ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শাহীন রেজা নূর

আমাদের পররাষ্ট্রনীতি ও বিএনপির রাজনীতি

প্রকাশিত: ০৩:৩৮, ২৮ মে ২০১৭

আমাদের পররাষ্ট্রনীতি ও বিএনপির রাজনীতি

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারও সঙ্গে বিদ্বেষ নয়’ সেই ১৯৫৬ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে প্রণীত হয়েছিল। অর্থাৎ, তিনি পররাষ্ট্রনীতি হিসেবে এই ধারাটিকে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিলেন। তাই আমরা তাকে তখন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারতসহ সকলের প্রতিই বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করতে দেখি। তা অবশ্য আজ থেকে ৬ দশক আগের কথা আর তখন বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতিও ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। গণতান্ত্রিক আর সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা তখন পরস্পরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে যেন! তা সত্ত্বেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার মধ্যেই সার্বিক সাফল্য খুঁজে ফেরাকে শহীদ সাহেব সেদিন বাস্তবোচিত পদক্ষেপ বলে গণ্য করেছিলেন। মাত্র এক বছরকালের জন্য প্রধানমন্ত্রী হবার সুবাদে তিনি এক্ষেত্রে বেশ সাফল্যও অর্জন করেছিলেন। দীর্ঘ সময় পেলে নিশ্চয়ই এ সাফল্য অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হতো। সে যাই হোক, বাহাত্তরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হবার পর তাঁর নেতা ও রাজনৈতিক গুরু সোহরাওয়ার্দীর সেই পররাষ্ট্রনীতিকেই আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিও তাই তাঁর আমলে ‘সকলের প্রতি বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়’ এই ধারাটিকেই সমুন্নত রেখেছিল। আজ তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার শাসনামলেও ওই একই পররাষ্ট্রনীতি অনুসৃত হচ্ছে। আগেই বলেছি, ১৯৫৬-৫৭, ১৯৭২-৭৫ আর আজকের সময় ও পরিস্থিতির মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক বিধায় এখনকার সময়ের কঠিন বাস্তবতায় তা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সহজসাধ্য নয়। কেননা, এখন গ্লোবাল ভিলেজ, গ্লোবাল ইকোনমি, গ্লোবালাইজেশন ইত্যাদি শব্দের মারপ্যাঁচে বন্ধুত্বকে আদর্শ স্থানীয় করে তোলার ক্ষেত্রে অনেক প্রকার অন্তরায় দেখা দেয়। এখন উন্নত দেশগুলো তার ব্যবসায়-বাণিজ্যিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যটাকে অনেক বড় করে দেখে। ফলে তা হাসিলের জন্য সবরকমের চাপ-তাপ প্রয়োগে এরা এখন পিছপা হয় না আর এর কুফল বয়ে বেড়াতে হয় উন্নয়নশীল বা তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোকে। এই উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নয়ন অংশীদার বা ডেভেলপমেন্ট পার্টনার বনার সুবাদে উন্নত দেশগুলো অনেক সময়ই নানান অন্যায় চাপিয়ে দেয় দরিদ্র দেশগুলোর ওপর। এটা যে সেই ঠা-া লড়াইয়ের যুগে বা তারও আগে একেবারেই ছিল না তা নয়। তবে তখন তা এতটা ক্রুড বা অশোধিত ছিল না। সাম্র্রাজ্যবাদের ক্রুর দন্ত-নখর সে যুগেও হিংস্র্রভাবে মেলে ধরতে দেখা গেছে, তবে আজকের দিনের মতো তা নিশ্চয়ই এতটা হিংসাশ্রয়ী ছিল না। সে যাক, বর্তমানে কর্পোরেট পুঁজির অবিশ্বাস্য ও বেপরোয়া বিস্তৃতির যুগে দরিদ্র দেশগুলোর অস্তিত্ব অনেকাংশে বিপন্ন হবার জোগাড়। এই পুঁজি গোটা বিশ্ব ব্যবস্থাকেই সম্পূর্ণভাবে ওলট-পালট করে দিয়ে এক একটি রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা, অর্থনীতি ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ এবং চিন্তা-চেতনাকে এক প্রকার বন্ধ্যাত্মের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। সারাবিশ্বেই যেন স্থবির চিন্তা-চেতনার পোয়াবারো আর তাই আমরা ধর্মীয় উগ্রতার এক উলঙ্গ বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করছি বিশ্বজুড়ে। ধর্মহীন ধর্মান্ধতা প্রকারান্তরে গোটা পৃথিবীজুড়ে এক হতাশার চালচিত্র তৈরি করেছে। আমাদের মাত্র একটি প্রজন্ম আগের মানুষ ধর্ম বিষয়ে অনেক মানবিক চিন্তা-চেতনায় সমৃদ্ধ ছিলেন। সকল মানুষকেই সমান চোখে দেখার এবং কোন প্রকার বিদ্বেষ বা হিংসাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নিজেদের তারা বিরত রাখতে পারতেন, সমাজে প্রগতিবাদী চিন্তা আর ন্যায়নীতিভিত্তিক জীবনধারণের প্রয়াস-প্রচেষ্টা ও প্রকৃত ধর্মীয় মূল্যবোধ যা কিনা মানবতার রসে জারিতÑ তারই অনুশীলনের মাধ্যমে। কিছু লোক যে বিদ্বিষ্ট মনের ও ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থের জন্য উগ্রতা এবং অন্যায়ের দ্বারস্থ হতো না তা নয়, তবে বেশিরভাগই ছিল উদার ও সৎ। এতসব কথার অবতারণা এজন্যই করা হলো যে, আজকের বিশ্বের দিকে তাকিয়ে বাহ্যিকভাবে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানগত উন্নতির চাকচিক্য বা চোখ ঝলসানো নিদর্শনসমূহ দৃষ্টে আমরা নিজেদের উন্নতির চরম শিখরে অবস্থান করছি বলে মনে করতে পারি বটে; কিন্তু সে মনে করাটা যে কতখানি বিভ্রান্তিকর ও ভুল তা বোঝা যায় জগতজুড়ে মানবতা ও মানবাত্মার চরমতম লাঞ্ছনা দৃষ্টে। এই লাঞ্ছনা ও অবমাননার পশ্চাদভূমিতে আছে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার যাবতীয় ধ্বংসাশ্রয়ী ভাইরাস। পুঁজি তার বিস্তার বা প্রসারের লক্ষ্যে এমন কোন অন্যায়-অবিচার নেই যা করতে পারে না। কথাটি বিশ্বের বড় দার্শনিক-অর্থনীতিবিদদের কথারই সংক্ষিপ্ততম প্রতিধ্বনি মাত্র! আজ আমরা বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের জোয়ারের জন্য গর্ববোধ করছি; কিন্তু সমাজ-সংসার এই উন্নতির তোড়ে যে দুমড়ে-মুচড়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে সে বিষয়টি কারও চোখ এড়ায় না নিশ্চয়ই। যা হোক, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি সৃষ্টির বেদিমূলে যে চরম ত্যাগ-তিতিক্ষার বিবরণী রয়েছে তা থেকেই আমরা এই ধারণায় উপনীত হতে পারি যে, কু সর্বদাই সু-কে পরাভূত করতে চাইলেও মানুষের সম্মিলিত আশা-আকাক্সক্ষা ও শক্তির কাছে কু-এর শক্তি অকিঞ্চিৎকর বৈ নয়! পাকিস্তান সেই পঞ্চাশ ও ষাটের দশকজুড়ে আমাদের ওপর যে বিমাতাসুলভ আচরণ করেছে তার বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধ এবং সে যুদ্ধে জয়লাভ ভিন্ন আমাদের জন্য কোন বিকল্প ছিল কি? ছিল না, সে যুদ্ধে মুষ্টিমেয় কুলাঙ্গার ব্যতীত গোটা জনগোষ্ঠীর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল আর প্রতিবেশী ভারতের সার্বিক সহযোগিতা ছিল বলেই আমরা আমাদের মুক্তির তরীটিকে তীরে এনে ভিড়াতে সক্ষম হয়েছিলাম। নতুন সৃষ্ট রাষ্ট্রটিকে সেই শিশু অবস্থাতেই ধ্বংস করার চক্রান্ত পরাজিত পাকিস্তান একেবারে প্রথম দিন থেকেই করে চলেছে। এজন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা, জেলখানায় ৪ জাতীয় নেতার নির্মমভাবে হত্যাকা- থেকে শুরু করে বছরের পর বছর যাবত মুক্তিযুদ্ধের সেই প্রগতিবাদী ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে সমূলে উৎখাতের জন্য পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই আর তাদের সৃষ্ট এদেশের দালাল চক্র নিরবচ্ছিন্নভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিএনপি বা সেনা শাসনাধীনে বাংলাদেশ থেকে বাঙালী জাতীয়তাবাদী সকল উপাদান আর মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ উপড়ে ফেলে পাকিস্তানবাদী প্রতিক্রিয়াশীল ধারার পুনঃপ্রবর্তনেরই সচেতন প্রয়াস লক্ষ্য করা গেছে। বিএনপি-জামায়াত আর এরশাদের শাসনাধীনে এরই ধারাবাহিক প্রয়াস-প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল। বাঙালী জাতীয়তাবাদকে হিন্দুয়ানী বিষয় বলে আখ্যা দিয়ে ওই শাসকরা তাদের পূর্বসূরি সেই পাকিস্তানী প্রতিক্রিয়াশীল শাসকদের মতোই এতে ‘মুসলমানী’ জাতীয়তাবাদ সন্নিবেশের জন্য সীমাহীন মূর্খতায় মেতে ওঠে। আজও ক্ষমতাহীন অবস্থাতে বিএনপি-জাতীয় পার্টি ইত্যাদিকে ওই একই ভাবধারায় আচ্ছন্ন ও একই ধারাটিকেই রাষ্ট্রে পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য নানাবিধ ষড়যন্ত্র এবং চক্রান্তে মেতে থাকতে দেখা যাচ্ছে। একটি প্রগতিবাদী রাষ্ট্র বিনির্মাণে দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলের যা করণীয় তা না করে বার বার ‘ভারত জুজুর’ ভয় দেখিয়ে দেশবাসীকে পাকিস্তানবাদী চিন্তা-চেতনায় আচ্ছন্ন করার জন্য সদাসক্রিয় রয়েছে তারা। তাদের এই অবস্থাটি স্বাধীন বাংলাদেশের মূল চেতনার সম্পূর্ণ বিরোধী। আর তাই তাদের বাংলাদেশবাদী দল হিসেবে ভাবা যায় না। এরা আদতে পাকিস্তানী চেতনার উত্তরাধিকারী ও বাঙালী জাতীয়তাবাদী চেতনার বিরুদ্ধবাদী দল মাত্র। এ জায়গাতেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে এদের ফারাক। আওয়ামী লীগ ভারতের কাছে বাংলাদেশকে বিক্রি করে দিয়েছে এহেন মিথ্যা প্রচারের মাধ্যমে দেশবাসীর মনকে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিষিয়ে তোলার এক পুরনো খেলায় তারা আজও মত্ত। লক্ষণীয়, চীন-জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশ যখন কোন প্রকার বড় চুক্তিতে আবদ্ধ হয় তখন এরা নিশ্চুপ থাকে। কিন্তু ভারতের সঙ্গে যে কোন প্রকার সমঝোতা বা চুক্তি করলেই তা তাদের মতে ভারতের কাছে বাংলাদেশকে বেচে দেয়া। আজকের দুনিয়ায় কোন দেশের পক্ষেই যে একা বা বিচ্ছিন্নভাবে বাস করা সম্ভব নয় এই সত্যটিকে তারা মাথায় নিতে নারাজ যদি কিনা সমঝোতা ভারতের সঙ্গে হয়। ভারত যেহেতু আমাদের মুক্তি সংগ্রামে এদেশের হতদরিদ্র, বিপদাপন্ন ও নিরাশ্রয় মানুষের পরম সুহৃদ হিসেবে পাশে দাঁড়িয়েছিল এবং আজও মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে সমুন্নত রাখতে সকল দেশী-বিদেশী চক্রান্তের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের পাশে শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে সেজন্য ওই পাকিস্তানবাদীদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। আর তাই নানান মিথ্যার জাল বিস্তার করে বিএনপি-জামায়াত ও তাদের তাঁবেদাররা আওয়ামী লীগকে হেয়প্রতিপন্ন করার চক্রান্তে লিপ্ত। প্রথমেই বলেছি যে, ভারতের সঙ্গে কোন প্রকার সমঝোতা হলে তা এদের চক্ষুশূল। আর এটিই তাদের পাকিস্তানবাদী রাজনীতির পরিচায়ক। অথচ চীনের সঙ্গে বা অন্য কারও সঙ্গে এ জাতীয় চুক্তি বা সমঝোতাÑ তা যদি অসঙ্গত ও অন্যায়ও হয় তবু তারা সেক্ষেত্রে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকে। সকলেই জানেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে উন্নয়নমূলক নানান চুক্তি ও সমঝোতায় উপনীত হয়েছে। তন্মধ্যে চীনের সঙ্গেই সবচাইতে বেশি অর্থের চুক্তি হয়েছে। চীন বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ ঋণ প্রদানে সম্মত হয়েছে। চীন যে সকল দেশে ঋণের ভা-ার খুলে দিয়ে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সেসব দেশে ওই ঋণ লাভের অভিজ্ঞতা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সুখবর না হওয়া সত্ত্বেও বিএনপি ও এর তল্পীবাহকরা এই ঋণ বিষয়ে কিন্তু স্পীকটি নট অবস্থানে রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন মিডিয়ায় এটি স্ফটিকের মতোই স্পষ্ট যে, শ্রীলঙ্কা, গিনি, গায়ানা, পাকিস্তান, মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশে চায়না ঋণে নির্মিত বা নির্মিতব্য প্রকল্পসমূহ সেসব দেশের জন্য নানান বিপদ ও সঙ্কট বয়ে এনেছে এবং আনছে; সেখানে বিএনপি নেতারা এ বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করে বাংলাদেশে চীনা ঋণে বাস্তবায়ন বিষয়ক প্রকল্পসমূহের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিচ্ছেন না এবং তা শ্রীলঙ্কা, গিনি, গায়ানা, মিয়ানমার, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের এ জাতীয় চীনা ঋণের অভিজ্ঞতার আলোকে বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখছেন না। তাদের অনুসন্ধানে যদি প্রতীয়মান হয় যে, চীনা ঋণ বাংলাদেশের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই সঙ্কট বয়ে আনবে তাহলে সে বিষয়টিকে জোরেশোরে ও যুক্তি-ব্যাখ্যা উপস্থাপনের মাধ্যমে তুলে ধরাটাও তো বিরোধী দল হিসেবে তাদের কর্তব্য। কিন্তু তারা সে পথে পা মাড়াবে না। কেননা, চীনকে বিরাগভাজন করলে তাদের বিদেশী একজন মিত্রকে খোয়াবার ভয় থেকে যায় যে। ভারতের ব্যাপারে তারা তিলকে তাল বানাতে পারে, সত্যকে মিথ্যা দিয়ে সম্পূর্ণভাবে ঢেকে দিতে পারে, অথচ চীন কিংবা অন্য কোন দেশের ব্যাপারে সাত চড়েও তাদের মুখে রা কাড়ে না। এর রহস্য কি? সেই রহস্যটিই তো জানা দরকার আমাদের সকলের। ভারতবিরোধী রাজনীতিই হচ্ছে বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির প্রধানতম হাতিয়ার। এদের কাছে ভারত মানেই হিন্দুত্ব আর হিন্দুত্ব মুসলমানদের কাছে পরিত্যাজ্য একটি বিষয়। সুতরাং, বাংলাদেশ সংখ্যা গণনার বিবেচনায় মুসলিম প্রধান দেশ হওয়ায় (টু নেশন থিওরি) একে মুসলমান বাংলা বানানোর নামে ওই অসাধু শাসক চক্র ধর্মভীরু সাধারণ মুসলমানদের মনে ভারতবিদ্বেষ তথা সাম্প্রদায়িকতা ঢুকিয়ে দেবার যে অপচেষ্টা করে চলেছে সেটিই ওদের রাজনীতির মূল ধারা। এ বিষয়টিকে চাঙ্গা রেখে মানুষকে বিভ্রান্ত করা আর ফায়দা লোটার রাজনীতিতে ওরা পারঙ্গম। মিথ্যা আর গোঁজামিল দিয়ে পাকিস্তান আমলের কুশাসকরা আমাদের ওপর যেসব ইলজাম সেদিন চাপিয়ে দিয়েছিল সত্যের আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে একাত্তরে তা সম্পূর্ণভাবে ব্যাক ফায়ার করে। কিন্তু পঁচাত্তরের নির্মম নৃশংসতার বদৌলতে তারা পুনরায় পাকিস্তানকেই ভাবাদর্শগত ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এদের নিজেদের মধ্যে আসলে ইসলামত্ব বা মুসলমানত্ব বলে কিছুই নেই। এদের এমন কিছুই নেই যা কিনা প্রকৃত ইসলাম ও মুসলমানত্বের বিরোধিতা করে না। বিএনপি-জামায়াত নেতাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার তত্ত্ব-তালাশ নিলেই প্রকটভাবে এ বিষয়টি ধরা পড়বে যে, এদের জীবনে ইসলাম নিছক দুনিয়াবী স্বার্থোদ্ধারের নিমিত্ত মাত্র। ব্যক্তিজীবনে অসাধুতা, অসততা, মিথ্যাচার ও গিবত গাওয়া আর অন্য নানাবিধ নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি এদের গভীর আকর্ষণই প্রমাণ করবে এরা আসলে ধর্মকে নিজ ও গোত্রীয় স্বার্থে ব্যবহার করে চলেছে। আবারও বলছি, বিরোধী দলের মূল কাজ ও দায়িত্বই হচ্ছে সরকারী দলের নানান দুর্বলতা কিংবা সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে কৃত ভুলত্রুটিসমূহ ধরিয়ে দেয়া। চীনের ঋণে নির্মিত শ্রীলঙ্কার হামবানতোতা বন্দরটি আজ কিভাবে শ্রীলঙ্কার সার্বভৌমত্বের প্রতি আঘাত হয়ে দেখা দিয়েছে কিংবা গিনি, গায়ানা, মিয়ানমার, নাইজিরিয়ায় এ জাতীয় ঋণের কারণে কি দুর্দশা দেখা দিয়েছে বিএনপি নেতাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত তার অনুসন্ধান করা। এ বিষয়ে প্রাপ্ত তথ্যাদির ভিত্তিতে যদি দেখা যায় যে, আসলেই এ ধরনের ঋণ বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা, সমৃদ্ধি বা উন্নয়নের বিরোধী তাহলে সোচ্চার কণ্ঠে এর প্রতিবাদে এগিয়ে আসা বিএনপি নেতাদের কর্তব্য নয় কী! শুধু ভারতের সমালোচনা করে বুজরুকি না দেখিয়ে দয়া করে অন্য দেশের দিকে তাকান। পররাষ্ট্রনীতিতে সকলের প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলেও বর্তমান পৃথিবীতে এই বন্ধুত্ব বজায় রাখাটা কতখানি সহজ সেটিও ভাবা দরকার নিশ্চয়ই। শুধু গালভরা দোষারোপ আর মিথ্যার বেসাতি না করে সরকারের ভুল-অসঙ্গতি আর ত্রুটিগুলোকে মেলে ধরুন আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখার উদ্দেশ্যে। লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
×