ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

তাজকিয়া নুর মুন

প্রোটিয়াদের এ দুঃখগাথা আর কত?

প্রকাশিত: ০৬:৫৯, ১৪ জুন ২০১৭

প্রোটিয়াদের এ দুঃখগাথা আর কত?

আরও একটি আইসিসির টুর্নামেন্ট, হট ফেবারিট, তবু আরও একবার ব্যর্থ প্রোটিয়ারা। ক্রিকেটে দক্ষিণ আফ্রিকা এক হতভাগ্য নাম। বারবার ফেবারিট হিসেবে শুরুর পরও চাপের সময় ভেঙ্গে পড়া, বিশ্বকাপসহ বড় মঞ্চের বড় ম্যাচে হেরে যাওয়া- এসবের কারণে দলটির পাশে এখন ‘চোকার্স’ অপবাদ। কোন টুর্নামেন্টের শিরোপা বলতে ১৯৯৮ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়। এবার অষ্টম আসরে সেটি পুনরুদ্ধার করে আগামী ওয়ানডে বিশ্বকাপের প্রস্তুতি সারতে চেয়েছিল প্রোটিয়ারা। র‌্যাঙ্কিংয়ের এক নম্বর দল হিসেবে ছিল হট ফেবারিটের তালিকায়। শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে শুরুটাও করেছিল দাপটের সঙ্গে। কিন্তু পাকিস্তান ও ভারতের কাছে টানা দুই হারে শেষ পর্যন্ত গ্রপপর্ব থেকে বিদায় নিতে হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ জুন, বার্মিংহামে তখন চলছে অস্ট্রেলিয়া বনাম দক্ষিণ আফ্রিকার দ্বিতীয় সেমিফাইনাল ম্যাচটি। যে জিতবে তার হাতেই চলে যাবে ফাইনালের টিকেট। সেমিফাইনাল পর্যন্ত দুর্দান্ত খেলে এসেছে দুটি দলই, কেউ কারও থেকে কোন অংশেই কম যায় না। ব্যাপারটি সেমিফাইনাল ম্যাচেও আবার তাই বুঝিয়ে দিল দুটি দল, সেমিফাইনালের ম্যাচটিতে তাই ছিল অন্যরকম এক চমক। টসে জিতে ব্যাট করতে নেমে শুরুতেই বেকায়দায় পড়ে যায় অজিরা। এ্যাডাম গিলক্রিস্ট, মার্ক ওয়াহর মতো ব্যাটসম্যানরা শুরুতেই গুটিয়ে যাওয়ায় অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ এবং মাইকেল বেভানের অর্ধশতকের ওপর ভর করে ২১৩ রানে পৌঁছায় অস্ট্রেলিয়া। এত সহজ ম্যাচটিকে প্রোটিয়ারা যে এত কঠিন করে ফেলবে তা হয়ত অজিরাও ভাবতে পারেনি। অস্ট্রেলিয়ার ছুড়ে দেয়া ২১৪ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে উইকেট বিলিয়ে আসার প্রতিযোগিতায় নামেন দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটাররা। প্রতিনিয়ত উইকেটের পতন হলেও জন্টি রোডস এবং জ্যাক ক্যালিসের সুবাদে প্রোটিয়ারাও ৪৯.৪ ওভারে সবকটি উইকেট হারিয়ে করে ২১৩ রান! দু’দলের সমান সমান রানের জন্য ম্যাচটি পরবর্তীতে টাই হিসেবে গণ্য হলেও সেবার কপাল পোড়ে প্রোটিয়াদের, রান রেটে পিছিয়ে থাকায় সেবার আর ফাইনালে ওঠা হয়নি দলটির। আর সেই থেকে ‘চোকার্স’ তকমাটি লেগে যায় প্রোটিয়াদের নামের পাশে। ১৯৯৯ সালের পর আবার ২০০৭ সালে সেই সেমিফাইনালে গিয়েই পথ হারায় প্রোটিয়ারা। এবারও প্রতিপক্ষ সেই অস্ট্রেলিয়া! সেমিফাইনালে উঠলেই যেন প্রোটিয়ারা নিজেদের স্বভাব থেকে বেরিয়ে হয়ে যায় সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি দল। ৩০০ রান করতেও যাদের তেমন কোন বেগ পেতে হয় না, তারাই কি-না সেবার ১৪৯ রানে অলআউট! ৪৩.৫ ওভারেই সেবার গুটিয়ে যায় প্রোটিয়াদের ইনিংস। ৪৯ রান নিয়ে জাস্টিন কেম্পের রানই ছিল সেবার সর্বোচ্চ রানের ইনিংস। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার মতো ভুল করেনি অজিরা। ৩ উইকেটের বিনিময়েই টার্গেটে পৌঁছে যায় দলটি। ২০১১ সালের বিশ্বকাপটিও প্রোটিয়াদের জন্য ছিল আরেক বিভীষিকাময় বিশ্বকাপ। এবার সেমিফাইনালে ওঠার আগেই কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বাদ হয়ে দেশে ফিরে যেতে হয় তাদের। তবে এবার আর অস্ট্রেলিয়া নয়, প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড। সেবারও মুখে চুনকালি মেখে বিশ্বকাপ ছেড়ে বিদায় নিতে হয় প্রোটিয়াদের। কিউইদের দেয়া ২২২ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ১৭২ রানেই অলআউট হয়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা! তাই সেমিফাইনাল ছোঁয়ার আগেই বিশ্বকাপপর্ব শেষ করতে হয় দক্ষিণ আফ্রিকাকে। সর্বশেষ অর্থাৎ ২০১৫ বিশ্বকাপেও চোকার্সের পরিচয় দেয় প্রোটিয়ারা। ২০১১-এর মতো এবারও প্রতিপক্ষ কিউইরা। তবে কিউইদের পাশাপাশি অন্যতম প্রতিপক্ষ ছিল বৃষ্টিও। সেমিফাইনালে প্রথমে ব্যাট করতে নামলে বৃষ্টির কারণে ৪৩ ওভার শেষে ২৮২ রানের সম্মানজনক টার্গেট ছুড়ে দেয় দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু বৃষ্টি আইনে কিউইদের টার্গেট গিয়ে দাঁড়ায় ২৯৩ রানে। দক্ষিণ আফ্রিকার ভাগ্য বরাবরের মতোই খারাপ। ২০১৫ বিশ্বকাপের ম্যাচটিও নিউজিল্যান্ড চার উইকেটের ব্যবধানে জয়লাভ করে ফাইনালে ওঠে। বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার ভাগ্য সহায় না হলেও চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে একটু আশার আলো দেখতেই পারে তারা। কেননা ১৯৯৮ সালের ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির প্রথম আসরের ফাইনালটি যে তারাই জিতেছিল! বর্তমানে ওয়ানডে র‌্যাঙ্কিংয়ে প্রোটিয়ারা এক নম্বরে থেকে চ্যাম্পিয়ন্স প্রফি শুরু করলেও ঘরের মাঠে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি হওয়ায় চোখ রাঙাচ্ছে ইংলিশরাও। তাই ১৯৯৮ সালের পর আবারও চমক দেখাতে হলে এবার একটু ব্যতিক্রম কিছুই করে দেখাতে হবে প্রোটিয়াদের। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে এবার লঙ্কানদের বিপক্ষে ৯৬ রানের বিশাল জয় দিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি শুরু করলেও দ্বিতীয় ম্যাচেই পাকিস্তানের কাছে ১৯ রানের পরাজয় মেনে নিতে হয় দক্ষিণ আফ্রিকাকে। এখন সামনে কেবল ভারত। ভারতকে হারালেই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালে উঠে যাবে প্রোটিয়ারা। তবে প্রশ্ন একটাই- দীর্ঘদিনের এ আক্ষেপ কি এবার ঘোচাতে পারবে প্রোটিয়ারা? চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ভারতের বিপক্ষে ‘ডু অর ডাই’ ম্যাচে ৮ উইকেটের বড় হারের পর অধিনায়ক ডি ভিলিয়ার্স যখন কথা বলছিলেন তখন যেন তার চোখ থেকে পানি বেরিয়ে আসছিল। হতাশার মাঝেও দলটির বড় তারকা জানিয়েছেন, এখনই নেতৃত্ব ছাড়ছেন না তিনি। ২০১৯ বিশ্বকাপকে টার্গেট করে এগিয়ে যেতে চান। এবি বলেন, ‘এটা অবশ্যই হতাশার। পাকিস্তান ও ভারতের বিপক্ষে দুটি ম্যাচেই আমাদের ব্যাটিং ভাল হয়নি। অনেকে আমার ব্যক্তিগত পারফর্মেন্স ও নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আপনারা কী ভাবছেন জানি না, আমার দৃষ্টিতে আমি ভাল অধিনায়ক! নেতৃত্বের প্রত্যেকটা মুহূর্ত উপভোগ করি।’ এরপরই তিনি বলেন, ‘আমি এ দলকে সামনে এগিয়ে নিতে চাই। আমি বিশ্বাস করি বিশ্বকাপ জয়ে আমি এ দলটিকে এগিয়ে নিতে যেতে পারব। এবারের টুর্নামেন্টেও এই একই স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু তা হয়নি। তারপরও এটাই আমার স্বপ্ন, আমি এ ধরনের স্বপ্ন দেখতে ভালবাসি।’ ভারতের বিপক্ষে বাঁচা-মরার ম্যাচে মাত্র ১৯১ রানে অলআউট হয় দক্ষিণ আফ্রিকা। এবি বলেন, ‘বাজে আউটগুলো টার্নিং পয়েন্ট হয়ে গেল।’ তিনজন ব্যাটসম্যান রানআউট হয়েছেন। রানআউটের শিকার ডি ভিলিয়ার্স নিজেও। এ রকম ডু অর ডাই ম্যাচে রানআউট যে কত বড় ভূমিকা নেয় তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। রঙ্গিন পোশাকের প্রোটিয়া অধিনায়ক বলেন, ‘এভাবে আমরা টুর্নামেন্ট শেষ করতে চাইনি। খুব হতাশ লাগছে। আমরা এ রকম ব্যাট করি না। আমরা ভালই খেলছিলাম। রানআউটগুলো সব গ-গোল করে দিয়েছে।’ আগের দুই ম্যাচে ২ ও ০ রানে আউট হওয়ার পর এবি বলেছিলেন, ‘ওই ম্যাচেও চেষ্টার কমতি রাখিনি। আমার বিবেচনায় ভাল কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু কলম আপনার হাতে আর দুর্ভাগ্যজনকভাবে আপনি কী লিখতে চলেছেন তা আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। আশা করি ভারত ম্যাচে নিজেকে প্রমাণ করতে পারব।’ অথচ এদিন মাত্র ১৬ রান করে রানআউট হয়েছেন। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে দুটি ম্যাচে হারের পর এখনই নিজেকে পরাজিত মানতে নারাজ অধিনায়ক ডি ভিলিয়ার্স। দলের নেতৃত্বেই থাকতে চান বিশ্বের অন্যতম সেরা এ ব্যাটসম্যান। অধিনায়কত্ব ধরে রেখেই দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে যেতে চান ২০১৯ বিশ্বকাপে। ভারতের কাছে লজ্জার হারের পরও নিজের অবস্থান নিয়ে ৩৩ বছর বয়সী ডি ভিলিয়ার্স অনেকটা সাহসের সঙ্গেই বলেছেন, যতদিন সুযোগ আছে তিনি এ ভূমিকায় থাকতে চান।
×