ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা বৃত্তি

প্রকাশিত: ০৬:৪৮, ২৭ মে ২০১৭

প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা বৃত্তি

কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ার ছয়ছির গ্রামের রায়হান মিয়া ছয় ভাই-বোনের মধ্যে চতুর্থ। সময় মতো পোলিও টিকা না দেয়ায় দেড় বছর বয়সে শারীরিক প্রতিবন্ধিতার শিকার হন তিনি। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে স্থানীয় জাঙ্গালিয়া হাইস্কুল এ্যান্ড কলেজ থেকে ২০০৯ সালে মানবিক শাখায় এসএসসি পাস করেন। এরপর ভর্তি হন কলেজ শাখায়। এ সময় টিউশনি করে সংসার এবং পড়াশোনার খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তি কর্মসূচীর আওতায় ২০১০ সাল থেকে অর্থ সহায়তা পাচ্ছেন রায়হান। এখন পাকুন্দিয়া ডিগ্রী কলেজে বিএ (পাস) শেষ বর্ষে পড়ছেন। ‘প্রীতম চন্দ্র পাল, পঞ্চম শ্রেণী, সরকারী বিজ্ঞান কলেজ সংযুক্ত হাইস্কুল’Ñ সাদা মলাটের ওপর প্রীতম নিজেই লিখেছে শব্দগুলো। শব্দগুলো দেখে বোঝার উপায় নেই কলম ধরার জন্য পর্যাপ্ত আঙুল তার নেই! দুই পা এবং হাতের অপরিণত আঙুল নিয়ে জন্ম প্রীতমের। তার মেধা আর পড়াশোনার প্রতি আগ্রহের কাছে হার মানে এই অক্ষমতা। সমাজসেবা অধিদফতরে যোগাযোগ করে সরকারের উপবৃত্তির আওতাভুক্ত হয় প্রীতম। দরিদ্র বাবার ক্রোধের শিকার বৃষ্টি আক্তার দায়ের কোপে খুব অল্প বয়সেই ডান হাত হারিয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধিতার শিকার হয়। ছোটবেলা থেকেই বৃষ্টির স্বপ্ন পড়াশোনা করবে, বড় হয়ে মায়ের কষ্ট দূর করবে। মেয়েকে পড়ানোর সামর্থ্য ছিল না দরিদ্র মায়ের। সে সরকারের উপবৃত্তির সহায়তায় এখন স্থানীয় হোসেনপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর (ভোকেশনাল শাখা) ছাত্রী। বৃষ্টি, রায়হান ও প্রীতমের মতো এমন দরিদ্র, অসহায়, সুবিধাবঞ্চিত প্রতিবন্ধী শিশু-কিশোরদের শিক্ষার অধিকার এবং স্বপ্ন পূরণে কাজ করছে এই শিক্ষা উপবৃত্তি কর্মসূচী। আর এভাবে বদলে গেছে তাদের জীবন। দারিদ্র্য কিংবা শারীরিক প্রতিবন্ধিতাÑ কোনটাই তাদের শিক্ষার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। সরকারের শিক্ষা সহায়ক কর্মসূচীর মাধ্যমে এ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা পাচ্ছে শিক্ষার সুযোগ। অন্ধজনে আলো দেয়ার আহ্বান যুগে যুগে বলেছেন মনীষীরা। একইভাবে প্রকৃতি যাদের ওপর প্রতিবন্ধকতা চাপিয়ে দিয়েছে সেসব মানুষের কল্যাণে অবদান রাখার কথাও সমকালে উচ্চারিত হয়ে আসছে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে। বিশেষ বিশেষ দিবসে প্রতিবন্ধীদের প্রতি আমাদের সহমর্মিতাও জেগে ওঠে। আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসও পালিত হয় দেশে। নিশ্চয়ই এর ভেতরে অনেকেরই আন্তরিকতা রয়েছে। রয়েছে দীর্ঘশ্বাসমিশ্রিত কাতর আর্তি। বিশেষ করে যাদের পরিবারে রয়েছে অন্তত একজন প্রতিবন্ধীÑ শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধীÑ অর্থাৎ যারা ভুক্তভোগী তাদের কষ্টের কথা আমাদের হৃদয় মথিত করে যায়। এ কথা সত্য যে, বহু বিচিত্র প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই সমাজে প্রতিবন্ধীদের এগিয়ে যেতে হয়। দেশের প্রতিবন্ধীদের সঠিক কোন সংখ্যা জানা যায় না। সঠিকভাবে প্রতিবন্ধীদের গণনা নিশ্চিত করা দরকার। সাধারণ বিদ্যালয়গুলোতে প্রতিবন্ধী শিশুদের লেখাপড়া করার অসুবিধা দূর করার কোন বিকল্প নেই। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রশিক্ষণে প্রতিবন্ধী শিশুদের পাঠদান পদ্ধতি বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হলে সমাজ উপকৃত হবে। বিন্দুমাত্র সংশয়ের কারণ নেই যে, শিক্ষা ও কর্মসংস্থান ছাড়া প্রতিবন্ধীদের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে বেশকিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছেন, যা খুবই প্রশংসাযোগ্য। তার উদ্যোগে জাতীয় প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের অধীনে প্রতিবন্ধীদের জন্য কমিউনিটি ক্লিনিকভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। কর্মজীবী প্রতিবন্ধীদের জন্য বিভাগীয় পর্যায়ে ডরমেটরি নির্মাণেরও সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রতিবন্ধীদের মাসিক ভাতা যেমন বাড়ানো হয়েছে, তেমনি সুবিধাপ্রাপ্তির আওতায় যোগ হয়েছে আরও দুই লাখ ব্যক্তি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার পথ সুগম করেছিলেন। বর্তমানে দেশের অনেক বেসরকারী সংস্থা প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে কাজ করছে। এছাড়া সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সরকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। জাতীয় বাজেটে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে তথা অসচ্ছল প্রতিবন্ধীদের ভাতার পরিমাণ প্রতিবছরই বাড়ানো হচ্ছে। এটা সুলক্ষণ। তবে সরকারকে প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নের সামগ্রিক বিষয়টি তদারকি করতে হবে। শুধু পরিবারের নিকটজনই নয়, তাদের কাছাকাছি থাকা প্রতিটি মানুষের আচরণই এমন হওয়া উচিতÑ যাতে প্রতিবন্ধীরা নিজেদের উপেক্ষিত ও করুণার পাত্র না ভাবেন। এই বিষয়টিও সবাইকে ভাবতে হবে।
×