কাব্যগ্রন্থটির নামেই দৃষ্টি আটকে যায়। ‘শরতেও মেঘ নামে’। দ্বিতীয় শব্দটি অর্থাৎ ‘মেঘ নামে’ বলতে কি বুঝতে চেয়েছেন কবি? এই ‘মেঘ নামা’ কি সত্যিই পৃথিবীতে মেঘ নেমে আসার মতো কিছু, তাও কি সম্ভব? বইটা খুলে নির্দিষ্ট কবিতাটি পড়তেই আস্তে আস্তে খুলে গেল দৃষ্টিটা। এই ‘মেঘ নামা’ মানে ‘বৃষ্টি নামা’। মেঘ তো জলের আধার। মেঘ ভেঙ্গেই তো জলকণা বৃষ্টি হয়ে নেমে আসে পৃথিবীতে। প্রথম প্রশ্নের উত্তরটা মিলল। এবার দ্বিতীয় প্রশ্ন। ‘শরতেও মেঘ নামার বিষয়টি। বৃষ্টিপাত সাধারণত বর্ষাকালেই ঘটে। শরতের মেঘ থাকে ‘সফেদ’, জলশূন্য, শুধুই বাষ্পকু-। তাই শরতে বৃষ্টি নামার বিষয়টি একটু আলাদা, একটু ভিন্নতর। শিরোনামটি আরেকবার পড়তেই রহস্যটা উন্মোচিত হলো। ‘শরতেও মেঘ নামে’ অর্থাৎ এই ভিন্ন বিষয়টিও মাঝেমধ্যে ঘটে থাকে। আর কবিÑ অনুভবে সেটা তৈরি করে ভিন্নতা, নতুন সুর নতুন স্পন্দন এবং তা পল্লবিত হয়েই চিত্রিত হয়ে ওঠে কবিতায়। ঠিক এখানেই একজন সাধারণ মানুষের সঙ্গে পার্থক্য কবির। একজন সাধারণ মানুষের অনুভব যেখানে আটকে যায় কবির ত্রিনয়নের যাত্রা শুরু ঠিক সেখান থেকেই।
কবি হিসেবে শাহীন রেজাকে জানি অনেককাল। তার কবিতায় মাটি ও মানুষের সুর ধ্বনিত হয় গভীর আন্তরিকতায়। আর বিধাতা অন্বিষ্ট হয় পরম শ্রদ্ধায়, পরম গৌরবে। ‘শরতেও মেঘ নামে’ কবির সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ। এ গ্রন্থটিকে আমার কাছে স্বপ্নাচারী কবির ধূসর যাত্রা বলেই প্রতীয়মান হয়েছে।
‘মেঘগুলো ফুল হয়ে ফুটেছিল আলোর চিতায় আর আমি আগুন ঝরানো রোদÑ
দাঁড়িয়েছিলাম কাছে; বৃক্ষের ওপাশে
সেখানে নদীরা ছিল আর সব মাতাল বাতাস
এবং পাখিদের কণ্ঠজুড়ে শ্রাবণ কোরাস ।
(যা কিছু গোপন)
মেঘগুলোকে ফুলের সঙ্গে তুলনা শাহীন রেজার কবিতায় এক ভিন্ন ব্যঞ্জনা। পাখিদের কণ্ঠে শ্রাবণ-
কোরাস আবিস্কার- যেন শুধুমাত্র শাহীন রেজাতেই সম্ভব।
‘হামাগুড়ি দিয়ে নেমে এলো ধূসর সুন্দর-
লেমুছড়ি হয়ে সাঙ্গু নদী অতঃপর বান্দরবান
এবং ক্রমাগত দূরে নীলাচল অথবা চিম্বুক’
(শরতেও মেঘ নামে)
হামাগুড়ি দিয়ে ধূসর সুন্দর নেমে আসার দৃশ্যপট, কাব্য উপমায় এক অভাবনীয় সংযোজন। এটি শাহীন রেজার এক অনন্য কীর্তি।
‘আজকাল শরতেও মেঘ নামে; বৃষ্টি হয়
কাশফুলে মাতাল বাতাস চুমু খেতে খেতে জল পেয়ে
ক্রমশ ঘন; মেতে ওঠে ছায়া সংগমে’
(শরতেও মেঘ নামে)
শরতেও মেঘ নামার বিরল বিষয়টি যে কবিচিত্তকে প্রভাবিত করেছে তা এই পংক্তিগুলোতে ফুটে উঠেছে প্রচ্ছন্নভাবে। কাশফুলে মাতাল বাতাসের স্পর্শকে চুমু খাওয়ার সঙ্গে তুলনা একমাত্র শাহীন রেজাকেই মানায়। ‘ছায়া সংগমে’ মেতে ওঠার চিত্র অঙ্কন তার এক অভাবনীয় নিজস্ব অনুভব। এখানেই কবি শাহীন রেজার স্বাতন্ত্র্যতা।
স্বপ্নগুলোকে ঘুঘু বানিয়ে বুকের উঠোনে ছড়িয়ে দেবার ইচ্ছা কবিতো পোষণ করতেই পারেন কিন্তু নারীদের চেনা মুখকে ‘ছায়া-বদল’ করিয়ে তিনি যে অসম্ভবকে সম্ভব করতে চান তার গভীরতা কতোটুকু তা একমাত্র তিনিই জানেন।
‘স্বপ্নগুলো ঘুঘু হয় এবং রমণীরা
নারীদের চেনামুখ ছায়া বদলায়’
(বুকের উঠোনে ঘুঘু)
কাব্যগ্রন্থটির একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা ‘তনুর জন্য, এই বৈশাখে’। ধর্ষিতা তনু, নিহত তনু আমাদের এই সমাজের একটি ক্রন্দন, একটি কলঙ্ক। এই কবিতায় প্রতিবাদী শাহীন রেজার কলম ঝলসে ওঠে তনুর সপক্ষে। তার ক্রোধ ঘৃণা আর প্রতিশোধের তীব্র সুর ধ্বনিত হয় শব্দধারায়।
‘আকাশ কাঁপছে একা বাতাসেও সকরুণ সুর-
এইতো এখানে তনু, এইবুকে কে বলেছে দূর
মৃত্তিকা জড়িয়ে দেহে লতাগুলো কী নিবিড় সুখে
তনুকে আগলে রাখে সময়েরা প্রজাপতি বুকে’
.........
বোশেকে শপথ নাও তনুদের যে করেছে লাশ
ভূমিতে লুটাবে তারা ঘৃণাবনে তাহাদেরি বাস
এ জাতি বীরের জাতি লড়ে যায় অকৃপণ ধারা
নিমিষে নিধণ সব অসুরেরা কাছে-দূরে যারা’
এই কবিতার মধ্যদিয়ে শাহীন রেজা শনাক্ত হন নির্যাতন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হিসেবে। একই ধারা দেখতে পাই তার ‘পালিয়ে বেড়াচ্ছি আমি’ কবিতাটির মধ্যে। নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের স্বপক্ষে সোচ্চার শাহীন রেজা এই কবিতাটিতে তাদের জন্য উচ্চারণ করেন তার প্রগাঢ় ভালোবাসা আর সহমর্মিতার কথা। সেই সঙ্গে তার তীব্র ঘৃণা ছড়িয়ে দেন মিয়ানমারের সেই সব ঘৃণ্য পশুদের প্রতি, যাদের নির্মমতায় গৃহহারা দেশছাড়া সেইসব নির্যাতিতরা।
‘আমার সকল উচ্চারণে আমি আজ শোনাতে চাই সেসব মানুষের কথা,
যারা শুয়ে আছে প্রাণহীন, স্থির জন্মভূমির মাটিতে
অথবা শরীরে নিয়ে হায়নার ক্ষত
পালাচ্ছে দূরে, অন্য কোথাও নিজেই পরবাসী যারা নিজভূমে,
আমার সকল শব্দাবলী আজ নিবেদিত তাদের উদ্দেশ্যে’।
শাহীন রেজার কবিতায় অনিবার্যভাবে যে কয়েকটি শব্দ উচ্চারিত সেগুলো হচ্ছে কুয়াশা, শালিক, শ্রাবণ, বালিকা, পাখি,ছায়া, জল, নারী ইত্যাদি। আলোচ্যগ্রন্থের কবিতাগুলোতেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। দীর্ঘদিন নিরালস কাব্যসাধনা কবি শাহীন রেজাকে এনে দিয়েছে একটি একক ভূবন। যে ভুবনের অধীস্বর একমাত্র তিনিই। তার দু’লাইন কবিতা পড়েই বলে দেয়া যায় এটা তারই কবিতা আর এখানেই সফলতা কবি শাহীন রেজার।
কবিতায় প্রশ্নের জন্ম দিতে ভালোবাসেন শাহীন রেজা, সেই সঙ্গে তার উত্তরও। ‘কবি’ এবং ‘কবিতা’ নিয়ে তার জিজ্ঞাসা যেন অনন্তকালের। কবির ‘জন্ম’ এবং বিলয়’ নিয়ে তার প্রশ্ন ভাবিত করে সকলকে সেই সঙ্গে তাড়িতওÑ
“কবির কি জন্ম হয়, কবি কি বিলয় নেয়
কিভাবে, কখনো ?
জন্মের সংজ্ঞা চিনে কবিদের ভোরগুলো
কখনো কি শালিক সাজে অথবা শিমুল ?
হোক না সে তের কিংবা তেত্রিশ, হোক না সে
একক কিংবা লক্ষ্য অযুত
কবির জন্ম সে তো কবিতারই সঙ্গে
ঘ্রাণে-অঘ্রাণে।”
(তের কিংবা তেত্রিশ)
কবিতার সঙ্গে কবির জন্ম এঁকে দিয়ে নিজের মধ্যেই আপন প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নেয়া কবিসত্তা যে জন, তিনি শাহীন রেজা। ঘুমরাতে মানুষের দেহ থেকে মৃত্যুর ঘ্রাণ খুঁজে ফেরা শাহীন রেজা আকাশের নাভী থেকে ক্রমাগত জোছনায় ভ্রƒণ নিয়ে তাকে ছড়িয়ে দিতে চান নদী ধারাপাতে। জলের করোটি ছুঁয়ে জলগন্ধ্যার আকর্ষণে এগিয়ে চলা কবি এ গ্রন্থটিতে পূর্বের চেয়ে আরো গভীরতর, ঋদ্ধ এবং আকাশচারী।
সম্প্রতি সমাপ্ত বইমেলায় বহুল আলোচিত ‘শরতেও মেঘ নামে’ গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে মিজান পাবলিশার্স। গ্রন্থভুক্ত কবিতা সংখ্যা ৪২। এক শ’ টাকা মূল্যমানের এ বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে সদ্যপ্রয়াত তিন কবি সৈয়দ শামসুল হক, শহীদ কাদরী ও রফিক আজাদকে। গ্রন্থটির বহুল প্রচার কামনা করি।
শীর্ষ সংবাদ: