ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ছোটখাটো রোগের অজুহাতে রোজা না রাখা মোটেও উচিত নয়

প্রকাশিত: ০৬:০১, ২৭ মে ২০১৭

ছোটখাটো রোগের অজুহাতে রোজা না রাখা মোটেও  উচিত নয়

ডা. এবিএম আবদুল্লাহ ॥ ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের মধ্যে রোজা অন্যতম। রমজানের রোজা আল্লাহতায়ালার এক বিশেষ নিয়ামত। এর মধ্যেই আল্লাহতায়ালা রেখেছেন অফুরন্ত রহমত, বরকত, মাগফিরাত, নাজাত ও ফযিলত। রমজানের রোজা রোজাদারের জন্য ঢালস্বরূপ। রোজা আল্লাহতায়ালার জন্য এবং আল্লাহ নিজেই এর প্রতিদান দেবেন। তাই প্রতিটি ধর্মপ্রাণ মুসলমান শত বাধা-বিপত্তির মাঝেও রোজা রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এর মাধ্যমেই তারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে চান। অনেকে জটিল রোগে ভোগেন, কিন্তু নিজের আত্মার শান্তি এবং ধর্মীয় নির্দেশনার প্রয়োজনে রমজানের রোজা রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। রোগীরা কি রোজা রাখতে পারবেন? রোজা রাখলে অনেকে স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয় করেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রোজায় কারও স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে গেছে বা রোজা রেখে ক্ষুধা, তৃষ্ণায় কাতর হয়ে কারও মৃত্যু হয়েছে, এমন কোন ঘটনার কথা শোনা যায়নি। রোজা কষ্টকর ইবাদত এবং রোজার দ্বারা শরীরে চাপ পড়ে বলে অনেকেই রোজা ছেড়ে দেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, শরীয়তের বিধান অনুযায়ী, সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া রোজা পরিত্যাগ করা সম্পূর্ণ অনুচিত। সুস্থ ব্যক্তি তো বটেই, অনেক অসুস্থ ব্যক্তিরও রোজা ছেড়ে দেয়া উচিত হবে না। রমজান মাসে রোজা রাখা সম্পর্কে আল্লাহর নির্দেশ, ‘যে ব্যক্তি রোজার মাসটি পাবে, তারই কর্তব্য হচ্ছে রোজা রাখা’ (সূরা বাক্বারা : ১৮৫)। আবার এমনও লোক দেখা যায়, যারা অজুহাত খোঁজেন রোজা না রাখার, নিজের মতো করে খোঁজেন ধর্মীয় নির্দেশনা। এ ব্যাপারে বিজ্ঞ আলেম ওলামা বা ইসলামী চিন্তাবিদরা সম্পূর্ণ একমত যে, অনেক নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগে আক্রান্ত যে কেউ রোজা রাখতে পারবেন। এমনকি অনেক রোগের ক্ষেত্রে রোজা রোগ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে তীব্র অসুস্থতায় অথবা কোন জটিল রোগে রোজা রাখা না রাখার ব্যাপারেও ধর্মীয় নির্দেশনা আছে। প্রয়োজনে পরে কাযা করার বিধানও সুস্পষ্টভাবে দেয়া আছে। কোন অজুহাতে বা সামান্য কোন অসুস্থতায় রোজা না রাখার কোন যৌক্তিকতা নেই। আবার অনেক রোগীই যে কোন অবস্থায় রোজা রাখতে বদ্ধপরিকর, যা হয় হবে, তবুও রোজা ছাড়তে নারাজ। আসলে অনেক দীর্ঘস্থায়ী রোগেও রোজা রাখা সম্ভব। রোজার মাসে পেপটিক আলসার রোগীরা খালি পেটে থাকবেন, ডায়াবেটিস রোগীরা কীভাবে রোজা রেখে ইনসুলিন নেবেন, উচ্চ রক্তচাপের রোগীরা কীভাবে দুই বেলা বা তিন বেলা ওষুধ সেবন করবেন, এসব চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েন। আবার কিছু কিছু অসুস্থ ব্যক্তি এমনকি সুস্থ ব্যক্তিরাও দুর্বলতা এবং নানা রকম দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনার কারণে রোজা রাখতে গড়িমসি করেন। আসলে রোজা রাখলে শরীরে তেমন কোন বিরূপ প্রভাব পড়ে না। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সুচিন্তিত অভিমত হলো, রোজা স্বাস্থ্যের কোন ক্ষতি তো করেই না, বরং শরীর ও মনের উন্নতি লাভেও সহায়ক। পেপটিক আলসার, ডায়াবেটিস, হৃদরোগী, বাত ব্যথার রোগীরাও সরাসরি রোজায় উপকার পান। পেপটিক আলসারের কারণে অনেকেই রোজা ছেড়ে দেন। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, পেপটিক আলসারে রোজা বিশেষ উপকারী। পেপটিক আলসার যারা গ্যাস্ট্রিক আলসার বা পেপটিক আলসারে ভোগেন, তারা অনেকেই মনে করেন খালি পেটে থাকলে এসিডিটির সমস্যা বাড়বে। এ ধরনের রোগীরা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগেন যে রোজা রাখবেন কি-না। আসলে রোজা রাখলে সাধারণত এসিডিটি বাড়ে না। রোজায় মানুষের জীবন একটা নিয়মে চলে আসে বিধায় এ সময় এসিডিটির সমস্যা অনেকাংশে কমে যায়। প্রয়োজনে ইফতার এবং সেহেরির সময় রেনিটিডিন বা ওমিপ্রাজল গ্রুপের ওষুধ একটা করে খেয়ে নিতে পারেন। রাতে দুই-তিনবার এ্যান্টাসিড খেলেও কোন অসুবিধা হবে না। ডায়াবেটিস এ রোগে আক্রান্ত হলে রোগী রোজা রাখতে পারবেন না এ কথা মোটেই ঠিক নয়। নিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের রোগীদের ক্ষেত্রে খুব সহজেই রোজা রাখা সম্ভব। তবে রোজায় ইনসুলিন কিংবা খাওয়ার ওষুধ গ্রহণের সময়টা একটু পরিবর্তন করে সেহেরি ও ইফতারের সঙ্গে সমন্বয় করে নিতে হবে। এ ব্যাপারে একজন হরমোন বিশেষজ্ঞ কিংবা মেডিসিন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে। ডায়াবেটিস রোগীদের অবশ্যই কিছু ঝুঁকি থাকে, তারা রোজা শুরুর আগেই চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে নেবেন। হাঁপানি বা শ্বাসকষ্টের রোগী রোজা রাখতে এ ধরনের রোগীদেরও কোন বাধা নেই। রোজা কোনভাবেই হাঁপানি রোগ বাড়িয়ে দেয় না। বরং বিশেষজ্ঞদের মতামত হচ্ছে, রোজা হাঁপানি রোগীকে কিছুটা স্বস্তি এনে দেয়। যদি হাঁপানি বাড়তেই থাকে, তাহলে রোগী ইফতার এবং সেহেরির সময় দীর্ঘস্থায়ী বড়ি খেয়ে নিতে পারেন। এতে হাঁপানি নিয়ন্ত্রণে থাকবে। অনেক বিশেষজ্ঞদের মতে, দিনের বেলায় শ্বাসকষ্ট হলে ইনহেলার নেয়া যাবে। তাতে রোজার কোন ক্ষতি হবে না। কিডনি রোগ কিডনি রোগে আক্রান্ত রোগীর রোজা রাখা যাবে না এমন কোন কথা নেই। যারা ক্রনিক কিডনি ফেইল্যুরে আক্রান্ত, তাদের সুনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করতে হয়, নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়, পানি খাওয়ার ক্ষেত্রেও সতর্কতা ও পরিমাণ অনুযায়ী খেতে হয়। তাই রোজা রাখার ক্ষেত্রে তাদের বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরী। যাদের কিডনি ফেইল্যুরের মাত্রা অনেক বেশি, তাদের পক্ষে রোজা রাখা সম্ভব নয়। তেমনি যারা ডায়ালাইসিসের রোগী অথবা ইতোমধ্যে কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন তাদের পক্ষেও রোজা রাখা প্রায় অসম্ভব। অল্প থেকে মধ্যম মাত্রার কিডনি ফেইল্যুর রোগীরা রোজা রাখলে কোন ক্ষতি হয় না। তবে একজন কিডনি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে রোজা রাখার সিদ্ধান্ত নেয়াই শ্রেয়। উচ্চ রক্তচাপ যারা উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন, তাদের জন্য রোজা আরও উপকারী। অনেক ওষুধ দিনে একবার বা দুইবার খেলেই চলে। ডাক্তারদের পরামর্শ অনুযায়ী ইফতার বা সেহেরির সময় বা প্রয়োজনে দুইবার ওষুধ খেলেই রক্তচাপ পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকে। রোজা রাখার মাধ্যমে রোগীদের কোলেস্টেরলের মাত্রা প্রায় ১০-২০ শতাংশ কমে যায়। একই সঙ্গে তাদের উচ্চ রক্তচাপের প্রবণতাও কমে যায়। হার্টের রোগ হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীর রোজা রাখতে কোন নিষেধ নেই। তবে একিউট মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন, হার্ট ফেইল্যুর ইত্যাদি রোগ থাকলে রোজা না রাখাই শ্রেয়। অনেক ক্ষেত্রে হৃদরোগীদের জন্য রোজা রাখা খুবই উপকারী। ভাজাপোড়া এড়িয়ে চলা, চর্বিজাতীয় খাবার পরিহার করা এবং ইফতারের দুই ঘণ্টা পর একটু ব্যায়াম করা উচিত। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী, সম্ভব হলে ওষুধ রাতের বিভিন্ন সময়ে ভাগ করে খেলেই চলবে। দিনে যদি এনজাইনার ব্যথা হয়, তবে জিহ্বার নিচে স্প্রে জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা যাবে, তাতে রোজার ক্ষতি হবে না। লিভারের অসুখ লিভারের রোগীদের রোজা রাখা নির্ভর করে রোগটির ধরনের ওপর। কেউ যদি ভাইরাল হেপাটাইটিস নামক রোগে আক্রান্ত হন, তারা খেতে পারেন না, ঘন ঘন বমি হয়, রুচি নষ্ট হয়, জ-িস দেখা দেয়। অনেক সময় তাদের শিরায় স্যালাইন বা গ্লুকোজ দিতে হয়। তাদের পক্ষে রোজা না রাখাই ভাল। আবার যারা লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত, তাদের যদি রোগের লক্ষণ কম থাকে, তবে রোজা রাখতে পারেন। খারাপ লাগলে রোজা ভেঙ্গে ফেলবেন। কোন কোন সময় সিরোসিস রোগীদের পেটে বা পায়ে পানি জমতে পারে, শরীরে গ্লুকোজের পরিমাণ কমে যেতে পারে। তাদের বেলায় রোজা রাখা ঝুঁকিপূর্ণ। চোখ, কান বা নাকের রোগী রোজায় চোখের বা নাকের রোগীরা ড্রপ জাতীয় ওষুধ ব্যবহার নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগেন। অনেক আলেম ওলামার এবং বিশেষজ্ঞদের অভিমত, চোখ বা নাকে ড্রপ ব্যবহার করলে রোজার কোন ক্ষতি হবে না। গর্ভাবস্থায় রোজা গর্ভবতী মায়ের যদি শারীরিক কোন জটিলতা না থাকে, তাহলে রোজা থাকতে কোন বাধা নেই। তবে ডাক্তারের সঙ্গে অবশ্যই পরামর্শ করা উচিত। রোজা রাখলে যদি মা-বা বাচ্চার ক্ষতি হয়, বা যদি ডাক্তারের কোন নিষেধাজ্ঞা থাকে, তবে রোজা না রাখাই ভাল। বুকের দুধ খাওয়ানো বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ালে রোজার কোন ক্ষতি হবে না। রোজা রাখলে বুকের দুধ কমে যায় না। অবশ্যই সেহেরি ও ইফতারের সময় প্রচুর তরল খাবার খেতে হবে। ইফতারের পর শোয়া পর্যন্ত প্রচুর পানি ও তরল খাবার খেতে হবে। মানুষের রোগের শেষ নাই, ধরনও এক নয়। সব রোগ নিয়ে আলোচনাও সম্ভব নয়। তাই যে কোন রোগী, যারা রোজা রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অথচ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগেন, তাদের উচিত ইসলামী জ্ঞানসম্পন্ন ডাক্তার, বা আলেম ওলামার সঙ্গে পরামর্শ করে রোজার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া। মনে রাখতে হবে, রোজা একটি অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। ধর্মীয় দিক থেকে যেমন এর ফযিলত অসীম তেমনি স্বাস্থ্যগত দিক চিন্তা করলেও এর উপকার অনেক। একমাসের সিয়াম সাধনা আমাদের দেহ ও মন উভয়কেই পরিশুদ্ধ করে। তাই আলস্য করে, ছোট-খাটো রোগের অজুহাত খাঁড়া করে একে পালন না করা মোটেই উচিত নয়।
×