ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

একুশ শতক ॥ স্বর্ণ খনির বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৩:৫৪, ১৮ জুন ২০১৭

একুশ শতক ॥ স্বর্ণ খনির বাংলাদেশ

॥ এক ॥ বেসিস নামক তথ্যপ্রযুক্তির বহুল আলোচিত একটি বাণিজ্য সংগঠনের সভাপতি হিসেবে গত বছরের শেষ প্রান্তে তাইওয়ানের তাইপেতে এ্যাপিক্টা এ্যাওয়ার্ডে বিচারক হওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। আমরা পাঁচজন বিচারক ছিলাম। আমাদের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছিল বিষয় বাছাই করার। আমি নিজেই স্কুল শাখা বেছে নিয়েছিলাম। দেখার ইচ্ছা ছিল এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ছাত্রছাত্রীরা তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে কি ভাবে, কি উদ্ভাবন করে এবং কেমন করে সেগুলো উপস্থাপন করে। দেখেছিলামও তাই। ওই অঞ্চলের তারুণ্য তথ্যপ্রযুক্তির উদ্ভাবনে কি করছে, কি ভাবছে, কিভাবে ভাবছে সেটিই দেখছিলাম। সব দেশের ছেলে মেয়েদেরই দারুণ সব উদ্ভাবনা। ঘটনাচক্রে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো অংশ নেয় বলে আমাদের দলে নিজেদের কোন টিম ছিল না। বিচারক হিসেবেই আমার দেখা হয়েছিল ব্রুনাই দারুস সালামের ১৪ বছরের কিশোর ফয়সালের সঙ্গে। আমরা ৫ দেশের পাঁচ বিচারক ফয়সালের ৩০ মিনিটের উপস্থাপনা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলাম। এটির কারণ হয়ত এমন যে, এই বয়সের কোন কিশোরের কাছ থেকে এত প্রাণবন্ত উপস্থাপনা শুনব বলে আমরা আশা করিনি। ফয়সালের মতোই আরও যেসব কিশোর-কিশোরী তাদের প্রকল্প উপস্থাপন করেছিল তাদের মানও আমাকে চমকে দিচ্ছিল। আমি ভাবছিলাম এমন একটি উৎসব আমরা বাংলাদেশে আয়োজন করলে তখন থাইল্যান্ডের কিশোরী বা ব্রুনাইয়ের ফয়সালের মতো টিম কি আমরা নিজেরা তৈরি করতে পারব? মনে মনে আশা ছিল যে হয়ত পারব। আমাদের ছেলেমেয়েরা তো প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় ভারতসহ দুনিয়ার তাবত বড় দেশগুলোকে হারায়। দেশে যেসব প্রতিযোগিতা হয় বা যেসব উদ্ভাবনী কর্মকা- হয় তাতে আমাদের পক্ষ থেকে একটি বড় ধরনের উদ্ভাবনী দল উপস্থাপন করা তেমন কঠিন হওয়ার কথা নয়। এখন যখন সেই সময় থেকে বেশ কিছুটা পথ পার হয়ে এসেছি তখন নতুন করে স্বপ্ন দেখার সময় হয়েছে। আমি বাঙালীর অতীতের কথা উল্লেখ করতে চাই না। বাঙালীর মেধার কথাও উল্লেখ করতে চাই না। তবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, বাঙালীর এই দেশটি যার নাম বাংলাদেশ, সেটি একটি স্বর্ণের খনি। আর স্বর্ণ হলো এ দেশের মানুষ। এমনই করে আমরা ভাবি যে ৭২ সালে হেনরি কিসিঞ্জার যে দেশটিকে তলাহীন ঝুড়ির দেশ বলেছিল তার কী সম্পদ আছে? না, বাংলাদেশে আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য বা জোহানেসবার্গের মতো কোন স্বর্ণের খনি নেই। এদেশে গ্যাসের খনিও ফুরিয়ে যাবার পথে-স্বর্ণ পাব কই। দেশটা ছোট। চাষের জমিও কমছে। যে পরিমাণ মানুষ, তাদের খাবার চাষ করাও বিশাল চ্যালেঞ্জ। বরং এই দেশে স্বর্ণের খনির বদলে আছে কেবল মানুষ। এত কম জায়গাতে এত মানুষ আমাদের যে, ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। খাবারের জন্য জায়গা তো দূরের কথা এক সময়ে আকাশ অবধি উপরে উঠেও থাকার জায়গা গড়ে তুলতে পারব কিনা জানি না আমরা। বঙ্গপোসাগরের বাংলাদেশটা জেগে উঠলে হয়ত একটু স্বস্তি পাব। আগে তো ভাবতাম, বাঙালীদের প্রবাসী বানিয়ে দেব, দেশে জায়গা না থাকলেই কি? কিন্তু এখন তো মনে হয়, কাজে প্রবাসী হলেও বসবাস বাংলাদেশেই করতে হবে। এর মানেটা সহজ; এই দেশের মানুষকেই স্বর্ণের বিকল্প ভাবতে হবে। একেই আমরা বলি বাংলাদেশটা স্বর্ণের মানুষের খনি। আমি নিজে বিশ্বাস করি আমাদের প্রতিটি সন্তান স্বর্ণের টুকরো বা হীরার টুকরো। দেশের ৮ কোটি মানুষ ২৫ বছরের নিচের। এর মাঝে প্রায় ২ কোটি শিশু। এই শিশুদের দেখলে আমার কেবলই ফুলের মতো মনে হয়। কয়েকজনকে একসঙ্গে দেখলেই ফুল বাগান মনে হয়। ওরা যে দেখার চাইতেও সুন্দর তার প্রমাণও আমি প্রায় প্রতিদিনই পাই। একটি প্রমাণের কথা আমি কখনও ভুলতে পারি না। ২০১৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলার আরবান একাডেমিতে প্রথম শ্রেণীর ৩৯টি শিশুকে আমি বিজয় প্রাথমিক শিক্ষাসহ উইন্ডোজ ১০ ট্যাব দিয়েছিলাম। ওরা হচ্ছে গ্রামের এমন শিশু যারা জীবনে কম্পিউটার দেখেনি। ১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সেই শিশুদের দেখতে গিয়ে আমার চোখ কপালে ওঠে। ওরা সবগুলো ট্যাবের ইউজার নেম ও পাসওয়ার্ড বদল করেছে এবং ১২ মাসের লেখাপড়া এক মাসে শেষ করেছে। আমাদের জন্য তাই এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে আমাদের স্বর্ণের মানুষগুলোকে আমরা স্বর্ণ হিসেবে গড়ে তুলতে পারি কিনা। এই নিবন্ধে আমি এমন একটি স্বর্ণের টুকরোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব যে আপনি নিজেই ওকে নিয়ে গর্ব বোধ করবেন। গত শুক্রবার ২৪ মার্চ ১৭ ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার। আগে থেকেই আমাকে বলে রাখা হয়েছিল যে এটুআই-এর সলভেথন প্রতিযোগিতায় অন্যতম বিচারক হতে হবে। শুক্রবারে সচরাচর আমি দেরি করে উঠি। সেদিন সে সুযোগ ছিল না। দশটাতেই পৌঁছে গেলাম জাতীয় বিজ্ঞান জাদুঘরে। সাড়ে দশটার দিকে আমরা প্রতিযোগিতায় আগত প্রকল্পগুলো দেখা শুরু করি। মোট ৩৫টি প্রকল্প। সারাদেশ থেকে আসা প্রকল্পগুলো নানা বিষয়ের, নানা প্রযুক্তির। প্রকল্পগুলো দেখতে দেখতে আমরা যখন প্রায় ক্লান্ত তখনই চোখে পড়ল এক কিশোরকে যার গোঁফও ভাল করে গজায়নি। সঙ্গে টুপি পরা পাকা দাড়িওয়ালা একজন লোক। বুড়ো মানুষটির দিকে তাকাতেই তিনি বললেন, আমি আজমাইনের নানা। বগুড়ার জেলা স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র আজমাইন আকমাল নানার হাত ধরেই এসেছিল এটুআই-এর সলভেথন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে। ৩৫টি প্রকল্পের মাঝে সর্বকনিষ্ঠ এই কিশোর এসেছিল একটি রোবট নিয়ে। এর আগে আমি নানা ধরনের রোবট দেখেছি বুয়েট বা অন্য বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে। বিদেশের ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে তৈরি রোবটও দেখেছি। বাংলাদেশের সপ্তম শ্রেণীর কোন ছাত্রের নিজের হাতে তৈরি করা কোন রোবট এই প্রথম দেখলাম। আজমাইনের কাছে জানতে চাইলাম কি করবে এই রোবট। সে খিলগাঁওয়ে পাইপের ভেতরে আটকে পড়া একটি শিশুর কথা জানাল। তার মতে একটি রোবট এমন একটি শিশু যে পাইপ বা ম্যানহলে আটকে যেতে পারে তাকে উদ্ধার করবে। একজন মহিলা বিজ্ঞানীসহ আমরা ৫ জন বিচারক মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার কথাগুলো শুনলাম। ১৪ বছর বয়সী এই ছেলে তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে এমন একটা আস্থা আমরা পেলাম। আমি ওর কাছে জানতে চাইলাম, দুনিয়াতে এমন রোবট আর কেউ বানাতে পারেনি? তার মতে, ভারতের কেউ একজন বানিয়েছিল। তবে সেটি শিশুটিকে উদ্ধার করার বদলে ক্ষতিই করে ফেলতে পারে। ইউটিউবে ভারতীয় রোবটের বিবরণ দেয়া আছে। যে কেউ ইচ্ছে করলে এই লিঙ্ক থেকে একটি ভিডিও দেখে নিতে পারেন। . সেদিন আমরা এটুআইয়ের প্রকল্প হিসেবে আজমাইনের রোবটকে সর্বসম্মতিক্রমে বাছাই করেছি। আশা করি এটুআইয়ের সহায়তায় আজমাইন তার স্বপ্নের রোবটটি বানাতে পারবে। সেদিনের উপস্থাপনাতেই আমার কিন্তু বিস্ময় শেষ হয়নি। একটু একটু করে আমি আজমাইনের খবর নিতে শুরু করি। ওর জীবনটা শুরুর সঙ্গে আমার একটি যোগাযোগ আছে। আমি ২০০১ সালে বগুড়ায় একটি মাল্টিমিডিয়া স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিই। স্কুলটি পরে বগুড়ার করতোয়া পত্রিকার সম্পাদক মোজাম্মেল হক লালু প্রতিষ্ঠা করেন। সেই স্কুলে প্লে গ্রুপ থেকে কম্পিউটার শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। স্কুলটি এখন কলেজ হয়েছে ও সকল ছাত্রছাত্রীর জন্য তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা বাধ্যতামূলক রয়েছে। আজমাইন সেই স্কুলে প্লে গ্রুপ ও নার্সারি পড়েছে। সেখান থেকেই আজমাইনের তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষার শুরু। করতোয়া মাল্টিমিডিয়া স্কুলটি এখন বগুড়ার অন্যতম সেরা স্কুল। সেই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র আজমাইনের নিজের মুখের গল্পটা এ রকম, ‘আমার নাম আজমাঈন আকমাল। বর্তমানে বগুড়া জিলা স্কুলের ৭ম শ্রেণীতে পড়ছি। জন্ম বগুড়াতেই। বাবা বগুড়ার জেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা। মা গৃহিণী। আমাদের বড় ভাই আজমাল আওয়াসাফ রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে কম্পিউটার সায়েন্স এবং ইঞ্জিনিয়ারিং এ। মেজ বোন সাইমা ইসলাম লাবণ্য। বগুড়া সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণীতে পড়াশোনা করে। আমি সবার ছোট। ছোটবেলায় খেলনা দিয়ে খেলতে খেলতে খেলনা বানানোর চেষ্টা করতাম। যে কোন কিছু দেখলে সেটা কিভাবে হচ্ছে এবং কেন হচ্ছে তা বের করার চেষ্টা করি। ছোটবেলা থেকেই কম্পিউটার ভাললাগে। প্লে গ্রুপ এবং নার্সারিতে মোস্তাফা জব্বার স্যারের প্রতিষ্ঠিত করতোয়া মাল্টিমিডিয়া স্কুলে পড়েছি। তখন থেকেই কম্পিউটার ভাললাগে। ৩য় শ্রেণীতে ভর্তি হই বগুড়া জিলা স্কুলে। বগুড়া জিলা স্কুল বিজ্ঞান ক্লাব থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে শেখা শুরু করি প্রোগ্রামিং। শুরুটা হয়েছিল ক্লাস ৩ তে স্ক্র্যাচ প্রোগ্রামিং ভাষা দিয়ে। ধীরে ধীরে ভালবেসে ফেলি প্রোগ্রামিং। শেখা শুরু করি প্রোগ্রামিং ভাষা। পড়াশোনার পাশাপাশি গেম খেলে সময় নষ্ট না করে, যেন গেম বানাতে পারি সেজন্য প্রতিদিন কমপক্ষে ২ ঘণ্টা করে প্রোগ্রামিং চর্চা করি। বর্তমানে সি ++ প্রোগ্রামিং ভাষা শিখছি। প্রোগ্রামিং এর পাশাপাশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণা করি। রোবোটিক্স আমার অনেক ভাল লাগে। মানুষের কাজে আসবে এমন স্মার্ট রোবট বানানোর ইচ্ছা আছে। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার লড়াইয়ে সরকারের পাশাপাশি আমাদেরও কাজ করা দরকার।’ এমন ভাবনা থেকেই বগুড়া জিলা স্কুল বিজ্ঞান ক্লাবের প্রতিষ্ঠা করা। বর্তমানে আমি ক্লাবটির সঙ্গে যুক্ত। ক্লাস ৩-৬ এর বাচ্চাদের বিজ্ঞান মনস্ক করে তোলা, প্রোগ্রামিং শেখানো, মজার ছলে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় শেখানোর জন্য বগুড়া জিলা স্কুল বিজ্ঞান ক্লাবটির সঙ্গে কাজ করছি। প্রথমে বাবা-মা আমার প্রোগ্রামিং বা রোবট বানানোতে সাপোর্ট করতেন না। তারা ভাবতেন সময় নষ্ট করছি। পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে সেটিও মনে করতেন। তখন বাবা-মা বা পরিবার থেকে সাপোর্ট ছিল না। কিন্তু দু’একটা কম্পিটিশনে অংশগ্রহণ করি এবং বিজয়ী হয়ে দেখিয়ে দিই যে আমি খারাপ কিছু করছি না। তারপর থেকে পরিবারের সাপোর্ট পাই। এখন বাবা-মা এবং পরিবারের সবাই দারুণ উৎসাহ দেন ও সহযোগিতা করেন। বর্তমানে ম্যানহোল থেকে যে কোন শিশুকে উদ্ধার করতে পারবে এমন একটি পরিপূর্ণ রোবট বানানোর কাজ করছি। শুধু এই প্রোজেক্ট নিয়েই কাজ করছি এমন নয়। আরও বেশকিছু প্রোজেক্ট নিয়ে কাজ করছি বর্তমানে। আমার আরেকটি ইচ্ছা হচ্ছে ক্লাস ৩-৬ এর বাচ্চাদের প্রোগ্রামিং শেখানো। যা বর্তমানে চালিয়ে যাচ্ছি বিজ্ঞান ক্লাব থেকে। সহযোগিতা পেলে আরও বড় পরিসরে করব ইনশাআল্লাহ্। আমি কৃতজ্ঞ যে এই লেখাটি আমি মোস্তাফা জব্বার স্যারের বিজয় দিয়ে লিখেছি। স্যার আমার প্রেরণা।’ (চলবে) ঢাকা, ১৬ জুন, ১৭ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণা ও কর্মসূচীর প্রণেতা ॥ ই-মেইল : [email protected], ওয়েবপেজ : www.bijoyekushe.net
×