ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ইতিহাসে সাকিব-মাহমুদুল্লাহ

প্রকাশিত: ০৬:৫৭, ১৪ জুন ২০১৭

ইতিহাসে সাকিব-মাহমুদুল্লাহ

অভাবনীয় কাজটাই করেছেন দুইজন। পরিস্থিতি বিবেচনা করলে এমনটা আর ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে কোন ব্যাটসম্যান করে দেখাতে পারেননি। দেশের ক্রিকেটে সেরা সাফল্য এসেছে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান ও মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের অভূতপূর্ব ব্যাটিংয়ের কল্যাণে। প্রথমবারের মতো আইসিসির কোন টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে উঠেছে বাংলাদেশ দল। গত ওয়ানডে বিশ্বকাপের রানার্সআপ নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালে উঠেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। আর সেই জয়টা এসেছে সাকিব-মাহমুদুল্লাহর মধ্যে পঞ্চম উইকেটে গড়া রেকর্ড ২২৪ রানের জুটির মাধ্যমে। আর এই জুটি নিয়ে সারা বিশ্বেই হৈ চৈ পড়ে গেছে। উভয়ে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন যা ওয়ানডে ক্রিকেটে খুবই বিরল এবং বাংলাদেশের ক্রিকেটে একই ম্যাচে দুই সেঞ্চুরির ঘটনা দ্বিতীয়। তাই বিশ্বব্যাপী প্রশংসায় ভাসছেন সাকিব-মাহমুদুল্লাহ। ওয়ানডে ক্রিকেটে রেকর্ড জুটি গড়েছেন সাকিব ও মাহমুদুল্লাহ। পঞ্চম উইকেট নিজেদের রেকর্ডই ভেঙ্গেছেন এই দুই ব্যাটসম্যান। এর আগে ২০১৪ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১৪৮ রানের জুটি গড়েছিলেন সাকিব-মাহমুদুল্লাহ। ওই ম্যাচে ৭০ রানে ৪ উইকেট হারানোর পর তারা ১৪৮ রানের জুটি গড়েছিলেন। এবার কিউইদের বিরুদ্ধে গত শুক্রবার অবস্থাটা ছিল আরও ভয়াবহ। ৩৩ রানে শীর্ষ চার ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে ধুঁকতে থাকা বাংলাদেশকে পথ দেখান সাকিব ও মাহমুদুল্লাহ। পঞ্চম উইকেটে ২২৪ রানের জুটি গড়ে দলকে জয়ের বন্দরে নিয়ে যান। সাকিব ১১৫ বলে ১১৪ রান করে সাজঘরে ফেরেন আর মাহমুদুল্লাহ ১০৭ বলে অপরাজিত ১০২ রান করেন। শুধু পঞ্চম উইকেটের সর্বোচ্চ রানের জুটি গড়েননি সাকিব-মাহমুদুল্লাহ। ২২৪ রানের জুটি যে কোন উইকেটেই বাংলাদেশের সেরা জুটি। যে কোন উইকেট জুটিতে বাংলাদেশের আগের সর্বোচ্চ ছিল ১৭৮ রান। ২০১৫ সালে ঢাকায় পাকিস্তানের বিপক্ষে তামিম ইকবাল ও মুশফিকুর রহীম ১৭৮ রানের জুটি গড়েছিলেন তৃতীয় উইকেটে জুটি বেঁধে। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ইতিহাসে পঞ্চম উইকেটে এটিই প্রথম দুই শতাধিক রানের পার্টনারশিপ। অর্থাৎ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ইতিহাসে পঞ্চম উইকেটে সর্বোচ্চ জুটির রেকর্ড এখন বাংলাদেশের। পঞ্চম উইকেটে এর আগের সেরা ১৩৭ রানের জুটি গড়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্রায়ান লারা ও রুনাকো মর্টন। তারা অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ২০০৬ সালের ১৮ অক্টোবর মুম্বাইয়ে এ জুটি গড়েছিলেন। সেবার ৬৩ রানে ৪ উইকেট চলে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের। তবে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেরা জুটি অবিচ্ছিন্ন ২৫২ রানের। ২০০৯ সালের আসরে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে এটি দ্বিতীয় উইকেটে করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার শেন ওয়াটসন ও রিকি পন্টিং। সাকিব-মাহমুদুল্লাহর ২২৪ দুই নম্বরে। কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেনে পঞ্চম উইকেট তো বটেই, আজ পর্যন্ত কোন দলই কোন উইকেটে ২০০ রানের পার্টনারশিপ গড়তে পারেনি। বাংলাদেশই প্রথম দল যারা কার্ডিফের এ মাঠে কোন দুই শতাধিক রানের জুটি গড়ল। সবমিলিয়ে ৪৩ ওয়ানডে হয়েছে এখানে। আরেকটি বড় ব্যাপার হচ্ছে পঞ্চম উইকেটে ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে এটি তৃতীয় সেরা জুটির রেকর্ড। অবিচ্ছিন্ন ২৫৬ আছে জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫। অবিচ্ছিন্ন ২২৬ রানের জুটি আছে ইংল্যান্ডের, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৩ আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে। এরপরই সাকিব-মাহমুদুল্লাহ। তবে কোন ক্ষেত্রেই দলের পরিস্থিতি বাংলাদেশের মতো এত বেশি ভয়াবহ ছিল না। টিম সাউদির পেসে যখন কাঁপন ধরেছিল বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপে। ঠিক তখন সাকিব ও মাহমুদুল্লাহ ধরলেন হাল, দলের রান তখন ৪ উইকেটে ৩৩। এমন পরিস্থিতিতে আর কোন দল পড়ার পর এত বড় জুটি হয়নি। কল্পনাতীত জয় এসেছে বাংলাদেশের জন্য। অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজার মতে সাকিব-মাহমুদুল্লাহর এ জুটি ছিল এক কথায় ‘বিস্ময়কর’। ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে মাশরাফি বলেছেন, ‘সত্যি বলতে ওই সময় খুব কঠিন অবস্থায় ছিলাম আমরা। কিন্তু যখন জুটিটা ১০০ রানে পৌঁছাল তখন আমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম। কারণ আমি বুঝতে পারছিলাম এ দুইজন পার্থক্য গড়ে দিতে পারে, এটা তারা অনেক করেছে। কিন্তু আমি কখনও ভাবিনি যে তাদের জুটি ২০০ রানের বেশি হবে। এটা ছিল বিস্ময়কর।’ বাংলাদেশের অবাক করা এ জয়ে বিস্মিত হয়েছেন বিশ্বের সবাই। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিতে উঠবে টাইগাররা সেটাই কেউ কল্পনা করেননি। কিন্তু দলের এমন নৈপুণ্যে অবাক হননি অধিনায়ক মাশরাফি। তিনি বলেন, ‘আমরা গত তিন বছর ধরে উন্নতি করছি। এ ধরনের পারফরম্যান্স আমাদের এগিয়ে যেতে সত্যিই সহায়তা করছে।’ ৩৩ রানে ৪ উইকেট হারানোর পর সবকিছু বাংলাদেশের প্রতিকূলে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হেরে তাদের বিদায় নিশ্চিত মনে করে অনেকে হয়তো টিভি পর্দা থেকে সরে গিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবারও টিভির সামনে হাজির হতে হয়েছিল দর্শকদের। কারণ নীরবে ব্যাটিং করে যাওয়া সাকিব-মাহমুদুল্লাহর ব্যাট যে হাসছিল। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েও তারা কীভাবে ধীরস্থির ছিলেন সেটা হয়তো অবাক করেছে ভক্ত-সমর্থকদের। ম্যাচ শেষে পুরস্কার বিতরণীতে সেই রহস্য উন্মোচন করলেন সাকিব-মাহমুদুল্লাহ। কার্ডিফে ৩৪.৫ ওভারে ২২৪ রানের বিশাল জুটি গড়তে সাকিব-মাহমুদুল্লাহর ব্যাটিংয়ে কোন চাপের ছাপ দেখা যায়নি। স্বাচ্ছন্দ্যে খেলে গেছেন তারা। সফল জুটি গড়ার পেছনে মূলমন্ত্র কী ছিল জানালেন মাহমুদুল্লাহ। ১০৭ বলে ৮ চার ও ২ ছয়ে ১০২ রানে অপরাজিত থাকা এ ডানহাতি ব্যাটসম্যান বলেছেন, ‘আমাদের জুটির সেরা দিকটা হলো আমরা খুব বেশি কথা বলিনি। আমরা শুধু ব্যাট করে যেতে চেয়েছিলাম। শুধু ব্যাটিং করেছি এবং চেয়েছিলাম ইতিবাচক থাকতে।’ বল বুঝেশুনে খেলেছেন বলে ওই সময় ভুগতে হয়নি বলেছেন মাহমুদুল্লাহ, ‘শুরুর দিকে বল সুইং করছিল। পরে সুইং থেমে গেল, তখন ব্যাট করা সহজ হয়েছে। আমি মনে করি তামিম এ টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত ব্যাট করেছে। তাকে শুরুতে হারানো ছিল বড় ধাক্কা। আমরা শুধু জায়গা খুঁজে বলে শট নিয়েছি এবং খারাপ বলগুলো ছেড়ে দিয়েছি।’ পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে মাহমুদুল্লাহর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন সাকিব। ১১৫ রানের অসাধারণ ইনিংস খেলে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জেতা এ অলরাউন্ডার বলেছেন, ‘যেমনটা সে (মাহমুদুল্লাহ) বলল, আমরা কথা বেশি বলিনি। আর আমরা লক্ষ্য তাড়া করার জন্য খেলতে নামিনি। আমরা চেয়েছিলাম ৪০ ওভার পর্যন্ত ব্যাট করে যেতে, দেখুন কোথায় ছিলাম। আইসিসির প্রতিযোগিতায় একটি ম্যাচ জেতা বড় ব্যাপার। সেখান থেকে আমরা কেবল সামনেই যেতে পারি।’
×