ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

চলচ্চিত্র প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, লন্ডন

প্রকাশিত: ০৭:০২, ১৬ জুন ২০১৭

চলচ্চিত্র প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, লন্ডন

লন্ডনে অবস্থানকালে আমার প্রিয় শিক্ষক ছিলেন ভিভিয়ান ক্রাম্বল। সুদর্শন, স্মার্ট, বেশ প্রাণবন্ত এবং সর্বোপরি মেধাবী। সময়টা ১৯৮৬ সালের এপ্রিল মাস। ভিভিয়ানের উপস্থাপনা এবং পাঠপদ্ধতি ছিল খুবই চমৎকার। ক্লাসে প্রবেশ করে প্রথম কয়েক মিনিটের মধ্যে তিনি একটা আকর্ষণ সৃষ্টি করতে পারতেন। সে সময় তার বয়স ছিল ষাট ছুঁইছুঁই। অথচ তার চলন-বলনে বয়সের কোন ক্লান্তি ছিল না। তিনি আমাদের সপ্তাহে মাত্র একদিন দু’ঘণ্টার ক্লাস নিতেন। এই সময়টা চোখের নিমিষে ফুরিয়ে যেত। তাঁর ছিল চমৎকার আকর্ষণীয় বাঁচনভঙ্গি। খুব দ্রুত এবং খুব সহজে আমাদের হৃদয় ছুয়ে যেত। ভিভিয়ান এসেছিলেন বিবিসি প্যানেল-৪ থেকে। সেখানে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে কর্মরত ছিলেন। আমাদের যখন ক্লাস নিতেন তখন তার অবসরকাল চলছে। তিনি পড়াতেন ফিল্ম-ডিরেকশন। ছবি পরিচালনা। সান্ধ্যকালীন এই কোর্সে ভর্তির ব্যাপারে আমার বন্ধু আতিক আমাকে প্ররোচিত করেছিল। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকাকালীন আমার মূল বিষয় ইংরেজী সাহিত্যের পাশাপাশি নাটক নিয়ে মেতে উঠেছিলাম; লন্ডন প্রবাসে চলচ্চিত্র নিয়ে পড়াশোনা বা প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে গেলে আমার কাজে আসবে। অন্তত আতিকের এরকমটি ধারণা ছিল। প্রতি সপ্তাহে ৩ দিন ক্লাস। ৪ ঘণ্টার। ২০ জন ছাত্রছাত্রী ছিল। বেশ চমৎকার সময় কেটে যেত। আতিক তখন লন্ডন স্কুল অব এ্যাকাউন্টেন্সিতে শিক্ষকতা করত। তাকে সারা সপ্তাহ বেশ ব্যস্ত থাকতে হতো। কেবল রবিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সে আমাকে সময় দিত। সে থাকত তার ছোটবোনের বাসায়। আমি সেখানে বেশ কয়েকবার গেছি। আতিক কোন কোন ছুটির দিনে নিমন্ত্রণ করত। সেদিন ভাত মাছ খাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ পেতাম। এমনিতে সপ্তাহের অন্য দিনগুলোতে তিনবেলা ফাস্টফুড শপে খেতাম। খারাপ লাগত না, এক ধরনের অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। দক্ষিণ-পশ্চিম লন্ডনের ফোটসকিউ রোডের একটি সিলেটী বাসার এক কক্ষে আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। সেই ছিয়াশি সালে সপ্তাহে পনেরো পাউন্ড ভাড়া দিতাম। খাওয়া বাইরে। কয়েন ব্যবহার করে ঠেলিফোন ব্যবহার করতাম। ঘরে একটি খাট, লেপতোষক এবং ঘরের কোণায় একটি টেবিল চেয়ার ছিল। আমি সেখানে বসে লেখালেখির কাজ করতাম। পড়াশোনায় কখনও কোনদিন আমার ক্লান্তি ছিল না। সেই ছিয়াশি সালেও চলচ্চিত্রের ওপর ঢাউস ঢাউস বই পড়তে কোনরকম একঘেয়েমি বোধ করতাম না। ঢাকায় থাকতে লেখালেখির সঙ্গে জড়িত ছিলাম। সেই সুবাদে পড়তামও প্রচুর। সেই অভ্যাসটা চাকরি জীবনের পরেও রয়ে গিয়েছিল। ঢাকায় থাকতে সেই সত্তর দশকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে নাটক লিখতাম ও পরিচালনা করতাম। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে একটি নাট্যগোষ্ঠী করেছিলাম। স্বরলিপি ড্রামা সার্কেল। বাবা ছিলেন আমলা, তিনি চাইতেন না আমি নাটক করি। তিনি চাইতেন আমি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে তার মতো প্রশাসনে মিতু হই। কিন্তু আমার ভেতর তখন অন্য এক ‘বোধ’ কাজ করছে। আমি তখন কবিতা আর নাটকের মায়াবী ভুবনে বিচরণ করছি। নাট্যচর্চা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে জীবিকার জন্য ছুটোছুটি করতে হলো। এবং এক সময় চাকরিও পেয়ে গেলাম। আমার দ্বিতীয় চাকরি বিদেশে অধ্যাপনা। সেখানে ছয় বছর চাকরি করে লন্ডনে এলাম। ঠিক সেই সময়ে আতিকের সঙ্গে দেখা। সে শুধু আমার ভাল বন্ধু ছিল না, একজন সত্যিকার শুভাকাক্সক্ষীও ছিল। ভিভিয়ান ক্রাম্বলের সঙ্গে খুব দ্রুত আমার সখ্য গড়ে ওঠে। যেদিন আমাদের সার্টিফিকেট দেয়া হলো, সেদিন তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘যদি কোনদিন তোমার দেশে ফিল্ম ইনস্টিটিউট গড়ে তুলতে পারো, তবে আমাকে ডেকো। আমি তোমার দেশে ক্লাস নিতে যাব। শুধু বিমানভাড়া দিলেই চলবে। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা আমি করে নেবো।’ এরকম নিবেদিতপ্রাণ চলচ্চিত্রের শিক্ষক আমার আর চোখে পড়েনি। ঢাকায় ফিরে এসে আমি টেলিভিশনের চাকরিতে, আর গেলাম না। আমার বাবা, কি এক অজানা কারণে, টেলিভিশনের চাকরিতে আমার যাওয়াটা পছন্দ করলেন না। দেশের ফিল্ম ইনস্টিটিউটগুলোতে মাঝে মধ্যে খ-কালীন পেশা হিসেবে চলচ্চিত্রের ওপর বক্তৃতা দিতাম। আসলে ইংরেজীর অধ্যাপক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টা ছিল প্রধানতম কাজ। সেসব কতদিন আগের কথা। তিরিশ বছর তো হবেই। এখনও লন্ডনের ফুলার রোডের ফিল্ম ইনস্টিটিউটের কথা অলস মুহূর্তে খুব মনে পড়ে। আর মনে পড়ে আমার প্রিয় শিক্ষক ভিভিয়ানকে। তিনি এতদিনে বেঁচে আছেন কি-না কে-জানে।
×