ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ফ্রাঙ্ক এফ. ইসলাম

শততম জন্মদিন ॥ জন এফ কেনেডি

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ২৯ মে ২০১৭

শততম জন্মদিন ॥ জন এফ কেনেডি

দুঃখজনক হলেও সত্য যে বয়সের বিচারে জন এফ কেনেডি যিনি সারাবিশ্বে জেএফকে নামে আদৃত তার শতবর্ষে পা রাখা হয়নি। ২২ মে নবেম্বর ১৯৬৩ তে মাত্র ৪৬ বছর বয়সে আততায়ীর হাতে প্রাণ হারান সাবেক এই মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ডালাসের এক মোটর শোভাযাত্রায় স্ত্রী জ্যাকির পাশে উপবিষ্ট অবস্থায় নিহত হন ইতিহাসখ্যাত জনএফকে। তারই অকাল মৃত্যু প্রফেসর ডালেককে বাধ্য করেছে জেএফকে নিয়ে রচিত আত্মজীবনীর নামকরণ ‘একটি অসমাপ্ত জীবন’ রাখতে। তবে এও সত্য জেএফকের ক্ষুদ্র পরিসরের জীবনে তারা অর্জন নিয়ে তিনি বেঁচে আছেন এবং থাকবেন সময়ের ধারায়। জনএফ কেনেডি প্রেসিডেন্সিয়াল লাইব্রেরি ও মিউজিয়াম গত এক বছর ধরে কাজ করে চলেছে তার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনকে কেন্দ্র করে। সম্প্রতি তাদের ওয়েবসাইটে তারা জেএফকের রাজনৈতিক ও সামাজিক দর্শন তার সমাজ সংস্কারে সাহসিকতা এক কথায় তার অবদানকে তুলে ধরেছে সংক্ষিপ্তাকারে। সেখানে মূলত পাঁচটি ক্ষেত্রকে চিহ্নিত করে জেএফকের অবদান বর্ণিত হয়েছে। ক্ষেত্র পাঁচটি হলো- জনসম্পৃক্ততা, নাগরিক অধিকার, শান্তি ও কূটনীতি, শিল্প ও সংস্কৃতি এবং বিজ্ঞান ও উদ্ভাবন। ॥ এক ॥ দ্য পিস ক্রপস : ১৯৬১ তে কেনেডি প্রতিষ্ঠা করেন ‘দ্য পিস ক্রপস’ উদ্দেশ্য ছিল মার্কিন নাগরিকদের সঙ্গে অন্যান্য জাতির মানসিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনকে দৃঢ় করা। তারই উদ্যোগের গুরুত্ব অনুধাবনে আমাদের সে সময়ের বাস্তবতা বিবেচনায় নিতে হবে। বিভিন্ন কারণে বিশ্বের নানা প্রান্তে মার্কিনবিরোধী মনোভাব তখন প্রবল। জনএফ কেনেডি এই সত্যটি হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন ভবিষ্যত পৃথিবীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হয়ে টিকে থাকতে পারবে না। একক পরাশক্তি হয়ে গণতন্ত্রের বার্তাবাহকের ভূমিকায় নেতৃত্ব দিতে ইচ্ছুক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্য বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের মানুষের মানসিক সমর্থন একান্ত আবশ্যক। তাই তিনি প্রতিষ্ঠা করে দ্য পিস ক্রপস। পিস ক্রপসের গুরুত্ব এখনও ফুরিয়ে যায়নি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে পিস ক্রপসের প্রায় দুই লাখ স্বেচ্ছাসেবক ১৩৯টি দেশে কাজ করছেন। ॥ দুই ॥ নাগরিক অধিকার : আফ্রিকান আমেরিকানদের আইনগত অধিকারের পক্ষে কেনেডি ছিলেন এক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। এবং তা কোন খ-িত অধিকার নয়, পরিপূর্ণ আইনগত অধিকার। মার্কিন রাষ্ট্রব্যবস্থায় আফ্রিকান আমেরিকানদের অবস্থান এক বেদনাদায়ক ক্ষত। যা এখনও সম্পূর্ণ দূরীভূত হয়েছে তা বলা যায় না। সেই ১৯৬০ এর দশকে কেনেডি তার দূরদৃষ্টি এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিষয়টি অনুধাবন করেছিলেন। আফ্রো-আমেরিকানদের পূর্ণ নাগরিক অধিকার প্রদান করে একটি বিল প্রস্তুত করা হয় ১৯৬৩ তে। কেনেডির মৃত্যুর পর ১৯৬৪ তে এটি নাগরিক অধিকার আইন- ১৯৬৪ নামে অনুমোদন লাভ করে। আর সেই মুহূর্ত থেকে নাগরিক অধিকার আন্দোলন গতিশীল হয়ে বাধার প্রাচীর ভেঙ্গে নতুন পথে পা বাড়ায়। ॥ তিন ॥ শান্তি ও কূটনীতি : মৃত্যুর অল্প ক’দিন পূর্বে ১৯৬৩ এর অক্টোবরে কেনেডি সীমিতাকারে পারমাণবিক পরীক্ষা বন্ধে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও রাশিয়ার সঙ্গে। এর ঠিক ৩৩ বছর পর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ পারমাণবিক পরীক্ষা বন্ধে একাত্তর জাতি স্বাক্ষরিত একটি অঙ্গীকারপত্র গ্রহণ করে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন এতে স্বাক্ষর করলেও মার্কিন কংগ্রেস তা ৫১-৪৮ ভোটের ব্যবধান প্রত্যাখ্যান করে। ॥ চার ॥ শিল্প ও সংস্কৃতি : একজন নেতা হিসেবে মার্কিন শিল্প সংস্কৃতিতে জেএফকের ভূমিকা ও অবদান আজও অতুলনীয়। তার প্রেসিডেন্সির মেয়াদে তিনি নিজে নেতৃত্ব দেন ন্যাশনাল কালচারাল মিউজিয়াম গড়তে অর্থ সংগ্রহ কর্মসূচীতে। আততায়ীর হাতে নিহত হবার পর কংগ্রেস এই ন্যাশনাল কালচারাল মিউজিয়ামকে ‘লিভিং মেমোরিয়াল’ টু কেনেডিতে চিহ্নিত করে। এই ২০১৭ তেও কেনেডি সেন্টার পারফর্মিং আর্টের এক অন্যন্য নিদর্শন নিজস্ব স্বকিয়তায়। বলা হয় কেনেডি সেন্টার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যের প্রতিনিধি। মনে করিয়ে দেয় কেনেডির অমর উক্তি ‘শিল্পকর্ম আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির শেকড়ে পুষ্টি জোগায়’। ॥ পাঁচ ॥ বিজ্ঞান ও উদ্ভাবন : রাশিয়ার সঙ্গে মহাকাশ যুদ্ধে যখন লিপ্ত আমেরিকা, সে সময় ১৯৬১ তে কেনেডি তার জাতির সামনে এক উচ্চাভিলাষী স্বপ্ন উপস্থাপন করেন। তা হলো- এক দশকের মধ্যে চাঁদের বুকে পা রাখার স্বপ্ন। মে ৫, ১৯৬১ তে এলেন শেপার্ড প্রথম মার্কিনী হিসেবে মহাশূন্যে ভ্রমণ করেন। ফেব্রুয়ারি ১৯৬২ তে মহাকাশচারী ও পরবর্তীতে সিনেটর জন গ্লিন পৃথিবীর কক্ষ পরিভ্রমণ করেন। আর জুলাই ২০-১৯৬৯ এ এ্যাপোলো ১১-এর ক্রুরা চাঁদের বুকে পা রাখেন ও নিরাপদে ফিরে আসেন। কেনেডির দেয়া প্রতিশ্রুতি ভিত্তি করে শুরু হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ জয়যাত্রা। কেবল এ কয়টি ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিলেন না কেনেডি। বিচিত্র জীবন আর নানামুখী কর্মকা- তাকে দিয়েছে ইতিহাসের মহানায়কের সম্মান। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভারত-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক উন্নয়নে তিনি জোর দিয়েছেন এবং আন্তরিক ছিলেন। তিনি ধর্মীয় সার্বজনীনতা ও সহনশীলতায় বিশ্বাসী ছিলেন বরাবর। তার শাসনামলে তিনি দুজন বিশিষ্ট মার্কিন চিন্তানায়ক জন গেলব্রেথ এবং চেষ্টার বাউলকে ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করেন। যা তার ভারতকে গুরুত্ব দেয়ার প্রমাণ সেই সঙ্গে বর্তমান বাস্তবতা কেনেডির দূরদৃষ্টিকেই প্রমাণ করে। এছাড়াও ফার্স্টলেডি জ্যাকুলিন ভারত ও পাকিস্তান সফর করেন ১৯৬২-এর মার্চে। আরও গুরুত্বপূর্ণ যে, তিনি কেবল ভারত বিষয়ে প্রতিশ্রুতি কিংবা অঙ্গীকার ব্যক্ত করেই ক্ষান্ত হননি। প্রতিবছর অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ১ বিলিয়ন ডলার সাহায্য নিশ্চিত করেন যা ছিল যে কোন বিদেশী রাষ্ট্রে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ অর্থ সাহায্য। ভারতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো ছিল, খাদ্য সাহায্য আইআইটি যা পরবর্তীতে এমআইটি নামে পরিচিত, নার্গাজুন সাগরড্যাম অন্ধপ্রদেশ ও মুম্বাইয়ে প্রিমিয়ার অটোমোবাইল ফ্যাক্টরি। ব্যক্তি জীবনে একজন ক্যাথলিক হয়েও সকল ধর্মকে সম্মান করেছেন। নবেম্বর ১৯৬৩ তে নিউইয়র্কে প্রটেস্ট্যান্ট কাউন্সিলের সভায় তিনি বলেন- ‘মানুষের পরিবার কোন ধর্ম, বর্ণ, কোন নির্দিষ্ট শহর বা দেশে সীমাবদ্ধ নয়... মানুষের পরিবার গঠিত ৩ বিলিয়ন (তৎকালীন পৃথিবীর জনসংখ্যা) মানুষ নিয়ে। মনে রাখতে হবে এদের বেশির ভাগই নয় সাদা কিংবা খ্রীস্টান।’ প্রেসিডেন্ট কেনেডি শেষ করেন এই বলে, ‘এই এক পরিবারের সদস্যদের অবশ্যই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে।’ প্রফেসর ড্যালেকের ভাষায় আমার কানে ভেসে আসে কেনেডির সেই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের আহ্বান যা এই অস্থির বিশ্ব রাজনীতির উত্তাল সময়ে খুব বেশি প্রাসঙ্গিক।
×