ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম

সংবিধান কাটাছেঁড়ায় কষ্ট পাই

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২৯ মে ২০১৭

সংবিধান কাটাছেঁড়ায় কষ্ট পাই

আরাফাত মুন্না ॥ যাদের সংবিধান সম্পর্কে ধারণা নেই তারাই সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন প্রখ্যাত আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমীর উল ইসলাম, তিনি সংবিধানের অন্যতম প্রণেতাও। বিচারক অপসারণে সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল ভারসাম্যপূর্ণ পদ্ধতি বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। সুপ্রীমকোর্টের বিচারক অপসারণ ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে করা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী হাইকোর্টে বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপীলের অষ্টম দিনের শুনানিতে বৃহস্পতিবার তিনি এসব মন্তব্য করেন। তিনি আপীল বিভাগের নিযুক্ত এ্যামিকাস কিউরি (আদালতকে সাহায্যকারী) হিসেবে বক্তব্য উপস্থাপন শেষ করেছেন। চতুর্থ এ্যামিকাস কিউরি হিসেবে বক্তব্য উপস্থাপন শুরু করেছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম আই ফারুকী। তিনিও সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের পক্ষে মত দিয়েছেন। পরে সোমবার পর্যন্ত এ শুনানি মুলতবি করেন আপীল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা নেতৃত্বাধীন আপীল বিভাগের সাত বিচারপতির আপীল বেঞ্চে ষোড়শ সংশোধনী মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেনÑ বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার। রবিবার বেলা সাড়ে ১১টায় সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী সংক্রান্ত মামলার শুনানি শুরু হয় আপীল বিভাগে। শুরুতেই ব্যারিস্টার এম আমীর উল ইসলাম তার অসমাপ্ত বক্তব্য উপস্থাপন শুরু করেন। দুপুর ১২টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত উপস্থাপন করেন তিনি। এরপর এ্যামিকাস কিউরি হিসেবে বক্তব্য উপস্থাপন শুরু করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম আই ফারুকী। এ মামলায় মোট ১২ জন আইনজীবীকে এ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ দিয়েছেন সুপ্রীমকোর্ট। এর মধ্যে সাবেক বিচারপতি টিএইচ খান ও ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ বৃহস্পতিবারই তাদের বক্তব্য উপস্থাপন শেষ করেন। রবিবার শেষ করছেন ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম। এ সময় আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত ছিলেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা। রিটকারীদের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন এ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। শুনানিতে ব্যারিস্টার এম আমীর উল ইসলাম বলেন, নির্বাচনী বিরোধ নিয়ে যেসব মামলা হয়, সেগুলোর শুনানি ও নিষ্পত্তি হয় হাইকোর্টে। এসব মামলার নিষ্পত্তি করেন হাইকোর্টের বিচারপতিরাই। এখন বিচারকদের অপসারণের বিষয়টি যদি সংসদের হাতে থাকে তাহলে ভারসাম্য নষ্ট করবে এবং বৈপরীত্য সৃষ্টি করবে। তিনি বলেন, আমাদের সুপ্রীমকোর্টের বিচারকরা তিনটি সামরিক শাসনের কবল থেকে আমাদের বাঁচিয়েছেন এবং সংবিধানকে রক্ষা ও পুনরুদ্ধার করেছেন। সংসদ ও গণতান্ত্রিক ধারাকে অব্যাহত রাখতে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার বিকল্প নেই। তিনি বলেন, ইয়াজ উদ্দিন ও ফখরুদ্দিন যে অসাংবিধানিক সরকার গঠন করেছিলেন সেখান থেকে ফিরে আসতে হাইকোর্টের বিচারপতিরাই ভূমিকা রেখেছে। ওই সরকার হাইকোর্টকে জামিন না দিতে জরুরী ক্ষমতা বিধিমালা জারি করেছিল। হাইকোর্টই কিন্তু সেই বিধিমালা বাতিল করেছিল। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে তিনি বলেন, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে ফ্লোর ক্রসিংয়ের ক্ষেত্রে বাধা রয়েছে। কিন্তু আমরা বঙ্গবন্ধুর আমলে সব সময় সংসদীয় দলের সভায় সবকিছু আলোচনা করার সুযোগ পেতাম। ৭০ অনুচ্ছেদ থাকা সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক রীতিনীতি প্রয়োগ করা যেতে পারে। তাতে কোন বাধা নেই। সংবিধানের ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলি সংক্রান্ত একটি ধারা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ১৫০ (২) অনুচ্ছেদে ১৯৭১ সালে ৭ ও ২৬ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর দেয়া ভাষণ এবং ওই বছরের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলি হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এটা কেন হবে? এগুলো কি সাংবিধানিক ভাষা? বঙ্গবন্ধুর ভাষণ তো অমরত্ব লাভ করেছে। আর মুজিবনগর সরকার তো বাংলাদেশের প্রথম সরকার। যাদের সংবিধান সম্পর্কে কোন ধারণা নেই, তারাই সংবিধান কাটাছেঁড়া করে এসব ভাষা ব্যবহার করেছে এবং সংশোধনী এনেছে। এ কারণেই সংবিধান পড়তে আমার খুব কষ্ট হয়। তিনি বলেন, গণতন্ত্র ও সংবিধানের ধারাবাহিকতা অক্ষুণœ রাখতে সুপ্রীমকোর্ট সব সময় গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছে। বিভিন্ন সামরিক শাসন আমলে সংবিধানকে যেভাবে কাটাছেঁড়া করা হয়েছে সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ, বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী, বিচারপতি খায়রুল হকের বিভিন্ন রায়ে সেগুলো পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। এই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা জাতির কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সংবিধানের চতুর্থ, পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী মামলার রায়েই বিচারপতিরা তা প্রমাণ করেছেন। এসব ক্ষেত্রে সুপ্রীমকোর্টের ভূমিকা প্রশংসনীয়। ব্যারিস্টার আমীর বলেন, সংবিধানের অভিভাবক, গণতন্ত্র ও আইনের শাসকের রক্ষক এবং সুবিচার প্রতিষ্ঠার প্রতিফলন হিসেবে সুপ্রীমকোর্ট কাজ করে চলেছে। সেই কাজের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সরকার ও সংসদ সম্পূর্ণ সহযোগিতা এবং প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক বরাদ্দ দেবেন এটাই প্রত্যাশা। তিনি আরও বলেন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের বিচার বিভাগের সঙ্গে নির্বাহী ও আইন বিভাগ একে অপরের সম্পূরক হিসেবে কাজ করে থাকে। সে জন্য আমাদের দেশের ঐতিহ্য ও ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে এ সম্প্রীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিচারক অপসারণে সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের পক্ষে মত দিয়ে তিনি বলেন, সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল ভারসাম্যপূর্ণ একটি পদ্ধতি। এটা যেভাবে চলে আসছে এবং তার যে অর্জন ও সফলতা সেটা দেশবাসী গৌরবের চোখে দেখে। এই গৌরবকেই আমাদের সমন্নত রাখতে হবে। নির্বাহী এবং আইন বিভাগ তেমনি একটি পরিবেশ সৃষ্টির জন্য তাদের সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে হবে। পরে শুনানিতে এ্যাডভোকেট এম আই ফারুকী বলেন, ৫ম সংশোধনী বাতিল রায়ে সুপ্রীমকোর্ট সামরিক শাসনামলে জারি করা সকল ফরমান বাতিল করলেও সুপ্রীম জুডিসিয়াল ব্যবস্থাকে রেখে দিয়েছেন। এরপর সরকার ১৫তম সংশোধনীতেও এ ব্যবস্থা রেখে দিয়েছেন। এ অবস্থায় বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে দিয়ে সংবিধানের ১৬তম সংশোধনী করেছে সরকার। কিন্তু এই ১৬তম সংশোধনী স্বাধীন বিচার বিভাগ ও গণতন্ত্রের মৌলিক কাঠামোর লঙ্ঘন। তিনি বলেন, বিচারকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তা তদন্ত হতে হবে বিচারকদের দিয়েই, রাজনীতিবিদদের দিয়ে নয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতেই ছিল। বঙ্গবন্ধুর সময় চতুর্থ সংশোধনী হলে তা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয়। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের কাছে ন্যস্ত হয়। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী পরে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে বাতিল হয়। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে আনা হয়। এর বিরুদ্ধে কয়েকজন আইনজীবী আদালতে গেলে গত বছরের ৫ মে হাইকোর্টের দেয়া রায়ে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে হাইকোর্টে ওই রায় আসে। হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করে রাষ্ট্রপক্ষ। গত ৮ মে পেপারবুক থেকে রায় পড়ার মাধ্যমে এই মামলার আপীল শুনানি শুরু হয়। এরপর ৯ মে দ্বিতীয় দিনের মতো শুনানি হয়। এ দুইদিন রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা হাইকোর্টের রায়ের ওপর আদালতে শুনানি করেন। এরপর ওইদিনই আদালতে চারজন এ্যামিকাস কিউরি তাদের লিখিত মতামত জমা দেন। তারা হলেনÑ সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার এম আমীর উল ইসলাম, ছাড়াও এম আই ফারুকী ও আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া। সে দিন আদালত ২১ মে শুনানির পরবর্তী দিন নির্ধারণ করেন। এর আগে গত ৮ ফেব্রুয়ারি এই মামলায় আপীল শুনানিতে সহায়তার জন্য ১২ জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে এ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ দেন আপীল বিভাগ। তারা হলেনÑ সাবেক বিচারপতি টি এইচ খান, ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার এম আমীর উল ইসলাম, ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, এ এফ হাসান আরিফ, এম আই ফরুকী, ব্যারিস্টার ফিদা এম কামাল, এ জে মোহাম্মদ আলী ও আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া।
×