ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ক্ষমতায়ন সত্ত্বেও নারী নির্যাতন বৃদ্ধি সম্পর্কিত গবেষণায় তথ্য

‘প্রচলিত অনুশাসনই পুরুষকে নারীর প্রতি সহিংস করে’

প্রকাশিত: ০৬:২৫, ২৭ মে ২০১৭

‘প্রচলিত অনুশাসনই পুরুষকে নারীর প্রতি সহিংস করে’

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ পুরুষরা দৃঢ়ভাবে মনে করছে যে, দেশের উন্নয়ন-নীতি ও আইন-কানুন তাদের উপেক্ষা করে নারীদের ক্ষমতায়নের প্রসার ঘটছে। নারীর ক্ষমতায়নকে নিজেদের ক্ষমতাহীনতা বলে মনে করছে বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের পুরুষ। আর সেই হীনম্মন্যতা থেকে তারা নারীর উপর সহিংস আচরণ করছে। এতে নারীদের উচ্চশিক্ষা, গতিশীলতা, কর্মসংস্থানের সুযোগ বহুগুণে বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও নারী নির্যাতনের হার ক্রমশ বেড়ে চলছে। সম্প্রতি, আইসিডিডিআরবি এবং সহযোগী কয়েকটির সংস্থা পরিচালিত একটি গুণগত গবেষণায় এই তথ্য পাওয়া গেছে। গত বছরের এপ্রিল থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত গবেষণাটি পরিচালিত হয়। ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের পাঁচ গ্রাম থেকে ৪০ প্রধান তথ্যপ্রদানকারীর সাক্ষাতকার, এগারোটি দলীয় আলোচনা এবং ২৩ নিবিড় সাক্ষাতকারের মাধ্যমে নারীর প্রতি পুরুষের মনোভাব সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এছাড়াও ৪ পরিবারের তিন প্রজন্মের নারী এবং তিনটি পরিবারের তিন প্রজন্মের পুরুষের সাক্ষাতকারও নেয়া হয়। গবেষণায় দেখা যায়, পুরুষরা দৃঢ়ভাবে মনে করছে যে, দেশের উন্নয়ননীতি ও আইন-কানুন তাদের উপেক্ষা করে নারীর ক্ষমতায়নের গতি প্রসার করছে। এছাড়া শৈশবে নারী নির্যাতনের প্রত্যক্ষ করা এবং পারিবারিক ও সামাজিক সহিংসতার মধ্যে বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা একজন পুরুষকে নির্যাতনকারী হিসেবে তৈরিতে ভূমিকা রাখে। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, যদি একজন স্ত্রী তার ভূমিকা ঠিকমতো পালন না করে এবং ধর্মীয় অনুশাসন লঙ্ঘন করে তাহলে স্বামীর দায়িত্ব হলো স্ত্রীকে শাসন করা। উত্তরদাতাদের মতে, স্বামীর সঙ্গে অবাধ্যতা থেকে শুরু করে যৌন সম্পর্ক প্রত্যাখ্যান করাসহ যে কোন ভুল-ত্রুটির জন্য স্বামী তার স্ত্রীকে শাসন করতে পারে। এছাড়াও স্ত্রী নির্যাতনকে পুরুষত্ব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবেও দেখা হয়। স্ত্রীকে নিয়ন্ত্রণ করবে, পরিবারের খরচ বহন করবে এবং সহিংস হবে- এটাই পুরুষদের প্রত্যাশিত এবং পুরুষরা যখন হতাশায় থাকে তখন তারা সহিংস হবে, এটাই অনুমোদিত। এই গবেষণাটিতে স্ত্রী নির্যাতন সংগঠনের ক্ষেত্রে ব্যক্তি, পরিবার এবং সামাজিক পর্যায়ে বিরাজমান জটিল এবং বহুমুখী কারণগুলো তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যায়, শৈশবে নারী নির্যাতনের প্রত্যক্ষ করা এবং পারিবারিক ও সামাজিক সহিংসতার মধ্যে বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা একজন পুরুষকে নির্যাতনকারী হিসেবে গড়ে উঠতে ভূমিকা রাখে। সামাজিক পর্যায়ে, স্ত্রী নির্যাতন প্রজন্মান্তরে লালিত ধ্যান-ধারণা দ্বারা পরিচালিত হয়। গবেষণা বলছে, ‘ব্যক্তিগত বিষয়’ হিসেবে দেখার কারণে এই ধরনের নির্যাতন সম্পর্কে নারীরা কম অভিযোগ করেন। অন্যদিকে, সামাজিক ধ্যান-ধারণা যেহেতু স্ত্রী নির্যাতনকে সমর্থন করে সেহেতু নির্যাতনকারীদের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম। সেই সঙ্গে, পুলিশের কাছে যাওয়ার অধিকার এবং প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা লাভের পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে বেশিরভাগ নারী জানেন না। তাদের প্রাতিষ্ঠানিক ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার পরিবার, সীমাহীন দুর্নীতি ও আমলাতন্ত্র এবং আর্থিক প্রতিবন্ধকতা দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। গবেষণাটি ওভারসিজ ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট (ওডিআই), ইউকের অর্থায়ন এবং সমন্বয়ে পরিচালিত হয়েছিল। এই গবেষণায় সহযোগী অংশীদার হিসেবে ভূমিকা রেখেছে আমেরিকার এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়। বুধবার ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং সোশ্যাল নর্মস এ্যান্ড মাল্টি-লেভেল ড্রাইভারস অব ভায়োলেন্স এ্যাগেন্সট উইমেন এ্যান্ড গার্লস ইন রুরাল বাংলাদেশ : ইমপি কেশন্স ফর প্রিভেনশন এ্যান্ড রেসপন্স’ শীর্ষক সেমিনারে এ গবেষণার ফল তুলে ধরা হয়। ব্র্যাকের ফারহানা হাফিজ গবেষণাটি প্রসঙ্গে বলেন, নারী ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি পেলেও নারীর প্রতি সহিংসতা কমছে না। বরং বাড়ছে। এ গবেষণার মাধ্যমে এ বিষয়টি স্পষ্ট যে, নারীর প্রতি পুরুষের মনোভাব এখনও বিরূপ। নারী পুরুষের সমতা আনতে সরকার বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তবুও পুরুষরা নারীদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছে। নারীর প্রতি সহিংসতা মোকাবেলায় গৃহীত বিভিন্ন নীতি ও আইনসমূহের সম্ভাব্য প্রভাবগুলো সতর্কতার সঙ্গে মূল্যায়ন করা উচিত। পরিণামে নারীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এমন কোন প্রতিক্রিয়া প্রতিরোধ করতে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া উচিত। মানবাধিকার কর্মী এবং উই ক্যান এ্যালায়েন্স টু এন্ড ভায়োলেন্স এ্যাগেন্সট উইমেনের চেয়ারপার্সন সুলতানা কামাল বলেন, অনেক সামাজিক নিয়ম পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু নারী নির্যাতন সমর্থন করে এমন অনেক নিয়ম পরিবর্তিত হয়নি। আমাদের এই চ্যালেঞ্জটি নিয়ে কাজ করতে হবে।
×