ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অরুণ কুমার বিশ্বস

রম্যকথন ॥ মরুচারী এক উটের কথা

প্রকাশিত: ০৩:৫৫, ১৮ জুন ২০১৭

রম্যকথন ॥ মরুচারী এক উটের কথা

গোড়াতেই বলে রাখি, উট আর উটপাখি যেমন এক নয়, সুখ আর অসুখের অনুপস্থিতিতেও তেমনি বিস্তর ফারাক বিদ্যমান। অনেকে আপনমনে সৃজিত সুখে সহাস্যে মুখব্যাদান করেন ও বগল বাজান। চাই কি সুখের আতিশয্যে ক্লান্ত হয়ে নুয়ে পড়েন পাখির পালকে প্রস্তুত দামী বিছানায়। এদের সুখের অবধি নেই। কারণ তারা স্বভাবে ভীতু, দলকানা বা দলদাস। অনেক কিছুই তারা দেখেও দেখে না, শুনেও শোনে না। যেন তারা ভূমিপুত্র নয়, অন্তরীক্ষের অধিবাসী। কবি যতই বলুন, অন্ধ হলেও প্রলয় বন্ধ থাকে না, কিন্তু এই শ্রেণীর ধারক ও বাহকেরা নাক-চোখ বন্ধ করে শুয়ে-বসে সময় কাটিয়ে দেন। অনেকটা সেই চোরাকাকের মতো, যে কিনা চোখ বুজে উনুনের পিঠ থেকে মরিচ লুকিয়ে খাচ্ছে আর ভাবছে কেউ তাকে দেখছে না। কারণ তার নিজেরই চোখ বন্ধ, তাই বাস্তবতা বিষয়ে তার কোন ধারণাই থাকে না। এই বৈরী সময়ে আদতে সুখী হওয়ার মতো কোন উপকরণ-উপাচার নেই। বাজারে যাবেন, নিত্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম যেন আকাশ ছুঁয়েছে। এক শ’ টাকা কেজির মাছ এখন আড়াই শ’-তে বিকোয়। পঞ্চাশ টাকা কেজির নিচে কোন আনাজপাতি পাওয়া যায় না। বিক্রেতা এখন বড্ড চুজি। যাকে তাকে সে পণ্য বেচে না। দাম বলার আগে দেখে নেয়, এ খদ্দের সত্যি সত্যি কিনতে পারবে তো! সবখানেই আপোসকামিতা। সংসার ছোট করে, ছেঁটে দাও নিত্যদিনের চাহিদা, দুধের বদলে ঘোল খাও, গোটা ডিম নয়, চারভাগ কর- এসব এখন ‘বাজ-ওয়ার্ড’। শুনতে শুনতে কান পচে গেছে মাইরি! ফায়েজ এই সমাজের প্রতিভূ। তার কামাই কম, তবে সুখের অভীপ্সা বেশি। একখানা কাঁথায় সে পুরো সংসার ঢেকে নিয়েছে। গিন্নি বলল, তেল লাগবে, এনো কিন্তু। ফায়েজ অবিশ^াসের চোখে তাকিয়ে বলল, সত্যি লাগবে! আর দুটো দিন চালিয়ে নেয়া যায় না! মাসের বেতন এখনও পাইনি। তার বক্তব্য, তেল না থাকলে নেই। দুটো দিন অন্তত জোড়াতালি দিয়ে চালিয়ে নাও। বেতন না-পাওয়া অব্দি না হয় ভাজি-তরকারি না খেলাম। কী খাবে তাহলে! বিরক্ত ও বেজার হন গিন্নি। কেন, আলুভর্তা বা ঢেঁড়স! আচ্ছা, তেলছাড়া কাঁচা আমের চাটনি হয় না! তুমি চাইলে বেগুনপোড়াও করতে পার। তাতে তেল লাগে না। তেল ছাড়া খেলে নিজেকে বেশ আঁতেল আঁতেল ঠেকবে। অমনি ঘচাঘচ চারখানা প্রেসক্রিপশন লিখে দেয় ফায়েজ। তাতে বিনাতেলেই পেট ভরবে বলে আশা করা যায়। এর নাম আপোসরফা বা উটের বালিতে মুখগুঁজে থাকা। বস্তুত সময় এসেছে এখন চোখ-কান-মুখ সব বন্ধ করে রাখার। বেশি কিছু বলতে যাবেন তো আপনার দফা রফা হয়ে যাবে! বাংলা ব্যাকরণে কিল খেয়ে কিল চুরি বলে একটি কথা আছে। ফায়েজের হয়েছে সেই দশা। কিল খাবে অথচ সে বলতে পারবে না। কষ্টসূচক উঃ করলে বলবে তুমি উঃ করলে কেন! ব্যথা লাগছে যে! ফায়েজ মরিয়া হয়ে বলে। লাগছে লাগুক। এর চেয়ে কঠিন কষ্ট নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকে। আরাম-আয়েশের কোন দরকার নেই, বেঁচে থাকাটাই এখানে শেষকথা, বুঝলে! বসের প্রশ্নের উত্তর দিলে বলবে, তুমি বেশি কথা বল ফায়েজ। আর ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে থাকলে রামধমক- জাউভাত খাও! মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না কেন? বলুন তো, ফায়েজ এখন যায় কোথায়! লাগাতার বালুঝড় এখন। যেদিকে তাকাই শুধু দেখি উলোট-পালট। সেই ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের পাঁয়তারা। সেখানে ফায়েজের প্রবেশাধিকার নেই। ওটা বড়দের কারবার, তোমার জন্য স্রেফ সেরেলাক ফায়েজ। মুখে চুষিকাঠি পুরে চুপচাপ পড়ে থাক হে। নইলে নিপাত যাও। তোমার পতন কেউ ঠেকাতে পারবে না। বড়দের কিছু কিছু বিষয় ফায়েজের ঠিক বোধগম্য হয় না। গিন্নি সব শুনে বলে, তাক তেরে কেটে তাক, চেপেচুপে রাখ। শুধু দেখে যাও বা শুনে যাও। কোন রকম প্রতিক্রিয়া নয়। ওরা কোন বিরুদ্ধমত শুনতে চায় না, সহ্য করা তো দূর কি বাত! স্রেফ ইয়েসম্যান চায়, মোসাহেব। হুজুরের মতে অমত কার! চমৎকার! ফায়েজ আপাতত গোঁজামিল দিয়ে চলছে। সবখানে আপোসরফা। দুটাকা মাইনে, তার উপর আবার করের ঘা আছে। মাছ যতই চুনোপুঁটি হোক, করের আওতার বাইরে থাকছে না কেউ। সরকারের টাকা দরকার। কে দেবে? না, আজকাল আর গৌরিসেনরা নেই, তোমাকে-আমাকেই দিতে হবে! নইলে উন্নয়ন-উত্তরণ সব থেমে যাবে যে! ফায়েজের খুব বলতে ইচ্ছে করে, উন্নয়ন ধুয়ে পানি খেলে হবে! আমার ছেলে যে স্কুলে পড়তে পারে না। মেলা টাকা লাগে। তাও আবার ফি-বছর প্রশ্নফাঁস হয়, কিছু তো শিখছেও না! এই ছেলে বড় হয়ে কী করবে! ভিক্ষা, নাকি চুরি-বাটপাড়ি! এই চোপরাও। গিন্নি মনে করিয়ে দেয়। ওরা প্রচুর শিক্ষিত লোক চায়, নামদস্তখত করতে পারলেই হয়। জজ-ব্যারিস্টার চাই না। ওরা কথা বেশি বলে! তাতে ক্ষমতার খুদ-কুঁড়ায় টান পড়ে। কথা বেশি না, শুধু ক্ষমতাধরদের মোসাহেবি করে যাও, আখেরে ইনাম পাবে। গ্যাসের দাম বাড়ল যে! এবার কী করি! মহা মুসিবতে ফেঁসে যায় ফায়েজ। ছাপোষা কেরানি কি না! শুনেটুনে বস খেঁকিয়ে ওঠেন- কেরানির আবার খানাদানা কিসের! গ্যাসের বদলে চেলাকাঠ আন। ধোঁয়া হবে স্যার। পরিবেশ দূষণ! তাতে আপনার শ^াসকষ্ট হবে। ফায়েজ মিনমিনে গলায় মনে করিয়ে দেয়। ও তাই তো! তাহলে চেলাকাঠ নয়, মুড়ি কিনে খাও। তাতে গ্যাস বা উনুন কোনটাই লাগবে না। মুড়ি স্বাস্থ্যের পক্ষে অতিশয় উপকারী। বস বজ্রনির্ঘোষ শোনান। গিন্নি শুনে বেজায় হাসে। সত্যি তোমার উপরঅলার কোন জবাব নেই। শুধু তাকে সবিনয়ে শুধিও, মুড়ি খেয়ে কতদিন চলেÑ একদিন দু’দিন বা একহপ্তা! বেশি বেশি মুড়ি খেলে পিত্ত পড়বে যে! আমাশয় হবে। তখন অফিসে গিয়ে কলম পিষবে কে, আপনার বড়কুটুম! ফায়েজ কথা না বাড়িয়ে মেনে নেয়। বেঁচে থাকাটাই যেখানে শেষকথা, আপোস করে হোক বা নিজেকে শাস্তি দিয়ে, টিকে তো থাকতে হবে! যারা ক্ষমতার খুঁটি বগলে নিয়ে হাঁটেন, তাদের কথা আলাদা। তারা ভিনগ্রহচারী, পৃথিবীর নয়। বস্তুত শুধু খাওয়া-পরা নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এক রকম আপোসের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। এই কালচারে যারা অভ্যস্ত, তারা উটপাখির মতো বালিতে মুখগুঁজে সময়টা কোনমতে পার করছে। তাতে বাঁচার আনন্দ না থাকলেও টিকে আছে বৈকি। শরৎচন্দ্রের সেই উপন্যাসের মতো বলতে হয়, ‘অতিকায় হস্তি লোপ পাইয়াছে, তেলাপোকাটি টিকিয়া আছে।’ আমরাও আসুন, ফায়েজের মতো মরে না গিয়ে টিকে থাকি, মূক-মূঢ় ও বধির হয়ে, গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিই। লেখক : কথাসাহিত্যিক
×