ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ক্ষুদ্র সঞ্চয়ে সামাজিক যোগাযোগ এবং কমিউনিটি ব্যাংকিং প্রয়োজন

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ২৯ মে ২০১৭

ক্ষুদ্র সঞ্চয়ে সামাজিক যোগাযোগ এবং কমিউনিটি ব্যাংকিং প্রয়োজন

সময় ঘড়ির কাছে অক্লান্তি শুধু; অবিরল গ্যাসে আলো, জোনাকিতে আলো; কর্কট, মিথুন, মীন, কন্যা, তুলা ঘুরিতেছে; আমাদের অমায়িক ক্ষুধা তবে কোথায় দাঁড়াল। -জীবননান্দ দাশ অর্থনৈতিক উন্নয়নে ক্ষুদ্র সঞ্চয়কে মানবকল্যাণে কাজে লাগাতে হলে অবশ্যই রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় প্রাথমিক যোগাযোগ আর কমিউনিটি ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো যখন সামাজিক যোগাযোগ তত্ত্বের মাধ্যমে উন্নয়নে ভূমিকা রাখে তখন তা মোট জাতীয় উৎপাদনশীলতার সঙ্গে সংযুক্তি ঘটে থাকে। আর অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় যখন সামাজিক যোগাযোগ তত্ত্বটি কাজ করে তখন এটি মানুষের অস্তিত্ব ও বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে হতদরিদ্র ও দরিদ্রদের মধ্যে কাজ করে থাকে। নেলসন (১৯৫৬) সালে ‘লো লেবেল ইকোলোব্রিয়াম ট্রেপ’ তত্ত্বে দেখান যে, যদি উৎপাদন ব্যবস্থার উন্নতি না ঘটে এবং বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষ পদক্ষেপ না নেয়া হয় তবু সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটলে নিম্ন ভারসাম্যের হাত থেকে মানুষ তার অবস্থার উন্নতি সাধন করতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ তত্ত্বের কারণেই বর্তমান সরকার আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মকা- পরিচালনা করছেÑ যার মাধ্যমে মানুষ ক্ষুদ্র সঞ্চয় তথা সামাজিক পুঁজি যা ক্ষুদ্র বিনিয়োগে উৎসাহী হয় এবং ভোগ প্রবণতায় তার দক্ষতা ও পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়ে থাকে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র সঞ্চয় বাংলাদেশে তৃণমূল পর্যায়ে কমিউনিটি ব্যাংকিং চালুর মাধ্যমে উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৭ সালে বলেন যে, ক্ষুদ্র সঞ্চয় পরিণত হতে হবে সামাজিক পুঁজিতে যা ক্ষুদ্র বিনিয়োগে রূপান্তরিত হবে এবং দারিদ্র্য দূর করার জন্য ক্ষুদ্র সঞ্চয় সে দেশে নীরব বিপ্লব হিসেবে কাজ করে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূর করবে এবং পরিবর্তনশীলতায় আয় প্রবাহ সংযুক্ত মানুষ হিসেব প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই প্রতিষ্ঠা পাওয়ার কাজ সুষ্ঠুভাবে করা যাবে। ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদের চিন্তা-চেতনায় মানব-মর্যাদা প্রতিষ্ঠার বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশে বর্তমান সরকার অর্থনীতি বিকশিত করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যা গ্রামীণ অর্থনীতিসহ শহরের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছে। সামষ্টিক অর্থনীতিকে আরও বেগবান করতে ব্যাস্টিক অর্থনীতির ভিত্তিকে শক্তিশালী করতে হবে। সময়ের বিবর্তনে যদিও যৌথ পরিবার ভেঙ্গে একক পরিবার সৃষ্টি হচ্ছে, তবু বর্তমান প্রেক্ষাপটে এখন পর্যন্ত এ দেশে সামাজিক যোগাযোগ গুরুত্ব বহন করে থাকে। তবে এখন একক পরিবারে দ্বন্দ্বের কারণে বিয়ে বিচ্ছেদ বাড়ছে। এটি দীর্ঘ মেয়াদে সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করবে। এদিকে সম্প্রতি কানাডিয়ান কোর্টে রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে আমাদের জানা কথা ‘কাদম্বরী দেবী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই’Ñ সে রূপ পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি হয়নি এ মহা সত্যটি পরিস্ফুট হয়ে উঠল। অথচ দেখা যায় যে, যারা ঘরে বসে অভিযোগ করছেন মিথ্যার বেসাতী, যেহেতু একটি চক্রের মাধ্যমে হয়েছিল আর তারাও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বলে পত্রিকান্তরে রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে। তাই বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না। তাদের বক্তব্য অনুসারে, যারা অন্যায়ভাবে জাতি, দেশ ও সমাজের ওপর কলঙ্কের তিলক এবং কালিমালেপন করে দিলেনÑ তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না। তাদের স্মরণ করে দিতে চাই, রাহুল সাংস্কৃত্যায়নের (২০১৫) লেখায় বোমারু বিমানটির পাহারাদার জঙ্গী বিমানগুলোকে ফাঁকি দিয়ে সে বোমারু বিমানটিকে ধ্বংস করে দেয় সেই সঙ্গে সুমের ও তার সঙ্গী বিমান চালকটিও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। পঞ্চম স্তম্ভ বোধহয় বছরের পর বছর এভাবেই সহস্র বছরের অধিককাল ধরে নিজে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। তারপরও নিজের আখের গোছানোর জন্য সব সময়ে পঞ্চম স্তম্ভের লোকেরা বিভিন্ন পর্যায়ে সুবিধা আদায় করে থাকে। আবার সামাজিক যোগাযোগকে কেউ কেউ ক্ষমতাতন্ত্রের কাছে থাকার উৎস মনে করে। একটি দেশের উন্নয়নের জন্য বিশেষত দারিদ্র্য থেকে মুক্তির জন্য বর্তমান একবিংশ শতকের দ্বিতীয় যুগে সামাজিক যোগাযোগ যথেষ্ট মাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ হলেও এটি অলিখিতভাবে হাজার বছর ধরে কেবল বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দারিদ্র্যের দুষ্টুচক্রের হাত থেকে বাঁচার অবলম্বন হিসেবে অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে বিশেষত, প্রাচ্যে যারা দেশে দেশে, কালে কালে যুক্ত রয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ তত্ত্বটি বহুল একটি প্রচলিত ব্যাপার। এটি অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ করেছে। এখনও দেশের কর্মসংস্থানের গড় হচ্ছে ৮০%-এর ওপর অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে। সামাজিক যোগাযোগ তত্ত্বের মাধ্যমে মানুষের ক্ষমতায়ন প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক উভয়ভাবেই ঘটে থাকে। শেখ হাসিনা (২০১৭) বলেন, দরিদ্ররা তাদের আত্মসম্মান পুনরুদ্ধার এবং তারা সঞ্চয়ী হলে ভয় মুক্তভাবে বাস একবারে বন্ধ করা যাবে। আমরা গরিব হারিয়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হতে চাই দরিদ্রদের সঙ্গে নিয়ে। এ জন্য নিজেদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে বলে সরকারপ্রধান বলেছেন। শেখ হাসিনা (২০১৭) বলেন যে, মাইক্রো সেভিংস দারিদ্র্য থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করবে। এলজিআরডি মন্ত্রণালয় দ্বারা দেশে ৪০ হাজার ৫২৭ গ্রামে বর্তমানে কাজ করে চলছে। তিনি বলেন, ইসলাম নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্য করার অনুমতি দেয় না; বরং তাদের অধিকার নিশ্চিত করে এবং তাদের মুক্তির জন্য সুযোগ প্রদান করে। ‘নারীদের অবশ্যই তাদের নিজেদের ভবিষ্যত তৈরি করতে হবে। আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন করে তাদের আত্মবিশ্বাস দিতে হবে। বাংলাদেশ সরকার কোন সন্ত্রাসী ও অপরাধমূলক কাজকর্ম সমর্থন করে না।’ এসডিজি বাস্তবায়নে এবং কর্মমুখী শিক্ষার প্রসার ঘটানোর ক্ষেত্রে সরকার বিভিন্নভাবে প্রয়াস গ্রহণ করেছে। এক্ষণে কমিউনিটি ব্যাংকিং ব্যবসা এবং সামাজিক নেটওয়ার্কিংকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর আওতায় এনে ক্ষুদ্র সঞ্চয় সংগ্রহ করতে সামাজিক পুঁজি গঠন এবং ক্ষুদ্র বিনিয়োগের মাধ্যমে সামাজিক উদ্যোগ তৈরি করার জন্য হোলিস্টিক এ্যাপ্রোচ প্রয়োজন। আসলে এ দেশের মানুষের মেধা, মনন ও বুদ্ধিমত্তার কমতি নেই। বস্তুত, সামাজিক শিক্ষা তা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে হোক কিংবা অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে হোক তা মানুষের সুপ্ত জ্ঞানকে কাজে লাগায়। কারিগরি কলা-কৌশল এক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা পালন করে থাকে। মোবাশ্বের আলী (২০১৭) মন্তব্য করেছেন যে, বাংলাদেশের মানুষ আত্মানুসন্ধানের পথে ক্রমাগত এগিয়ে চলেছে এবং তার অভীষ্ট লক্ষ্যে চলার বিরাম নেই। বর্তমান পরিস্থিতি ২০১৭ সাল বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি উল্লেখযোগ্য বছর। এ সময়ে অর্থনীতির অগ্রযাত্রা অব্যাহত ছিল। যদিও বৈশ্বিক সমস্যা ছিল, বিশেষত, মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতিতে আগের রমরমা অবস্থান নেই। ফলে বিদেশ থেকে প্রবাসীদের অর্থ প্রেরণ কিছুটা কমা স্বাভাবিক। অন্যদিকে গত শতাব্দীর শেষ দশকে এবং একবিংশ শতকের প্রথম দশকে যেখানে পোশাক খাত থেকে রফতানিলব্ধ আয় ছিল গড়ে ৭৫%-এর মতো, আর তা বর্তমানে বেড়ে ৮২% হয়েছে। অবশ্য হিসাব করে দেখা গেছে, রফতানিলব্ধ আয়ের ক্ষেত্রে বিশেষত পোশাক শিল্পের ক্ষেত্রে ভ্যালু এডিশন হচ্ছে মাত্র ৩০%। এডিবির (২০১০-১২) প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায়, কৃষিখাতে ৯৯% কর্মসংস্থান এবং অকৃষি খাতে ৮২% অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় গঠিত হচ্ছে। অবশ্য গত ৮ বছরে এ চিত্রের উন্নতি হয়েছে। বর্তমান সরকার যেখানে পেটে-ভাতের রাজনীতির বাস্তবায়নে সাফল্য দেখাচ্ছে, সেখানে ব্যাংকিং সেক্টরকে দুর্নীতি মুক্ত এবং ত্রুটিপূর্ণভাবে আরও দৃঢ়তার সঙ্গে জনগণের ও সমাজের কল্যাণে এগিয়ে আসতে হবে। ড. আতিউর রহমানের পর বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক আর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশিত ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশনের ক্ষেত্রে আগের মতো জোর দিচ্ছে না। এ নির্দেশনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ব্যাংকিং সেক্টরকে অবশ্যই দৃঢ় ভূমিকা পালন করতে হবে। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিতে ভয়েস অব আমেরিকার সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে গবর্নর থাকাকালীন সময়ে ড. আতিউর রহমান অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন (২০১৫) যে, বাংলাদেশে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থ ব্যবস্থার আওতায় আনাকে সর্বোচ্চ জাতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করেন। বর্তমান যুগের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্বতন ভূমিকা কেবল মুদ্রানীতি পরিচালনা, বিনিময় হার নির্ধারণ, লেন্ডার অব দি লাস্ট রিসোর্ট, মার্জিন রিকোয়ারমেন্টের ওপর নির্ভর করে কর্মপরিচালনা জোর দেয়া বন্ধ হয়ে গেছে। আধুনিক কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রা পরিচালনার ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি হ্রাসের পাশাপাশি ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশনের কাজ করে থাকে। দীর্ঘকাল ধরে যে পুঞ্জীভূত দুর্নীতি বিরাজ করছিল সরকারের প্রয়াস সত্ত্বেও তাতে তেমন সাফল্য পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ভারতে বর্তমানে কালো টাকা বন্ধে যে পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে একজন অর্থনীতি চর্চাকারী হিসেবে আমি মনে করি, এটি বেশ কঠোর পদক্ষেপ হয়ে গেছে। এর ফল সে দেশে কতটুকু সুফল বয়ে আনবে ভবিষ্যতই বলবে। তবে বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার ক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছার অভাব নেই। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এমডিজি অর্জনে বাংলাদেশের অগ্রগতি বেশ ভাল ছিল। তবে এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরো রফতানিক বহুধাবিভক্তকরণে তেমন কৃতকার্য হয়নি। এমনকি বিদেশে বাংলাদেশের এ্যাম্বেসিসমূহ দায়সারা গোছের কর্মকা- পরিচালনা করে থাকে। আবার এনবিআর দক্ষতার সঙ্গে সক্ষমভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। ফলে প্রত্যক্ষ করের বদলে অপ্রত্যক্ষ কর বেড়েছে। এতে প্রান্তিক মানুষের কষ্ট বাড়বে। বৃহত্তর পরিসরে এসডিজি বাস্তবায়নের উদ্যোগে সরকারের দৃঢ়চিত্ত ভূমিকার সঙ্গে জাতীয় পরিকল্পনা ও বাজেট এবং কলাকৌশল; প্রতিষ্ঠান ও সমন্বয় সাধন; যাতে সবাই অন্তর্ভুক্ত হয়, তথ্য ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার প্রয়োজন রয়েছে। এসডিজির যে ১৭টি মূল লক্ষ্য রয়েছে এবং টার্গেট হচ্ছে ১৬৯টি সেগুলো হচ্ছেÑ দারিদ্র্যের সকল ধরনের পরিসমাপ্তি, ক্ষুধার পরিসমাপ্তি, খাদ্যনিরাপত্তা অর্জন, খাদ্য উপাদানের মান উন্নয়ন এবং স্থায়িত্বপূর্ণ কৃষির প্রসারমানতা, স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন এবং সব বয়সের মানুষের কল্যাণ সাদন, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সকলের জন্য সমস্ত জীবন-ভর শিক্ষার ব্যবস্থা করা, নারী-পুরুষ সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা এবং নারীর ক্ষমতায়ন, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার প্রাপ্যতা এবং টেকসই ব্যবস্থাপনা, সকলের জন্য জ্বালানির প্রাপ্যতা, সহজলভ্যতা এবং টেকসই পদ্ধতির বাস্তবায়ন, অন্তর্ভুক্তিমূলকতা, অর্থনৈতিক অগ্রগতির টেকসই, বাস্তবসম্মত কর্মসংস্থান পদ্ধতি এবং উপযুক্ত কর্মসংস্থান, অবকাঠামো তৈরি করা, শিল্পায়নকে প্রসারিত ও টেকসই করা এবং অভিনবত্ব ও বৈচিত্র্য আনয়ন করা, দেশের অভ্যন্তরে অসাম্য দূর করা, টেকসই ভোগ প্রবণতা এবং উৎপাদন ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা, আবহাওয়াজনিত পরিবর্তনের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা, সমুদ্র, নদ-নদী এবং জলজ সম্পদের সঠিক ব্যবহার করা এর মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব, যাতে করে প্রাকৃতিক ব্যবস্থা ঠিক থাকে, বনায়নের ব্যবস্থাপনা করা এবং বন সংরক্ষণ করা, ভূমি সংরক্ষণ এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা, শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের ব্যবস্থা করা, সকলের জন্য ন্যায়বিচার ও সমতা বিধান করা, কার্যকর হিসাবরক্ষণ করা এবং সর্বক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা করা, সঠিকভাবে নিয়ম পদ্ধতি অনুসরণ করে কল্যাণমুখী কার্যক্রমসমূহের বাস্তবায়ন করা এবং বিশ্বব্যাপী অংশীদারিত্বের মাধ্যমে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে কর্মসংস্থানের হার তুলনামূলকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর তুলনায় বেশি। এ ছাড়াও, ১৫ থেকে ৪৪ বছর বয়স্ক কর্মপ্রার্থীর ৬০%-এর বেশি। এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের বর্তমান সরকার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সম্প্রতি পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আয়োজিত এক সভায় ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ (২০১৭) মন্তব্য করেছেন যে, সরকার দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও মানবকল্যাণের জন্য এসডিজি বাস্তবায়নে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যা দেশ এবং দেশের মানুষের উন্নয়নমুখী জীবনযাত্রার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। আসলে এসডিজি বাস্তবায়নে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারী খাত আর শর্তমুক্ত বৈদেশিক সাহায্য-সহযোগিতা সমন্বিত ভূমিকা দেশের উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। বেসরকারী খাত সচরাচর সেখানেই বিনিয়োগ করে থাকে যেখানে তাদের বিনিয়োগ ধনাত্মক হয় এবং অনেকখানি মুনাফা অর্জন করতে পারে। অন্যদিকে বিদেশী রাষ্ট্রগুলো সচরাচর শর্তযুক্ত সাহায্য অনুদান এবং ঋণ প্রদান করে থাকে, যা অনেক সময়ে গ্রহীতা রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গল বয়ে আনে না। এমনকি যারা শর্ত আরোপ করে নিজের দেশের মুনাফা বৃদ্ধি করতে চায় তা শেষ পর্যন্ত আবার তাদের দেশেরই ক্ষতির কারণ হতে পারে। তবে এসডিজি বাস্তবায়নের কলাকৌশল অবশ্যই আমাদের মতো করে আমাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে নির্ধারিত হতে হবে। বিশ্বায়নের যুগে যদিও বৈশ্বিক মানদ- রয়েছে তবে তা আমাদের দেশের জন্য কতটুকু অনুকূল তা কিন্তু নীতিনির্ধারকদের ভাল করে যাচাই-বাছাই করতে হবে। নচেৎ দেশের মানুষের জন্য মঙ্গলজনক না-ও হতে পারে। তবে এসডিজি বাস্তবায়নে প্রচুর পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন রয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের রাষ্ট্রে পরিণত হতে পেরেছে। খুব বেশি হলে পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যেই তা অর্জন করা যাবেÑ যদি বর্তমান ধারায় অর্থনৈতিক অগ্রগতি, শিল্প ক্ষেত্রে সার্বিক উন্নয়ন, সুষম বণ্টন ব্যবস্থা, জীবনমান উন্নয়ন ধারা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বিশেষ উদ্যোগ বহাল থাকে। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আওতায় সীমিত ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালিত হয় বিধায় এটি দ্বারা বিশাল অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর আওতায় আনা যাবে না। বরং পূর্ণাঙ্গ ব্যাংকিং লেনদেন যদি বিধিবিধান মোতাবেক স্থানীয় পর্যায়ে কমিউনিটি ব্যাংকিং করা যায় তবে ভাল হবে। এমনকি বিচ্ছিন্নভাবে যে কো-অপারেটিভ ব্যাংকিং চালু হচ্ছে তাদের নির্দিষ্ট কোন রেগুলেটর নেই। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক বিনিয়োগ ছাড়াও স্থানীয় উদ্যোক্তাদের কর্মসংস্থানমুখী বিনিয়োগ আগামী বছরগুলো অনেক বেশি মাত্রায় শিথিল শর্তে বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিবছর বৃদ্ধি পাওয়া দরকার। দেশের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে গৃহীত পদক্ষেপসমূহ দাতাগোষ্ঠী কিংবা বিশেষ বেসরকারী উদ্যোক্তাদের কর্তৃক নির্ধারিত না হয়ে বরং দেশের উপযুক্ত ও লাগসই হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। নচেৎ অনেক ক্ষেত্রেই এ ধরনের বিনিয়োগ বাড়তি ঋণের বোঝা বৃদ্ধি করবে। তবে আমাদের উন্নয়নের রোল মডেল এ দেশের তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু হয়েছে এটি একটি ভাল পদক্ষেপ। সামুদ্রিক সম্পদ আহরণের ব্যবস্থা আরও বাস্তবসম্মতভাবে গ্রহণ করা প্রয়োজন। নচেৎ এই সম্পদের অনেকখানি প্রতিবেশী দেশগুলো নিয়ে নিতে পারে। কারিগরি কলাকৌশল উদ্ভাবনে আধুনিকতা ও বৈশ্বিকতার পাশাপাশি এ দেশের উপযোগী নানামুখী প্রযুক্তি তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। এসব প্রযুক্তির ব্যবহারে দেশীয় জনবল তৈরি করতে হবে। আঞ্চলিক সহযোগিতা সব সময়ে দেশের জন্য ইতিবাচক যাতে হয় সে জন্য দরকষাকষি ও শর্তাবলী নির্ধারণের ক্ষেত্রে দেশের স্বার্থ, বৈজ্ঞানিক কলা-কৌশল ও জনকল্যাণের বিষয়টি মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা, বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে মানুষের জন্য হিত সাধন কেবল পেশা না হয়ে নেশা হিসেবে দেখতে হবে। এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা রয়েছেÑ সেগুলো বিভিন্নমুখী কর্মকা- ও কর্তৃপক্ষের আওতায় পরিচালিত হচ্ছে। তার বদলে সমন্বিত করার জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করে একক কমিটির নেতৃত্বে ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদের মতো নির্লোভ ব্যক্তির নেতৃত্বে এসডিজির সব লক্ষ্য বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ, তদারকি এবং কোন ত্রুটিবিচ্যুতি থাকলে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই করতে হবে। আর প্রয়োজনের নিরিখে পরিকল্পনা পাল্টাতে হবে অর্থাৎ পিডিসি-এ করতে হবে। ভাল করে রাজনৈতিক ইচ্ছা, আইনগত পদ্ধতি, লিঙ্গভিত্তিক সমতার লক্ষ্য রাখতে হবে। এ দেশের সিংহভাগ জনসংখ্যা বর্তমানে ৪৪ বছরের নিচে। এদের প্রতি লক্ষ্য রেখে কেবল সরকার নয় বেসরকারী খাতকেও তাদের কর্মসংস্থানের কৌশল তৈরি করতে হবে। এদিকে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশ দায়ী না হলেও এখন পর্যন্ত কেবল বাংলাদেশ নয়, অধিকাংশ ক্ষতিগ্রস্ত দেশই ক্ষতিকারক দেশ থেকে ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে না। জনসচেতনতা এবং ব্যক্তিগত স্বার্থের উর্ধে উঠে কাজ করতে হবে। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা বাঞ্ছনীয়। চলবে.... লেখক : শিক্ষাবিদ
×