ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম এলাকায় ব্যাপক প্রস্তুতি

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ৩০ মে ২০১৭

কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম এলাকায় ব্যাপক প্রস্তুতি

মোয়াজ্জেমুল হক/হাসান নাসির/এইচএম এরশাদ, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার থেকে ॥ বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ার পর এটি ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করে উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছে। আবহাওয়া অধিদফতর সোমবার সন্ধ্যায় তাদের সর্বশেষ বুলেটিনে ১০ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত ঘোষণা করেছে। আজ (মঙ্গলবার) সকাল নাগাদ এটির চট্টগ্রাম-কক্সবাজার উপকূল অতিক্রম করার সম্ভাবনা রয়েছে বলে আবহাওয়া দফতর সূত্রে আভাস দেয়া হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়টির নাম ‘মোরা’। প্রায় দুই সপ্তাহ দেশব্যাপী তীব্র দাবদাহের পর বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টি ও ঝড়োহাওয়া বয়ে গেছে ইতোমধ্যে। এরপর সাগরে সৃষ্টি হয়েছে নিম্নচাপ। পরে তা গভীর নিম্নচাপে রূপান্তরিত হওয়ার পর পরিণত হয়েছে ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’য়। সোমবার সন্ধ্যায় সর্বশেষ খবর অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড়টি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৪২৫ ও কক্সবাজার থেকে ৩৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণ দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল। এটি ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করে উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছে। আবহাওয়া দফতর থেকে ঘূর্ণিঝড়টির আঘাত কেন্দ্রে ৪ থেকে ৫ ফুট উচ্চতার সম্ভাব্য জলোচ্ছ্বাসের আভাস দেয়া হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় সার্বিক প্রস্তুতিতে অংশগ্রহণের জন্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে। সাগরে চলাচলরত মাছ ধরার ইঞ্জিনচালিত বোট, কার্গোবোট, ট্রলারসহ ছোট ছোট নৌযানকে ফিরে আসতে এবং নিরাপদ স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সোমবার ৬টা নাগাদ আবহাওয়া অফিস সূত্রে পূর্বাভাসের বরাত দিয়ে জানানো হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় উপলক্ষে চট্টগ্রাম বন্দর ও কক্সবাজারকে ১০ নম্বর এবং মংলা ও পায়রা বন্দরকে ৮ নম্বর বিপদ সঙ্কেত দেখাতে হবে। এদিকে মোরার প্রভাবে সাগর উত্তাল হয়েছে। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা ও কক্সবাজার উপকূলজুড়ে শক্তিশালী ঢেউ আছড়ে পড়ছে। ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় সরকার পক্ষ থেকে উপকূলীয় এলাকার প্রশাসনসমূহকে যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। সোমবার দুপুর ১২টা থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য আমদানি রফতানি পণ্যের ওঠানামা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ প্রবেশ ও ত্যাগ বন্ধ রাখা হয়েছে। শুধু তাই নয়, বন্দরের জেটিসমূহে নোঙর করে থাকা সব ধরনের জাহাজকে বহিঃসমুদ্রে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। বন্দর সূত্রে সোমবার সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখার সময় জানানো হয়েছে, সংস্থার পক্ষ থেকে পরিস্থিতি মোকাবেলায় জরুরী বিভাগের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্ট্যান্ড বাই থাকার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। অপরদিকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, জেলা প্রশাসন ও রেড ক্রিসেন্টের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড় ও ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় যাবতীয় প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসন ও সিটি কর্পোরেশন গঠন করেছে একটি মনিটরিং সেল। সিটি কর্পোরেশন পতেঙ্গা উপকূলীয় থেকে প্রয়োজনে জনবসতি এলাকা থেকে মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার সহযোগিতা দিতে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। ‘মোরা’র প্রভাবে সোমবার দিনভর চট্টগ্রামে ছিল গুমোট আবহাওয়া। এটি ক্রমশ উপকূলের দিকে এগিয়ে আসতে থাকায় বাড়তে থাকে আতঙ্ক। সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে জেলা প্রশাসন, সিটি কর্পোরেশন, স্বাস্থ্য বিভাগ, চট্টগ্রাম বন্দর এবং সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ। সোমবার বেলা ১২টার দিকে সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায় চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্য হ্যান্ডলিং কার্যক্রম। ৭ নম্বর বিপদ সংকেত জারি হওয়ার পরই বন্দর কর্তৃপক্ষ জারি করে নিজস্ব এলার্ট-৩। নির্দেশনা জারি হয় কর্ণফুলী নদী ও বন্দর চ্যানেলে অবস্থানকারী জলযানসমূহের ওপর। আবহাওয়া দফতর জানায়, ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ সোমবার বিকেল ৩টা নাগাদ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৪২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার থেকে ৩৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণ দক্ষিণ-পশ্চিমে, মংলা বন্দর থেকে ৪৯০ কিলোমিটার দক্ষিণ দক্ষিণ-পূর্বে এবং পায়রা বন্দর থেকে ৪১৫ কিলোমিটার দক্ষিণ দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থান করছিল। এটি আরও ঘনীভূত হয়ে উপকূলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়টির কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের এক টানা গতিবেগ ৬২ কিলোমিটার, যা দমকা ও ঝড়ো হাওয়ায় ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ও কক্সবাজারকে ১০ নম্বর বিপদ সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর এবং অদূরবর্তী দ্বীপ এবং চরাঞ্চলসমূহ এ বিপদ সঙ্কেতের আওতায় পড়বে। মংলা এবং পায়রা বন্দরকে ৮ নম্বর বিপদ সঙ্কেত দেখাতে বলা হয়েছে। ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরাঞ্চলসমূহ এই বিপদ সঙ্কেতের আওতায় পড়বে। চট্টগ্রাম আবহাওয়া দফতরের মোঃ রুবেল জানান, ঘূর্ণিঝড়টি মঙ্গলবার সকাল নাগাদ উপকূল অতিক্রম করতে পারে। বিপদ সঙ্কেত ৭ নম্বরে উন্নীত হওয়ার পরপরই জরুরী বৈঠক করে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সরকারী বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা। গৃহীত হয় ঘূর্ণিঝড় ও ঘূর্ণিঝড়পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় সিদ্ধান্ত, যা প্রত্যেকটি উপজেলা এবং থানা প্রশাসনকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রস্তুত রাখা হয়েছে আশ্রয়ণ কেন্দ্র, যাতে করে সম্ভাব্য দুর্যোগের কবলে পড়া সাধারণ মানুষ আশ্রয় গ্রহণ করতে পারে। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডাঃ আজিজুর রহমান সিদ্দিকী জানান, জরুরী স্বাস্থ্য সেবা প্রদান নিশ্চিত করতে চট্টগ্রাম নগরী এবং জেলার বিভিন্ন উপজেলার সকল চিকিৎসক, নার্স এবং চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। গঠন করা হয়েছে ২৪০টি মেডিক্যাল টিম। প্রাথমিক সেবা প্রদানের জন্য যা যা প্রয়োজন তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রস্তুত রয়েছেন টিম সদস্যরা। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানানো হয়, মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের নির্দেশে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। শহরের উপকূলীয় এলাকায় মাইকিং ছাড়াও সিটি কর্পোরেশনের সকল অফিস, ওয়ার্ড কার্যালয় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এছাড়া প্রয়োজনে যোগাযোগ এবং সেবা গ্রহণের জন্য কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে দুটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। কক্ষ দুটির টেলিফোন নম্বর ০৩১-৬৩০৭৩৯ এবং ০৩১-৬৩৩৬৪৯। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক জানান, ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলা এবং সম্পদ রক্ষায় প্রয়োজনীয় সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। বিপদ সঙ্কেত ৭ নম্বরে উন্নীত হওয়ার পর জারি করা হয় বন্দরের এলার্ট-৩। বেলা সাড়ে ১০টার পর থেকে বন্ধ হয়ে গেছে বন্দর জেটি এবং বহির্নোঙরে পণ্য ওঠানামা। ভারি যন্ত্রপাতি এবং নিজস্ব জাহাজগুলোকে নিরাপদে রাখতে সকল ব্যবস্থাই নেয়া হয়েছে। জেটিতে পণ্য খালাস করা খালি জাহাজ এবং বহির্নোঙরে অপেক্ষমাণ মাদার ভেসেলগুলোকে গভীর সমুদ্রে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর ছোট লাইটার জাহাজগুলোকে উজানে যাওয়ার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। বন্দর সূত্রে জানা যায়, সোমবার সকালে জেটি এবং বহির্নোঙর মিলে মোট ১২৭টি বড় জাহাজ অবস্থান করছিল। এর মধ্যে ১৬টি জাহাজ ছিল জেটিতে। সেগুলোকেও পণ্য খালাসের পর বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তবে বন্দর ইয়ার্ডে থাকা পণ্য ডেলিভারি স্বাভাবিক থাকে। যুব রেড ক্রিসেন্টের প্রস্তুতি ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র আঘাতের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলা, দুর্গত মানুষকে সহযোগিতা এবং উপকূলীয় ইউনিয়নগুলোর লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে মাইকিং করাসহ বিভিন্ন প্রস্তুতি নিয়েছে যুব রেড ক্রিসেন্ট চট্টগ্রাম। যুব রেড ক্রিসেন্ট চট্টগ্রামের যুব প্রধান ও রেড ক্রিসেন্ট জেলা ইউনিটের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ফখরুল ইসলাম চৌধুরী পরাগ জানান, সকালে জরুরী বৈঠকে মিলিত হন যুব সদস্যরা। এছাড়া জেলা প্রশাসক ও সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে জরুরী সমন্বয় সভা করা হয়। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি চট্টগ্রাম জেলা ও সিটি ইউনিটের সহযোগিতায় যুব রেড ক্রিসেন্ট চট্টগ্রামের কার্যালয়কে কন্ট্রোল রুম হিসেবে ঘোষণা করা হয়। যুব রেড ক্রিসেন্ট সদস্যরা কন্ট্রোল রুমের দায়িত্ব পালন করছেন। দুর্যোগে তাৎক্ষণিক সাড়া দেয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। জেলার সকল সাইক্লোন সেল্টার, উপকূলের স্কুল ভবনগুলোতে যুব সদস্য প্রেরণ করা হয়েছে এবং আশ্রয় কেন্দ্রে আসা লোকজনকে প্রয়োজন সাপেক্ষে ইফতার ও সেহরির ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। কক্সবাজার পরিস্থিতি ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ মোকাবেলায় জরুরী প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। সোমবার বেলা ১১টায় ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলা ও ঘূর্ণিঝড় পরিস্থিতি নিয়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে জরুরী সভা অনুষ্ঠিত হয়। ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় জেলার কয়েকটি স্থানে খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুম। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উপকূলীয় দ্বীপ কুতুবদিয়া, মহেশখালী, সেন্টমার্টিনের জনসাধারণকে সাবধানতার সঙ্গে অবস্থান করতে আহ্বান জানানো হয়েছে। জেলা প্রশাসক আলী হোসেন জানিয়েছেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে নিয়ে সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। সতর্ক সঙ্কেত আরও বাড়লে উপকূলীয় এলাকার লোকজনদের সাইক্লোন সেল্টারে সরিয়ে নেয়া হবে। ইতোমধ্যেই রেড ক্রিসেন্ট কর্মীরা সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছে। রাতের মধ্যে শুরু হবে মাইকিং। জেলার কয়েকটি উপজেলায় কন্ট্রোল রুম খোলার পাশাপাশি সাগরে মাছধরা অবস্থায় সকল ট্রলার ও ইঞ্জিনচালিত বোট, ফিশিংবোটকে উপকূলে ফিরে আসতে জরুরী নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আশ্রয় প্রার্থীদের জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত ইফতার ও সেহরি ব্যবস্থা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এদিকে সমস্ত ইউনিয়ন, উপজেলা ও উপকূলবর্তী এলাকায় মেডিক্যাল বোর্ড, সিপিবি, রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি, এনজিও সংস্থার সমস্ত সদস্যকে মাঠে থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকি মোকাবেলায় জেলা প্রশাসন জরুরী ভিত্তিতে খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুম।
×