নদ-নদী, খাল-বিল ও হাওড়-বাঁওড়ে ঘেরা মাদারীপুর জেলার ইতিহাস বহু প্রাচীন। এক সময় এই জনপদ ছিল অবহেলিত ও অনুন্নত। বর্তমান শতাব্দীর গোড়ার দিকে বড় বড় নদ-নদী ও তার শাখা প্রশাখা, খাল-বিল ও হাওড়-বাঁওড় এ অঞ্চলকে জালের মতো বিস্তার করে রেখেছিল। তখনকার দিনে যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে ছিল একমাত্র নদী পথ। সে সময় অর্থ্যাৎ ১৯২০ সালের দিকে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলায় পাঁচ শ’ কিমি. রাস্তা ছিল। এর মধ্যে মাত্র ৯ কিমি. ছিল পাকা। তখন এতদাঞ্চলে কাঁচা-পাকা কোন রাস্তা ছিল না। হাঁটা-চলা ফেরার জন্য ছিল ক্ষেতের আইল, হালট ও মেঠোপথ। যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে যা বোঝায় তা ছিল শুধু নদীপথ। যা আদিম যুগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
এক সময় নদ-নদী বেষ্টিত এ ভাটি অঞ্চলের গ্রামে-গঞ্জে, হাটে-বাজারে, দূরে-কাছে যোগাযোগের একমাত্র বাহন ছিল নৌকা। গ্রামে এ বাড়ি- সে বাড়ি যাতায়াত করতে নৌকা ও কলা গাছের ভেলার প্রচলন ছিল। বিভিন্ন আকৃতি-প্রকৃতির নৌকা রং-বেরঙের পাল তুলে উজান-ভাটির নদ-নদী পাড়ি দিয়ে গন্তব্যে যাতায়াত করত। অত্যন্ত গভীর ও প্রচ- খরস্রোতা নদ-নদী পাড়ি দিয়ে যোগাযোগ রক্ষা করতে হতো। পাকা মাঝি-মাল্লারা আলী-আলী করে নদীর এ পাড় থেকে অপর পাড়ে পাড়ি জমাতো। এমন দুর্গম যোগাযোগের কারণে সময় ক্ষেপণের পাশাপাশি জীবনের ঝুঁকিও ছিল অনেক বেশি। নৌকা ডুবিতে জান-মালের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে এ অঞ্চলের মানুষকে। পরবর্তীতে এখানকার উৎপাদিত কৃষিপণ্যসহ বিভিন্ন মালামাল পরিবহনে নৌকার পাশাপাশি স্টিমার ও লঞ্চ চলাচল শুরু করে। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে ও আমদানি-রফতানি এবং যাতায়াত ক্ষেত্রে এখানকার নদ-নদী দিয়ে বাষ্পচালিত ইরানী, অস্টিস, কিউই, মিরানী, শিউলী, লালী নামের বড় বড় স্টিমার ও জাহাজ চলাচল শুরু হলেও এ অঞ্চলের মানুষের যাতায়াত ও যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল নৌকা।
যোগাযোগের জন্য সাধারণ মানুষ বছরের প্রায় আট মাসই নৌকার ওপর নির্ভরশীল ছিল। শুষ্ক মৌসুমে ক্ষেতের আইল, হালট ও মেঠোপথে মানুষ যাতায়াত করত হেঁটে। তখন এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে কিংবা এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে যাওয়ার কথা চিন্তা করতে গেলে মানুষের গায়ে রীতিমতো জ্বর উঠেছে। তখন মাদারীপুর অঞ্চলের মানুষকে ফরিদপুর যেতে হতো অফিসিয়াল কাজ ও কোর্ট-কাচারীতে মামলা মোকদ্দমার জন্য। ৬০/৭০ কিমি রাস্তা পায়ে হেঁটে যেতে হয়েছে ফরিদপুরে। সপ্তাহখানেক আগে থেকে যাওয়ার প্রস্তুতি চলতো। নির্ধারিত দিনের দু’দিন আগে বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে ফরিদপুরের উদ্দেশে রওনা দিতে হতো। পথে খাবার জন্য চিড়া-গুড়-রুটি ও পানীয় জল সঙ্গে নিতে হয়েছে। যারা হেঁটে যেত তাদেরকে দুর্গম পথে ৪৫/৫০টি খেয়া পার হতে হয়েছে। আর যারা নৌকায় যেত তারাও একদিন আগে বাড়ি থেকে যাত্রা করত।
নৌপথে একটু আরামে যেতে তাদেরকে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। উত্তাল পদ্মানদী, খরস্রোতা আড়িয়াল খাঁ, কুমার নদ, ময়নাকাটা ও ভুবনেশ্বরী নদী পাড়ি দিয়ে ফরিদপুরে পৌঁছাতে হয়েছে। স্টিমারের পাশাপাশি চল্লিশের দশকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিভিন্ন রুটে লঞ্চ সার্ভিস চালু হয়। তখন মাদারীপুরের সঙ্গে বরিশাল, ঢাকা, খুলনা, ফরিদপুর ও আশপাশের মহকুমা শহরের যোগাযোগ ছিল নৌপথে। সেকালে গ্রামীণ জীবনে যোগাযোগ ব্যবস্থা এতটাই দুর্গম ছিল যে, তখন আত্মীয়-স্বজনের খবরা-খবর বা কুশল বিনিময়ের কোন মাধ্যম ছিল না। হাতে চিরকুট বা চিঠি লিখে নৌকার মাঝির হাতে ধরিয়ে দেওয়া হতো গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। প্রাপকের কাছে তা পৌঁছাত সাতদিন বা ১৫দিন কিংবা একমাস পরে। ১৯২৫ সালের দিকে যৌথভাবে ডাক-টেলিগ্রাফ অফিস চালু হয়। ডাক যোগাযোগ ছিল স্টিমার ও নৌকানির্ভর।
১৯৬৫ সালের দিকে ভাঙ্গা-মাদারীপুর প্রায় ৫২ কিমি. পাকা রাস্তা নির্মিত হলে প্রথম সড়ক যোগাযোগ শুরু হয়। ১৯৬৯ সালে মাদারীপুর-টেকেরহাট, মাদারীপুর-ভুরঘাটা সড়ক যোগাযোগ শুরু হলে সীমিত আকারে বাস সার্ভিস চালু হয়। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত মাদারীপুরসহ দেশের ভাটি অঞ্চল ছিল অবহেলিত, অনুন্নত এবং দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা। স্বাধীনতা অর্জনের পর আশির দশক পর্যন্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল সেকেলে। শহর ও গ্রামীণ অবকাঠামোর মধ্যে কোন পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়নি। আশির দশক থেকে নব্বইয়ের দশকে যোগাযোগ ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসে। উপজেলার প্রবর্তন, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের কারণে অজপাড়া গাঁয়ে অবকাঠামো নির্মাণ, নতুন নতুন রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের ফলে গ্রামের সঙ্গে শহরের যোগসূত্র তৈরি হতে থাকে। তবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের দোলাচলে উন্নয়নের গতিতে আসে ছন্দপতন। সংস্কারের অভাবে ভেঙ্গে পড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা।
২০০৯ সালের প্রথম থেকেই পাল্টে যেতে থাকে দৃশ্যপট। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে শুধু যোগাযোগ নয়, দেশ সর্ব ক্ষেত্রে উন্নয়নের স্বর্ণযুগে প্রবেশ করে। সরকারের গৃহীত উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা মহাপরিকল্পনাগুলো পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন হওয়ায় এখন শহর ও গ্রামের মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য চোখে পড়ে না। আমূল পরিবর্তন এসেছে যোগাযোগ ক্ষেত্রে। এখন গ্রামের মানুষ ঘরে বসে ডিজিটাল সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। নগর ও মহানগরের ছোঁয়া লেগেছে মফস্বল শহর থেকে দূরে গ্রামীণ জনপদে। ৯/১০ বছরে এ অঞ্চলে যোগাযোগ ক্ষেত্রে যে অভূতপূর্ব উন্নয়ন এসেছে বিগত দিনে তেমনটি হয়নি। এক সময় নদ-নদী ও তার শাখা প্রশাখা, খাল-বিল ও হাওড়-বাঁওড় এ অঞ্চলকে জালের মতো বিস্তার করে রেখেছিল। বর্তমানে প্রায় তিন হাজার আটশ’ কাঁচা-পাকা সড়ক এ অঞ্চলকে জালের মতো বিস্তার করে রেখেছে।
পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হলে এ অঞ্চলের মানুষ শুধু নগর মহানগর নয়, সিঙ্গাপুর থাইল্যান্ডের স্পর্শও পাবে। বর্তমান সরকারের এসব যুগান্তকারী পদক্ষেপের ফলে শহরের সঙ্গে গ্রামের যোগাযোগ রক্ষায় এ অঞ্চলে সহস্রাধিক লোকাল বাস, শতাধিক দূরপাল্লার পরিবহন, পাঁচ শতাধিক ভাড়ায় চালিত প্রাইভেট মাইক্রো-কার, ইজিবাইক-মাহেন্দ্র, রিক্সা-ভ্যান, নসিমন-করিমন নিয়মিত চলাচল করছে। দুর্গম পেছনে ফেলে সুগম যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে গ্রামের মানুষ এখন উপরে উঠছে।
-সুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর থেকে
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: