কৈশোরে প্রায়ই আনমনা হয়ে যেতাম। কখনো খেলার মাঠে, কখনো স্কুলে অথবা কখনো বৃষ্টি-দিনের অবসরে। জন্ম-মৃত্যু নিয়ে ভাবনার শুরু তখন থেকেই। হয়তো এ ভাবনাই আমাকে একদিন কবিতা লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
চতুর্থ শ্রেণীতে গণিত পড়ার জন্য এক শিক্ষকের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল। আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় মাইল-দূরে তাঁর বাড়ি। আমার সঙ্গে আরও কয়েকজনকে একসঙ্গে পড়াতেন তিনি। গণিত আমার কাছে ছিল এক জটিল বিষয়। অংক করার ফাঁকে মাঝেমধ্যে বাইরে কচুরিপানার দিঘির দিকে তাকিয়ে থাকতাম। বিকেলের হলুদ আলোয় কচুরিপানার ফুল অনেক সুন্দর দেখাতো। আমার বিস্ময়মিশ্রিত দৃষ্টি দেখে গণিতের স্যার বললেন, ‘এ-তো দেখি কবি হয়ে গেছে। দেখো, কেমন উদাস হয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে!’
এই তিরস্কার হয়তো একদিন নিজেকে খুঁজে পেতে আমাকে সাহায্য করেছিল। আমি কিছু একটা লেখা (পদ্য) শুরু করলাম। ভালোই লাগত লিখতে; কেমন যেন মন হালকা হয়ে যেতো। লিখতে পারলে স্বস্তি পেতাম। বলতে গেলে, এভাবেই একদিন কবিতার পথে যাত্রা শুরু।
কবিতা এক সর্বগ্রাসী শিল্প। সে সব নেবে। কবিকে নিঃস্ব করে দেবে। সে এমন এক ঘোর যা থেকে কবি বের হতে পারবেন না। সে এক মুগ্ধতা, যা কবিকে নিমগ্ন করে রাখে। কবি সবকিছু ছাড়তে পারেন, কবিতাকে নয়। কবিতা লিখলে কবি স্বস্তি বোধ করেন; তাঁর যাতনা কমে যায়। কবিতা কবির আনন্দ-বেদনা, সুখ-অসুখ। কবিতা, সে ব্যক্তিক হোক অথবা নৈর্ব্যক্তিক, অন্তরালে কবিকে পাওয়া যাবেই নিশ্চিত।
কবিতা আমার কাছে প্রেম, শুশ্রƒষা, আশা ও বেঁচে থাকার অবলম্বন আজীবন। যে পথে হেঁটে যাচ্ছি, তার পাশে নিঃসঙ্গতার চিৎকার, হারানোর হাহাকার; তবুও চলছি- না থেমেই চলছি। কবিতা আমাকে লড়তে সহায়তা করেÑ বাঁচিয়ে রাখে। হয়তো বেঁচে আছি কবিতা লিখি বলেই।
** প্রজাপতি ঘুড়ি
আমার যে হাতে ছিলো ঘুড়ির নাটাই
আমি সেই হাতটাকে গুটিয়ে নিয়েছি, আর
সুতো কেটে দিয়ে তাকিয়ে রয়েছি ঘুড়িটির দিকে।
দেখছি, ঘুড়িটা ঠিক প্রজাপতি হয়ে গেছে
প্রিয় প্রজাপতি ঘুড়ি, তুমি কেনো সারাক্ষণ চারপাশে ওড়ো?
** বিচ্ছিন্নতা
বৃষ্টিকে কান্না বলি না- বৃষ্টি কার জন্য কাঁদে?
আকাশতো নীলাভ পাথর- কেবল তাকিয়ে থাকে
যেমন বৃক্ষেরা থাকে শুধুই তাকিয়ে
যেমন নদীরা নিজ স্রোতে বয়ে যায়
পাখিগুলো উড়ে যায়Ñ গাছের একান্ত খোপে
যথারীতি হয়ে যায় বেনামি পালক
বস্তির অস্থির বুক ভেদে ভবনে বাজতে থাকে গান
মানুষ নিজের মতো হাঁটে, আর
যে দাঁড়িয়ে থাকে জানালায় চেয়ে
তার জন্য বাতাস কী সহমর্মী হয়?
সবকিছু নিজ স্রোতে বয়-
বৃষ্টি ঝরার শব্দে কারো পায়ে নূপুর বাজে না।
** ভুলের ধারাপাত
আর ভুলতম রাত্রিগুলো ককেশাস পাহাড়ের ক্ষুধার্ত ঈগল। সময়ের সবচেয়ে
শীতলাভ স্পর্শ নিতে নিতে বোধ করি বোধের অতলে জাগা
কোন সত্য প্রকৃত ছিলো না- মানুষ হওয়ার চেয়ে ভালো ছিলো পাখি হওয়া
দূরত্ব এখন আর দূরত্বে থাকেনি- দূরত্বকে জয় করে নিয়েছে
মানুষÑ পেরেছে কী? পারে নাই প্রত্যেকের মধ্যকার কাঁচের দেয়াল
ভেঙে দিতেÑ একই ছাদের নিচে শত ক্রোশ দূরে তবু প্রতিটি মানুষ...
**
মার্বেল
ছোটবেলায় মার্বেল খেলতাম। মার্বেল বন্ধুদের সাথে খেলা আর
ঘোরাঘুরিতে কেটে যেতো সারাদিন। রাত হলে মার্বেলগুলো প্রজাপতি হয়ে
যেতোÑ আমি পেছন পেছন ছুটতাম মাঠঘাট পেরিয়ে বহুদূর...
হাত থেকে ছুড়ে দেয়া মার্বেল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে যেতো গর্তে; ছোটবেলায়
এভাবে খেলে কখনো মনেই হয়নি একদিন মার্বেলের পরিণতি মেনে
নিতে হবে। তারপর
গড়াতে গড়াতে
গড়াতে গড়াতে
পড়ে যাব একদম গভীর গর্তে- পাতালে।
মার্বেল নিয়ে মানুষের খেলা করার কোন অধিকার নেই, বরং
মার্বেলের আছে মানুষকে নিয়ে খেলার অধিকার।
** দীর্ঘশ্বাস
কয়েক প্রকার দীর্ঘশ্বাসের সাথে বাস করি
প্রতিদিন ঘর থেকে বের হই তাদের নিয়েÑ ফিরে আসি
ছায়ার মতো তারা সঙ্গ দেয়-
রাতে আচানক ঘুম ভেঙে গেলে
একটি তপ্ত দীর্ঘশ্বাস আমাকে পোড়ায়। সকালের ধূর্ত দীর্ঘশ্বাস
জামার পকেটে ঢুকে পড়ে অজ্ঞাতেই- দুপুরের বোকা দীর্ঘশ্বাসের মুখে
ভাষা ফুটে সন্ধ্যায়, পার্কে-
রাতে বাসার উদ্দেশ্যে একা ফিরে আসাকালে
গোয়েন্দার মতো পিছু নেয় দীর্ঘশ্বাসগুলো
নক করে দরজায়