ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

নাইট ওয়াচ-আলো-আঁধারির কাব্য

প্রকাশিত: ০৭:০৪, ১৬ জুন ২০১৭

নাইট ওয়াচ-আলো-আঁধারির কাব্য

পাশ্চাত্য চিত্রকলায় ডাচ্ শিল্পী রেমব্রান্ট একজন বরণীয় শিল্পী। ছবি বিষয়ে যার ন্যূনতম কৌতূহল আছে তিনিই জানেন রেমব্রান্টের নাম। তিনি বিষয়বস্তু হিসেবে মানুষের ফিগার ও প্রতিকৃতি সম্পর্কে আগ্রহী ছিলেন। আর এসব বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে তিনি বাইবেল ও পৌরাণিক কাহিনী নির্ভর ছিলেন। কিছু প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীও তিনি অঙ্কন করেছেন। নাটকীয়তা ছিল তাঁর ছবির এক আশ্চর্য বৈশিষ্ট্য। ছবিতে এমন এক আলোর সৃষ্টি করেন যা ঠিক দিনের আলোও নয় আবার রাতের আলোও নয়। সত্যিকারের দিনের আলো হলে ছবিগুলো আরও হালকা হয়ে যেত, গভীরত্ব আসত কম। অথচ রাতের বাতির আলো হলে ছবিগুলোতে আরও বেশি আলো অন্ধকার হতো। রেমব্রান্ট ছবিতে যে আলোর সৃষ্টি করলেন তাতে ছবির মধ্যস্থলটি হতো এক অপূর্ব তীব্র আলোয় উজ্জ্বল, আর চারদিকে অন্ধকার। রেমব্রান্টের আঁকা এমন অসংখ্য ছবি আছে যা দেখে দর্শকের মনে হতে পারে তার চোখের সামনে বুঝি থমকে আছে কোন বিশেষ একটি নাট্যমুহূর্ত। চিত্রপটে চরিত্রের উপস্থাপনা, আলো-ছায়ার অলৌকিক জাদুতে উদ্ভাসিত তাদের মুখম-ল আমাদের মনে শিহরণ জাগায়। উত্তেজনা কিংবা প্রশান্তি কোনটারই অভাব ছিল না তাঁর ছবিতে। তাঁর একটি বিখ্যাত ছবি হলো ‘দ্য নাইট ওয়াচ’ বা ‘রাতের পাহারা।’ ডাচ্ স্বর্ণযুগের তুঙ্গ সময়কাল ১৬৪২’ এর আঁকা ছবি। রেমব্রান্টের সবচেয়ে আলোচিত ছবিগুলোর একটি। ১১.৯১ ফুট বাই ১৪.৩৪ ফুট এর বিশাল সাইজের ছবিটি বিখ্যাত হয়ে আছে তিন তিনটি গুণের জন্য। ছবিতে আলোছায়ার সত্যিকারের খেলা আর ছবিতে থাকা মানুষগুলো যেন এই চলতে শুরু করেছে এমন একটি ভাবের কারণে। ক্যানভাসের ওপর তেল রঙে আঁকা এ ছবিটি যিনি দেখেছেন তিনিই জানেন যে কোন মঞ্চ সফল নাটকের চরমতম মুহূর্ত হিসেবে কত সার্থক হতে পারে এ দৃশ্যটি। বিষয়বস্তু আহামরি কিছু নয়। বিপদের সময়ে শহরে যে রক্ষীদল রাতে নগর পাহারা দিত তাদের ছবি। বিপদের খবর পেয়ে একদল শহররক্ষী যেন এই বেরিয়ে পড়েছেন শহর রক্ষায়। ছবিটি রেমব্রান্টের সবচেয়ে বিশালকৃতির গ্রুপ প্রতিকৃতির কম্পোজিশান। শুরুতে ছবিটির নাম ছিল ‘দ্য শূটিং কোম্পানি অব ফ্রান্স ব্যানিং কক।’ মনে করা হয়, ছবিটি আঁকা হয়েছিল ডাচ্ ক্লোভেনিয়ার্স বা সিভিক মিলিশিয়া গার্ডের ক্যাপ্টেন ব্যানিং ও তার ১৭ জন সদস্যের ফরমায়েশে। কারণ ছবিটির ব্যাক গ্রাউন্ডের ডানদিকে ১৮ জনের নাম একটি ফলকে লেখা আছে। আর খুব সম্ভবত ড্রামবাদকটি এখানে বিনা পয়সায় ঢুকে পড়েছেন এক্কেবারে সামনের দিকে। সব মিলিয়ে ছবিটিতে ৩৪টি চরিত্র আছে। ছবিটি জাগতিক, সজীব এবং তেজী পূর্ববর্তী যে কোন পেইন্টিংয়ের চেয়ে একদল সৈনিকদের একটি দলকে নিয়ে আঁকা হয়েছে, যেখানে তারা অস্পষ্ট, ধোঁয়াটে, বাড়ির উঠান থেকে সূর্যের আলোর দিকে শরীর ফেলছে। এখানেও আলোছায়ারই খেলা। ছবির সম্মুখে দলের ক্যাপ্টেন আর লেফ্টেন্যান্ট, পেছনে রক্ষীবাহিনীর অন্য সকলে বন্দুক, বর্শা নিয়ে ছুটে বেরিয়ে আসছে। ছেলেরা ছুটে বেরিয়ে এসেছে তামাশা দেখতে। এমনকি একটি কুকুরও পায়ের ফাঁকে ছুটে বেড়াচ্ছে। কয়েকটি মানুষের গায়ে আলো খুব উজ্জ্বল হয়ে পড়েছে। বাকি সকলে প্রায় রাত্রির অন্ধকারে। তবুও আলোটি বাতি বা মশালের আলো থেকে এত তফাৎ যে অনেকে ভুল করে মনে করেন যে ছবিটি দিনের বেলার কোন ঘটনা নিয়ে আঁকা। ‘রাতের পাহারা’ বলা উচিত নয়। ছবিটি আঁকার পর থেকে প্রায় তিন শ’ বছর ধরে গাঢ় বার্নিসের আবরণে ঢাকা ছিল। যার ফলে মনে হতো যেন রাতের অন্ধকারে ঢেকে আছে সবকিছু। ধারণা, নৈশকালীন ছবিই বুঝি এঁকেছেন রেমব্রান্ট। তাই নামটি হয়েছে ‘নাইট ওয়াচ’। আর এই ভুল নামটি নিয়েই জগৎখ্যাত হয়ে আছে সে আজও। ১৯৪০ সালে ভার্নিস তুলে ফেলার পর ছবিটি আরও ঝকঝকে হয়ে ওঠে। ছবিতে তিনটি চরিত্রেরই অভিব্যক্তি চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। আলোছায়ার বিষয়েও রেমব্রান্ট সুনিপুণ ছিলেন। এর তুলনামূলক বড় সাইজ, আলোছায়ার ভারসাম্য এবং গতির আবেশ, এই তিনটি বিষয়ের জন্য ছবিটি পৃথিবী বিখ্যাত। আলোর খেলায়, ভিড়ের ভেতর থেকেও রেমব্রান্ট তিনটি চরিত্রকে মুখ্য করে তুলেছেন। মাঝখানের দুজন, কালো পোশাক আর লাল রঙের উত্তরীয় নিয়ে ক্যাপ্টেন ব্যানিং এবং হলুদ পোশাক আর সাদা রঙের উত্তরীয় নিয়ে তার লেফটেন্যান্ট উইলিয়াম ভ্যান রুইতেনবার্চ। বামদিকে হলুদ জামা পরা একটি ছোট্ট মেয়েকে দেখা যায়। এই মেয়েটির কাছে রাইফেল এর পূর্বসূরি ‘মাজেল লোর্ডেড’ আগ্নেয়াস্ত্রের ঐতিহ্যগত প্রতীকটি এঁকেছেন স্বাভাবিক ঢংয়ে। মেয়েটির বেল্টে অঙ্কিত মৃত মুরগি এক ধরনের বন্দুককে নির্দেশ করে। এই মৃত মুরগি পরাজয়ের বিপরীত প্রতীক। আবার হলুদ বর্ণ জয়ের বার্তাবাহক। তাই এই মেয়েটিকে দ্বারা যুদ্ধ জয়ের কথা বোঝানো হয়েছে। আর এই যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী হিসেবে দেখানো হয়েছে ক্যাপ্টেইন ব্যানিং ও তার সহযোগীদের। ছবিতে তীব্র আলো ও গভীর অন্ধকার দৃশ্যায়িত হয়েছে। ক্যাপ্টেন ব্যানিং ও রুইতেনবার্চকে অন্ধকারের বিপরীতে উপস্থাপন করে এক নাটকীয় পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। তুমুল অন্ধকারের বিপরীতে যৎসামান্য আলোর লুকোচুরি খেলায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে একদল মানুষের রাত পাহারা। একের পর এক মুখের মধ্য দিয়ে শিল্পী ফুটিয়ে তুলেছেন সবার অভিব্যক্তিসমূহ। দেখলে মনে হয় যেন শক্তিশালী এক অভিনেতার মুখের মধ্যে দিয়ে প্রস্ফুটিত হয়ে চলেছে শিল্পীর অন্তর্জীবন। ‘নাইট ওয়াচ’ ছবিটির উপর হামলা হয়েছে কয়েকবার। যার ফলে ছবিটির অনেকটা অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই বর্তমানের মূল ছবিতে কয়েকটি চরিত্র দেখা যায় না, সঙ্গে একটি গার্ড রেইল আর সিড়ির ধাপ উধাও হয়ে যায়। এই দুটির উপস্থিতি দিয়েই রেমব্রান্ট ছবিটিতে একটি ‘ফরোয়ার্ড মোশন’ দিয়েছিলেন। আলো ও ছায়ার পরিবর্তনের মাধ্যমে যে ছবির পরিবেশ ও চরিত্রের আমূল পরিবর্তন ঘটে এবং ছবির অর্থ ও অনুভূতির পরিবর্তন ঘটে তা এই চিত্রে দৃশ্যমান। চরিত্রগুলোকে আদর্শায়িত না করে সাধারণ, সুন্দর এবং মহৎদর্শন করে তুলেছেন। প্রতিটি প্রতিকৃতিতে ব্যক্তির চরিত্র যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, যা দর্শকচিত্তে কিংবা অনুভূতিতে সরাসরি আবেদন জাগায়। জ্যোতিশ্চক্র এবং অন্যান্য প্রতীক ত্যাগ করে ঘরোয়া চেহারার চরিত্রদের গুরুত্ব নির্দেশ করে তাদের কে আলোকিত করেছেন এবং গভীর ছায়ায় করেছেন পরিবৃত। যা একটি শুদ্ধ ছবির চেয়ে অধিক কিছু। তিনি এখানে শুধু মানুষের প্রতিকৃতি আঁকেননি, সঙ্গে সঙ্গে তাদের চরিত্র কিংবা আত্মাও এঁকেছেন। দেখে মনে হয় যেন তারা জীবন্ত হয়ে আমাদের সময়ে, আমাদের স্থানে প্রবেশ করছে। কিন্তু সেই সময়ে উঁচু দালানকোঠার জন্য দিনের আলো প্রবেশ করতে পারেনি। যে সামান্য ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করছে তা ছবির বিশেষ বিশেষ অংশকে আলোকিত করছে প্রকটভাবে। আলোর গতি ক্যানভাসকে জীবন্ত করে তুলেছে। মাঝ বরাবর জায়গায় আলো ছড়িয়ে গিয়ে ছায়ার এক শক্তিশালী আবহ তৈরি করেছে। প্রতিকৃতির অবস্থান এমনভাবে নির্ধারণ করা যাতে বিষয়কে খুব সক্রিয় মনে হচ্ছে। মুখ ও যন্ত্রের মাঝে আলোর গতি, পোশাকের ভাঁজ সব মিলিয়ে খুব সক্রিয় ও জীবন্ত এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি। পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ পেইন্টিংগুলোর মধ্যে ‘নাইট ওয়াচ’ অন্যতম। চিত্রটি রেমব্রান্টের অঙ্কন দক্ষতার চরম উৎকর্ষের সাক্ষী। চিত্রে ফুটে উঠেছে শিল্পীর চিন্তার গভীরতা। ক্যানভাসে আলো আঁধারির খেলা দেখিয়ে শিল্পী রেমব্রান্ট কিংবদন্তি হয়ে আছেন। মনপ্রাণ দিয়ে ছবিটি এঁকেছেন শিল্পী। রাতের অন্ধকারে বিচিত্র ভঙ্গিতে নৈশপ্রহরীরা। ছবিতে আলো-আঁধারিতে সমানভাবে স্পষ্ট হলো না সকলের মুখ। চিত্র : দ্য নাইট ওয়াচ
×