ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

এহসানুল হাবিব

গানের শাটল প্রাণের শাটল

প্রকাশিত: ০৬:৫৩, ২৮ মে ২০১৭

গানের শাটল প্রাণের শাটল

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। শাটল ট্রেনের বিশ্ববিদ্যালয়। সুউচ্চ পাহাড়, আকাশের সঙ্গে মিতালী গড়া বৃক্ষরাজি। আঁকাবাঁকা রাস্তা, পাহাড়ের বুকচিরে নেমে আসা স্বচ্ছ পানির ঝরনা। প্রাকৃতিক লেক, বিভিন্ন প্রজাতির গাছ এবং বন্যপ্রাণী। চারদিকে সবুজের ছড়াছড়ি। প্রকৃতি যেন তার সব সৌন্দর্য উজাড় করে দিয়েছে এ ক্যাম্পাসে। সৌন্দর্যপিপাসু, প্রকৃতিপ্রেমী যে কোন মানুষের কাছে নয়নাভিরাম এ ক্যাম্পাস আকর্ষণীয়। বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে হাটহাজারী উপজেলার ফতেয়াবাদ ইউনিয়নে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান। ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর ১৭৫৪.৫৩ একর পাহাড়ী ও সমতল ভূমি নিয়ে পথচলা শুরু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের। কলা অনুষদের অধীনে বাংলা, ইংরেজী, ইতিহাস ও অর্থনীতিÑ এ চারটি বিভাগে ৭ জন শিক্ষক ও ২০২ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকার্যক্রম শুরু হয়। প্রথম উপাচার্য ছিলেন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ড. আজিজুর রহমান মল্লিক [এ আর মল্লিক]। এখন ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার এবং ৮০০ শিক্ষক এবং প্রায় দেড় হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। বিভাগ আছে ৪৩টি। বর্তমানে উপাচার্যের দায়িত্বে আছেন ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী। শহর থেকে দূরে হওয়ায় চবির শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম শাটল ট্রেন। প্রতিদিন ১০Ñ১২ হাজার শিক্ষার্থী শাটল ট্রেনে যাতায়াত করে। শাটল ট্রেন আর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় একসূত্রে গাঁথা। শাটল ট্রেনকে কেন্দ্র করেই রচিত হয় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাসি-কান্না, আনন্দ বেদনার মহাকাব্য। ১৯৮৪ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় রুটে শাটল ট্রেনের পথচলা শুরু। কালের গর্বে হারিয়ে গেছে অনেক বছর, বেড়েছে বিভাগ, বেড়েছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ভিড়। তবুও শুরুর দিন থেকে আজ পর্যন্ত চবির শিক্ষার্থীদের নিকট শাটল ট্রেন সমান জনপ্রিয়। বাড়তি খরচ, যানজট ও বেহাল সড়ক এড়িয়ে শিক্ষার্থীরা শাটল ট্রেনে যাতায়াত করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে বেশি। তাই হুড়োহুড়ি আর গাদাগাদি করে হলেও বন্ধুদের সঙ্গে ক্যাম্পাসে যাওয়ার জন্য শাটলই একমাত্র ভরসা। শাটল ট্রেনের প্রতিটা সিট যেন এক একটা সোনার হরিণ। এখানে সিট দখলের জন্য চলে তীব্র প্রতিযোগিতা। বই, খাতা, ব্যাগ, পত্রিকা, খাতার পৃষ্ঠা, পানির বোতল, এমনকি ছোট পাথরের টুকরো দিয়েও সিট ধরতে দেখা যায়। বন্ধুদের মধ্যে কোন একজন সিট ধরবে এবং দলের অন্যরা ট্রেন ছাড়ার আগ মুহূর্তে স্বগৌরবে হাজির হবে। সিটের দখল রাখতে এবং দখল রুখতে শিক্ষার্থীদের মাঝে বাকবিত-া নতুন কিছু নয়। সকালে শাটল ট্রেনের হুইসেলে জেগে উঠে চবি ক্যাম্পাস। কর্মচঞ্চলতা শুরু হয় সবার মাঝে। শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে চাকসু, ঝুপড়ি, ক্যান্টিন, ক্যাফেটেরিয়া, প্রত্যেকটি বিভাগ, পুরো বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন। ক্যাম্পাসমুখী সকাল সাড়ে সাতটা ও সকাল আটটার ট্রেনের পর শহরমুখী দুপুর দেড়টা ও আড়াইটার ট্রেনে সবচেয়ে বেশি ভিড় লক্ষ্য করা যায়। ধারণ ক্ষমতার চেয়ে তিনগুণের বেশি শিক্ষার্থীকে শাটল ট্রেন তার বুকে-পিঠে জায়গা করে দেয়। দুজনের সিটে তিনজন বসার পর কেউ কেউ উঠে পড়েন হেলান দেয়ার জায়গায়, দুপাশে দু’পা ঝুলিয়ে। বগির ভেতরের বাকি জায়গাটুকুতে যে যেখানে পারে কোন মতে দাঁড়িয়ে ঠাঁই করে নিতে পারলেই হলো। দরজায় কাগজ পেতে দু’জন, দরজার হাতলে বাদরঝুলা হয়ে ঝুলতে ঝুলতে যাবে তিন থেকে চারজন। ইঞ্জিন এবং প্রতিটি বগির ছাদে শিক্ষার্থীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাতায়ত করে। আগন্তুকদের কাছে এ দৃশ্য ভয়ঙ্কর ঠেকলেও এটি চবির শাটল ট্রেনের প্রতিদিনকার চেনা দৃশ্য। গ্রীষ্মের দুপুরে তপ্ত রোদে এক একটা বগি হয়ে ওঠে মুড়ির টিন সদৃশ। শেষ হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন প্লাটফর্ম ছাড়তে না ছাড়তে শুরু হয় শিক্ষার্থীেেদর আড্ডা আর গান। শিক্ষার্থীদের আড্ডার বিষয় হয়ে ওঠে সমকালীন রাজনীতি, খেলাধুলা, সিনেমা, ক্লাসে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা, টিউশনি কিংবা প্রেমসহ আরও নানা কিছু। চবির শাটল ট্রেনে যাতায়াতকারী শিক্ষার্থী ও দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে বগিভিত্তিক সংগঠনগুলোর সদস্যদের গাওয়া গান। ট্রেনের ঝকঝক শব্দ আর ট্রেনের বগি চাপড়ে তোলা ছন্দ ও তালে তালে গাওয়া গানগুলো যাত্রাপথের ক্লান্তিকে কমিয়ে দেয় অনেকখানি। কাউকে কাউকে গুনগুন গলায় কণ্ঠ মিলাতে দেখা যায়। কেউ কেউ কানে হেডফোন লাগিয়ে পছন্দের গান শুনতে শুনতে গন্তব্যপানে এগিয়ে চলে। ফেসবুক বা গেম নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় অনেককে। যাদের পরীক্ষা থাকে তাদের চোখ থাকে বইয়ের পাতায় কিংবা হ্যান্ডনোটে। শাটলের বুকে যেমন রচিত হয় কোন কপোত-কপোতির প্রেম কাহিনী তেমনি এ শাটলের বুকেই বহু প্রেমিক জুটির মনোমালিন্য বিচ্ছেদে রূপ নেয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতি মূলত শাটল ট্রেনের বগিভিত্তিক গ্রুপকে কেন্দ্র করে। বগিভিত্তিক বেশকিছু গ্রুপের মধ্যে ভিএক্স, একাকার, সিক্সটি নাইন, সাম্পান, এপিটাফ, ককপিট, খাইট্টা খাঁ উল্লেখযোগ্য। শিক্ষার্থীদের প্রিয় এ বাহনে যখন ছাত্ররাজনীতির কালো থাবা পড়ে, তখন ঝিমিয়ে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। বন্ধ হয়ে যায় ক্লাস-পরীক্ষা। বাড়ে সেশনজট। শাটল ট্রেন শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বাহন হলেও এতে বহিরাগতদের আনাগোনাও চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে ছিন্নমূল নারী ও শিশু। সকালের ট্রেনে ক্যাম্পাসে এসে কাগজ প্লাস্টিকের বোতল, লাকড়ি, শুকনো পাতা ইত্যাদি বস্তা ভরে বিকেলের ট্রেনে শহরে ফিরে যায় ওরা। প্রচ- ভিড়ের মাঝে তাদের আনাগোনা বিরক্তির কারণ হলেও মানবিকতার খাতিরে শিক্ষার্থীরা মুখ বুজে তা সহ্য করে। শাটল ট্রেনের পরিবেশ অনেক সময় ছাত্রীদের মনে তিক্ত অভিজ্ঞতার জন্ম দেয়। ধুলোবালি, ভ্যাপসা গরম, অত্যধিক ভিড়, সবমিলে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হয় ছাত্রীরাই। বর্তমানে চবিতে দুটি শাটল ট্রেন বিশ্ববিদ্যালয় রুটে চলাচল করে। প্রতিটিতে বগি সংখ্যা সাতটি কালেভদ্রে আটটি বগিও চোখে পড়ে। বিশালসংখ্যক শিক্ষার্থীর যাতায়াতে বগির এ সংখ্যা মোটেও যথেষ্ট নয়। তবে প্রতিবছর ভর্তি পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে বগির সংখ্যা বাড়ে, বাড়ে ট্রেনের শিডিউলও। মাত্র ২০-২৫ মিনিটের রাস্তা পাড়ি দিতে শাটলের কচ্ছপ গতির কারণে সময় লাগে প্রায় ১ ঘণ্টা। পৃথিবীর মাত্র দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য নিজস্ব শাটল ট্রেন সার্ভিস আছে । একটি যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকো ইউনিভার্সিটি এবং অন্যটি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। অবশ্য কিছুদিন আগে সানফ্রান্সিসকো ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ তাদের শাটল সার্ভিস বন্ধ ঘোষণা করে। যার ফলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ই এখন এ ঐতিহ্যের একমাত্র দাবিদার। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে চবির শিক্ষার্থীরা শাটল ট্রেনকে সবচেয়ে বেশি মিস করে। চবির শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা, তাদের প্রাণের প্রিয় শাটল ট্রেনের আধুনিকায়ন, বগি বাড়ানোসহ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে কর্তৃপক্ষ। [email protected]
×