ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শেখ মিরাজুল ইসলাম

ধা রা বা হি ক ॥ উপন্যাস ॥ মোঘল গীবত

প্রকাশিত: ০৬:৪০, ২৬ মে ২০১৭

ধা  রা  বা  হি  ক ॥ উপন্যাস ॥ মোঘল গীবত

(পূর্ব প্রকাশের পর) রাজমহলের শেষ দিনগুলো শেষ বিকেলে শাহ সুজার বড় কন্যা গুলরুখ বেগম সখীদের নিয়ে বসে আছেন আনন্দ সরোবর হ্রদের পাশে। ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড আনমনা হয়ে আছেন। খবর সুবিধার নয়। শাহ সুজাকে ঠেকাতে দিল্লী হতে রওনা দিয়েছেন দারার পুত্র সুলাইমান। সুলাইমানের বেগম অমৃতা বাইয়ের ছোট বোন অনুপ কনওয়ার তাকে খবরটা দিয়েছেন। অনুপ সম্পর্কে তার সতীন। বাংলার রাজধানী রাজমহলের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা এই আনন্দ সরোবর। অনেককটা আগ্রার লাল কেল্লার আদলে সাজানো হয়েছে এই রাজধানীর দুর্গ প্রাসাদ। দৌলতখানা, মচ্ছি ভবন, পৃথক হাম্মাম, ফোয়ারা, জিলুখানা, দিওয়ান-ই-খাস, দিওয়ান-ই-আম, এক মাইল ব্যবধানে দুর্গের দুই পাশে দুই সিংহ দরজা সবই আছে এখানে। সুজার মূল প্রাসাদ বানানো হয়েছে পাথর, তামা আর কাঠের স্তম্ভ দিয়ে। গঙ্গার উপরে টানা উঠান দেয়া প্রাসাদ যাকে ‘তখত’ বলে সবাই। মূল শহরের অদূরে আছে হাদাফ-এ জামে মসজিদ। মানসিংহ বানিয়েছিলেন। আরও আছে পীর বোহারের আদি মন্দির। সব মিলিয়ে দেখার মতো ছিমছাম মুঘল নগরী এই রাজমহল। এখানে গঙ্গা অনেক চওড়া। শাহজাদা সুজা বাংলার সুবেদার হওয়ার পর ১৬৩৯ সালে বুড়িগঙ্গা পাড়ের ঢাকা হতে রাজধানী সরিয়ে এনেছেন গঙ্গা পাড়ের রাজমহলে। সেই ১৫৯৫ সালে আকবরের সেনাপতি মানসিংহ শুরুতেই রাজমহলকে বাংলার রাজধানই বানিয়েছিলেন। ১৬১০ সালে সুবাদার ইসলাম খান ঢাকায় রাজধানী নিয়ে যাওয়ার পর সুজা বেছে নিয়েছেন এই শহরটিকে আরেকবার রাজধানী হিসেবে। তবে লোকে বলাবলি করে ঢাকা নাকি অনেক সুন্দর। রাজমহলের মতো রুক্ষ্ম নয়। আর গঙ্গার মতিগতি ঠিক নেই। এই ভাঙে তো এই গড়ে। শাহজাদী গুলরুখ বানু বেগম জানেন তার আব্বাজান শাহ সুজার দিল্লী সালতানাৎ জয়ের ওপর নির্ভর করছে পুরো রাজমহলবাসীর ভবিষ্যত। সবচেয়ে আদরের কন্যা হিসেবে সুজা বেশ হিসেব কষে বিয়ে দিয়েছেন মেয়েকে আওরঙ্গজেবের দ্বিতীয় বেগম নওয়াব বাইয়ের প্রথম সন্তান সুলতান মুহাম্মদ মীর্জার সঙ্গে। গুলরুখ ইচ্ছে করলে আপত্তি করতে পারতেন। করেননি পিতা অন্তঃপ্রাণ গুলরুখ বানু। যদিও সুলতান মীর্জার দ্বিতীয় স্ত্রী হতে চাননি তিনি মনে মনে। ভারতবর্ষের যে কোন অভিজাত পুরুষ পতঙ্গের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে রাজি ছিলেন গুলরুখের রূপ-গুণে। আয়তাকার চোখের সঙ্গে ছড়ানো ভরাট ঠোঁটের মিতালী যেন গঙ্গা-যমুনা একসঙ্গে ধরা দিয়েছে কান্তিময় মিষ্টি চেহারায়। দিল্লী যাত্রার আগে গুলরুখ বানুর সঙ্গে আলাদা করে সাক্ষাত করে গেছেন সুজা। এর আগে সুলতান মুহাম্মদ মীর্জার হাতে তুলে দিয়েছেন এই যুদ্ধ অভিযানে সেনাপতির পতাকা। সম্রাট শাহজাহান মারা যান বা বেঁচে থাকুন এখন ফেরার উপায় নেই। নিজেকে ইতোমধ্যে সম্রাট ঘোষণা দিয়ে মুদ্রা প্রচলন করেছেন নিজের নামে। শ্বেতাঙ্গ ওলন্দাজদের কুটিবাড়ী নির্মাণের অনুমতি দিয়ে রেখেছেন যেন বুড়িগঙ্গার দিক হতে জলদস্যুদের আক্রমণ ঠেকাতে তারা কাজে দিতে পারে। -বাবাজান, এই মিছেমিছি যুদ্ধ কি না করলেই নয়? আবেগভরা কণ্ঠে গুলরুখ জিজ্ঞাসা করলেন। -না বেটি। লোকে যত কিছুই বলুক আমি জানি একদিন আমার ভাইয়েরা আমাকে নিশ্চিহ্ন করতে এই রাজমহলে ছুটে আসবে। মেয়েকে সান্ত¡না দিতে চান সুজা। এমন আদরভরা চেহারা দেখলে মনে হয় জোরে বকা দেয়া মাত্র কেঁদে দেবেন। -আপনি কাকে বেশি ভালবাসেন বাবা? -এটা আবার কেমন প্রশ্ন? তোমার কি কোন সন্দেহ আছে? তোমার সকল আম্মাদের চেয়েও আমি তোমাকে বেশি মহব্বত করি। তুমি ছেলে হলে সিংহাসন তোমাকেই দিয়ে যেতাম। -তা হলে বলুন চাচাজানদের কাউকে আপনি নিজ হাতে হত্যা করবেন না ... আপনার দাদিজানের কসম বলুন? গুলরুখ জানেন শাহ সুজার জীবনে নূর জাহানের ভূমিকা অনেক বেশি। ছোট বেলায় তার কাছেই তিনি মানুষ হয়েছিলেন। দরবারী কায়দা, প্রশাসনিক অলিগলির হিসাব আর তেজস্বী মুঘল স্বভাবের হাতেখড়ি নূরজাহানের কাছেই পাওয়া। নিজের পিতার চেয়েও শ্রদ্ধা ভক্তি বেশি তার নূরজাহানের প্রতি। একটু চমকে উঠলেন সুজা। বেশি অবুঝ হয়েছে তার মেয়েটি। একটু সময় নিলেন শাহজাদা। -দেখো বেটিয়া, তোমাকে একটা ঘটনা বলি। মন দিয়ে শোনো। গুলরুখ চোখ মুছে সজাগ হলেন। -তোমার শ্বশুর আব্বা আওরঙ্গজেব তখন ছোট। সম্ভবত চৌদ্দ বছর হবে বয়স তার। দিল্লীতে যমুনার পাড়ে আমরা ভাইরা মিলে হাতির লড়াই দেখছিলাম। আব্বা হুজুরের খুব প্রিয় খেলা ছিল সেটা। হঠাৎ একটা হাতি উন্মাদের মতো আওরঙ্গজেব যে ঘোড়ায় বসে খেলা দেখছিল সেই দিকে দৌড়ে যেতে থাকল। আমরা চিৎকার করে আওরঙ্গজেবকে পালিয়ে যেতে বললাম কিন্তু তার ঘোড়া দিক ভুলে সেই হাতির দিকেই মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। এমন পরিস্থিতিতে সবাই ভয়ে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল কিন্তু বিশাল দৈত্যকার পাগলা হাতিটির মুখোমুখি হতে কেউ সাহস করছিল না। তখন আমি নিজের জীবন তুচ্ছ করে বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে হাতিটির দিক বদল করে দিতে সক্ষম হই। পরে রাজা জয় সিং আমাকে সাহায্য করলে দুজন মিলে প্রাণীটিকে কব্জা করি। যদি আমি এগিয়ে না যেতাম শাহজাদা সেদিনই মারা যেতে পারতেন। একই আম্মাজানের সন্তান আমরা। সামান্য দম নিলেন সুজা। তারপর আবার বলতে থাকলেন, -আব্বাজান আমাকে অনেক বিশ্বাস করতেন। বুরহানপুরে তপতী নদীর পাড়ে যখন প্রথম আম্মাজানকে কবর দেয়া হয় তখন তার মৃত্যুর ছয় মাস পর আবার কবর হতে লাশ তুলে আগ্রায় রওজা-এ-মুনাভভারা’য় নতুন করে দাফন করার সকল দায়িত্ব আব্বাজান আমাকেই দিয়েছিলেন। আমি আরও জানি হিন্দুস্তানের দায়িত্বও তিনি আমাকে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দারা তা প্রকাশ করতে দেননি। বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেছেন আমাদের প্রিয় আব্বাজানকে। -কিন্তু বাবাজান লোকজন বলাবলি করছে মহামান্য সম্রাট দাদাজান বেঁচে আছেন এখনও। গুলরুখ বেগম সতর্ক কণ্ঠে বললেন। -যদি তাই হয় আমি সরাসরি আব্বাজানকে তা জিজ্ঞাসা করব। কিন্তু দীর্ঘ সতেরো বছর বাংলার সুবেদারী করে মুঘল রাজকোষ ভর্তি করে কি প্রতিদান আমি পেতে পারি তা নিজ কানে শুনতে চাই। বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তুললেন সুজা। ধ্যান ভেঙ্গে বাস্তবে ফিরে এলেন গুলরুখ বানু। শরীরের বিভিন্ন অংশে এলাচ, দারুচিনি, লবঙ্গ, সুগন্ধী কাঠের চূর্ণ মিশিয়ে আনন্দ সরোবরের পাশে বসেছিলেন গুলরুখ। এখন হাম্মামখানায় গিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। সারা শরীরে সুগন্ধী মেখে চন্দনা পালংকে কার জন্য শুয়ে থাকবেন শাহজাদী? প্রিয় স্বামী গেছেন যুদ্ধে। বাপ-দাদারা যেমন হোন না কেন, পরপুরুষের কথা তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না। প্রাসাদের পুবদিকে বড় উঠোনে এক আশ্চর্য কুয়া আছে। সারা বছর পানি থাকে সেই গভীর কুয়াতে। গুলরুখ মনে মনে ঠিক করে রেখেছেন স্বামী সুলতান বা বাবাজানের কিছু হলে তিনি সেই কুয়াতে লাফ দিয়ে আত্মাহুতি দেবেন, তবু অন্য কোন পুরুষের ছায়া মাড়াবেন না। ঠিক সেই সময় রাজমহল হতে কয়েক শ’ মাইল দূরে বেনারসে দো-আশিয়ানা মঞ্জিল টাঙিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন সুজা। খবর পেয়েছেন খুব কাছে চলে এসেছে দারার পুত্র সুলাইমান মুঘল সেনাদল নিয়ে। ভেবেছিলেন দারা নিজেই আসবেন। -দারা নিজে না এসে পাঠিয়েছেন এক দুধের বাচ্চা সুলাইমানকে? সভাসদদের সামনে শ্রাগ করলেন সুজা। সবাই একযোগে হেসে উঠলেন। গঙ্গা পাড়ের বেনারস হতে প্রায় সাড়ে পাঁচ শ’ মাইল দূরে সুজার খামখেয়ালিপনা আচরণ ঠিকই টের পেয়েছিলেন বৃদ্ধ অসুস্থ সম্রাট শাহজাহান। আর কেউ না জানুক তিনি জানেন দারার পর সবচেয়ে ভালবাসেন শাহ সুজাকে। চার ছেলের মধ্যে তিনি সবচেয়ে শক্তিশালী, কিন্তু মোটা বুদ্ধির মানুষ। যা ভাল মনে করেন তাই করেন। কিন্তু মুরাদের মতো উচ্ছৃঙ্খল নন। অভিযান শুরুর আগে সম্রাট গোপনে রাজা জয় সিংকে তাই নির্দেশ দিয়েছিলেন, কোন ভাবেই যেন যুদ্ধক্ষেত্রে শাহজাদাকে হত্যা করা না হয়। (চলবে)
×