছোলা, মুড়ি, চপ, খেজুর, জিলাপি, বেগুনি, পেঁয়াজু, বুন্দিয়াসহ নানা পদ। সারাদিনের তৃষ্ণা মেটানোর জন্য আছে লেবুর শরবত কিংবা আমের জুস। আরও আছে আপেল, কলাসহ নানা ফল। ইফতার সাজিয়ে আজানের জন্য অপেক্ষা। সময় যেন কাটে না। বন্ধুদের সঙ্গে কথার ফাঁকে চোখ চলে যায় ঘড়ির কাঁটায়। টিএসেিসত ইফতার করতে আসা ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল ফারিয়াল বলেন, গ্রামে যখন পড়াশোনা করতাম তখন আব্বু-আম্মুর সঙ্গে একসঙ্গে ইফতার করতাম। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে আসার পরে পরিবার-পরিজন নিয়ে ইফতার করার সুযোগ তেমন একটা হয়ে ওঠে না। ক্যাম্পাসের বন্ধু ও এলাকার বড় ভাইয়া-আপুদের সঙ্গে ইফতার করে যেন পরিবারের সঙ্গে ইফতারের স্বাদ পাচ্ছি। সবাই মিলে আড্ডা, মজা-মাস্তি ও ইফতার করে যেন পরিবারে ইফতার করার সেই বেদনা একটু হলেও লাঘব হয়। টিএসসিতে নিয়মিত ইফতার করতে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে শিক্ষার্থী তানিয়া সুলতানা নিশাত বলেন, রমজানের প্রথম দিন আব্বু-আম্মু ছাড়া ইফতার করতে খুব খারাপ লাগছিল। নিয়মিত বন্ধুদের সঙ্গে টিএসসিতে ইফতার করছি বলে সেই কষ্টটা আর এখন ফিল করি না। ইফতারের জন্য এ রকম হাজারো তরুণ-তরুণীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের প্রিয় স্থান টিএসসি। এ ছাড়াও বিশ^বিদ্যালয়ের কলাভবন, ডাকসু কাফেটারিয়া, কার্জন হল, ব্যবসা শিক্ষা অনুষদের দৃশ্য প্রায় একই রকম। ইফতার শেষে হাজারো জমানো কথার ফুলঝুরিতে চলে চুটিয়ে আড্ডা। ঢাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী সুমন আহমেদ বলেন, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে একত্রে ইফতার করার মজাই আলাদা। তাই প্রতিদিন এখানে এসে ইফতার করতে চেষ্টা করি। ইফতার শেষে গল্পে গল্পে সময় কাটাতে ভাল লাগে। টিএসসির ইফতারের বৈচিত্র্য হলো এখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই একত্রে ইফতার করে। বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন স্থান থেকে পড়তে আসে দেশের সর্বোচ্চ এই বিদ্যাপীঠে। দেশের সব ধরনের সংস্কৃতিক বৈচিত্র্যও লক্ষ্য করা যায় এখানে। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টানসহ বিভিন্ন ধর্মের শিক্ষার্থীরাও মুসলিম বন্ধুদের সঙ্গে যোগ দেন নিত্যদিনের এ ইফতার আয়োজনে। এসব ইফতার আয়োজনের মাধ্যমে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ব আরও দৃঢ় হয় বললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নিখিল চন্দ্র। তিনি বলেন, ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে আমি সর্বজনীন দিক থেকে দেখি। রমজানে ধর্মের ভেদাভেদ না করে ইফতার, আড্ডা আর গল্প একটি আন্তঃধর্মীয় বলয় তৈরি করে এবং আমাদের মাঝে পারস্পরিক সম্প্রীতি আরও দৃঢ় করে। ইফতারের এ মিলনমেলাকে কেন্দ্র করে বিশ^বিদ্যালয়ের টিএসসি, সড়ক দ্বীপ, মিলন চত্বর, হাকিম চত্বর, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটসহ আশপাশের এলাকায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য অস্থায়ী দোকান। দুপুর থেকেই ইফতার সামগ্রীর পসরা সাজিয়ে বসেন দোকানিরা। রমজানে সকালে বেচাকেনা না হলেও দুপুর থেকে শুরু হয় তাদের কর্মব্যস্ততা। সন্ধ্যা যত ঘনিয়ে আসে তাদের যেন দম নেয়ার সুযোগ থাকে না। দোকানগুলোতে ভিড় জমায় অসংখ্য ক্রেতা। ইফতারের সময় হওয়ার আগেই বিক্রি হয়ে যায় ইফতার সামগ্রী। ইফতারকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পাসের মিলনায়তনগুলোও সরগম থাকে সর্বদা। সবচেয়ে বেশি জমে ওঠে শুক্রবার। ছুটির দিন থাকায় অনেকেই পরিবারসহ সময় কাটাতে আসেন এখানে। ফলে এদিন সন্ধ্যায় যেন বসে ইফতারের মহামেলা। হাকিম চত্বরের ইফতারি বিক্রেতা বেলাল হোসেনের বলেন, অন্য সময় সারা দিন বেচাকেনা করলেও রমজান মাসে দুপুর থেকে শুধু ইফতারি বিক্রি করি। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অগণিত ক্রেতা আসে। স্বাস্থ্যসম্মত বিভিন্ন আইটেমের ইফতার সামগ্রী তৈরি করার চেষ্টা করি। টিএসসির ইফতারের আরেকটি দিক হলো এখানে খাবার পায় পথশিশু এবং ছিন্নমূল মানুষেরা। হাতে বাটি অথবা পলিথিন ব্যাগে তারা খাবার সংগ্রহ করে। ইফতার পাবার আনন্দ ওদের যেন একটু বেশিই। রমজান মাসজুড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইফতারের এই অনুষ্ঠান পুরো ক্যাম্পাসকে করে তোলে প্রাণবন্ত। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী শফিকুল ইসলাম বলেন, টিএসসিতে ইফতার করাটা একটু বৈচিত্র্যময়। এলাকার বড় ভাই-আপুদের সঙ্গে ইফতার করে খুব ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে যে নিজ পরিবারের সঙ্গে ইফতার করছি। এসব অনুষ্ঠান আমাদের মাঝে পারস্পরিক বন্ধন আরও দৃঢ় করে।
×