ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আজাদ এহতেশাম

সঙ্কট উত্তরণের পঙ্ক্তিমালা

প্রকাশিত: ০৬:৪০, ২৬ মে ২০১৭

সঙ্কট উত্তরণের পঙ্ক্তিমালা

উত্তরাধুনিককালে নব্বইয়ের দশকে যে কয়জন কবির কাব্য ভাবনার ঋদ্ধিও সমৃদ্ধি পাঠককুলকে বিস্ময়াভিভূত করে কবি আমিনুল ইসলাম তাঁদের অগ্রগণ্য। বহুবর্ণিল বিষয় বৈচিত্র্যের অতলান্তিকতা, গভীর জীবন বোধ ও বোধির অন্বিষ্টতায় সম্পূর্ণ আত্মীকৃত ভাব ভাষা ও ছন্দের সংবিত্তিতে তাঁর কবিতা শৈল্পিকমানে উত্তীর্ণ এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তাঁর কাব্যভূমে বিষয়ীভূত শব্দের কাব্যিক ব্যবহার প্রাণবন্ত ও মেধাদীপ্ত পঙ্ক্তির সন্দীপন সহৃদয় হৃদয় সংবেদী পাঠকচিত্তে এক নতুন মাত্রিকতার সুর লহরি তুলবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। নব্বইয়ের দশকের কাব্য ভাবনায় আধুনিক কবির অন্তরজাত উপলব্ধিতে প্রেম নারী ও সৌন্দর্য চেতনা অন্যতম কবিতার অনুষঙ্গ হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। আমিনুল ইসলামের কাব্যভূমে একটি বড় অংশজুড়ে পরিব্যাপ্ত প্রেম সৌন্দর্য ও নারীÑ সে বিবেচনায় তাঁকে রোমান্টিক প্রেমের কবি বলা অসংগত হয় না। সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর অনন্য একটি কাব্যগ্রন্থ ‘প্রণয়ী নদীর কাছে (২০১৬)’ গ্রন্থ শিরোনামেই প্রেম সৌন্দর্য ও নারীর সন্নিবদ্ধ হৃদয়াবেগের উৎসারণের ইঙ্গিতবহ- তা নিমিষেই পাঠকচিত্তে ঝঙ্কৃত হয়ে ওঠে। আদ্যপ্রান্ত অধীত গ্রন্থটিতে জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে গ্রন্থকারের প্রতীতি ও অনুধ্যান গভীর জীবনবোধের উৎসারণে বীক্ষিত হয়েছে। মানবীয় প্রেম, ইতিহাস-ঐতিহ্য, দেশপ্রেম, ন্যায্যতা আদায়ের সংগ্রাম, প্রতারণা ও শঠতা, মৃত্যুচেতনা, গ্রামীণ প্রকৃতির মুগ্ধতা, নিগৃহীত ও অপাঙ্ক্তেয় নিম্নবিত্তের মানুষের প্রতি সহমর্মিতা ইত্যাদি অনুষঙ্গ তাঁর হৃদয়সংবেদী তুলির আঁচড়ে উদ্ভিন্ন হয়েছে পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে। সাহিত্যে শিল্পের বিস্তর বিষয় বৈচিত্র্যে শিল্পীগণের সন্নিকর্ষে মানবপ্রেম সবচাইতে বড় স্থান দখল করে আছে মানব সৃষ্টির আদিকাল থেকে। প্রেম মানব মনের এক চিরন্তন ও স্বাভাবিক চাহিদা। এর আকর্ষণ দুর্নিবার ও অপ্রতিরোধ্য তার দুর্বার গতি। প্রেম বিস্রংস মানব মন কখনও সুস্থ স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে পারে না। তাই তো কবির হৃদয়জুড়ে প্রেম ভালোবাসা ও প্রণয়ের পাঠ; প্রিয়তমার কপোলে কালো তিল বন্ধনহীন হৃদপ্রতীমার প্রতিচ্ছবি। ‘শেষ হেমন্তের জোছনা ছুঁয়ে প্রণয়ের জলচিঠি। পৌঁছে গেছে নীল স্বপ্নের দুয়ারে। আকাশে-বাতাসে পাহাড়ে পর্বতে মুগ্ধতার বর্ণমালা সাজিয়ে দিয়েছে প্রণয়ের পাঠশালা। সিলেবাসজুড়ে শুধু প্রণয়ের পাঠ, ভালোবাসার হোমওয়ার্ক।’ (বিজয় সেনের রাজধানী এবং ভালোবাসার রাজকন্যা’ পৃঃ ১৫) তাঁর কাব্যেভূমে কবিতার পঙ্ক্তিতে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে ইতিহাস ঐতিহ্য অন্বিত ভৌগোলিক পটভূমি। তিনি পুরোপুরি সংবেদনশীল ইতিহাস ও ঐতিহ্য সচেতন একজন প্রাজ্ঞ নাগরিক কবি। কবিতার পঙ্ক্তিতে বর্ণিত ইতিহাসের সঙ্গে ঐহিত্য চেতনার যুগপৎ উদ্ভাসিত পাঠক ভক্তকুলকে সুদূর অতীতে নিয়ে যায়। ইতিহাস-ঐতিহ্যের সংমিশ্রণ সম্পর্কে ঞ.ঝ ঊষরড়ঃ-এর মন্তব্য এখানে প্রণিধানযোগ্য: ‘ঞযরং যরংঃড়ৎরপধষ ংবহংব যিরপয রং ধ ংবহংব ড়ভ ঃযব ঃরসবষবংং ধং বিষষ ধং ঃযব ঃবসঢ়ড়ৎধষ ধহফ ড়ভ ঃযব ঃরসবষবংং ধহফ ড়ভ ঃযব ঃবসঢ়ড়ৎধষ ঃড়মবঃযবৎ, রং যিধঃ সধশবং ধ ৎিরঃবৎ ঃৎধফরঃরড়হধষ.’ (ঞ.ঝ. ঊষরড়ঃ, ‘ঞৎধফরঃরড়হ ধহফ ঃযব রহফরারফঁধষ ঞধষবহঃ; ঢ়ড়রহঃং ড়ভ ারব,ি চধমব হড়-২৫), আমিনুল ইসলামের কবিতায় সচেতন ভাবেই ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মূর্তপ্রকাশ লক্ষণীয় : ‘আমি জানি- তুমিও জানো- আমি রাজা সোলেমান নই, তবু হে সুমনা, তুমি কেন রানী বিলকিস হয়ে ভেঙ্গে ফেলতে চাও লোভের বাতাসে চঞ্চল বাদামী ঈমানের বেড়া! ভালোবাসা বলেই কী ভাসিয়ে নিতে চাও পূবালী রাজ্যের রাজধানী-।’ (“যখন অসময় - সুসময়” পৃঃ ১০) আধুনিক কবিদের কাব্য ভাবনার একটি বিস্তৃত পরিসর দেশপ্রেম ও দেশের কল্যাণমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে কবিতা রচনায় প্রয়াস বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। মা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি তীব্র অনুরাগ মানুষ মাত্রই স্বভাবজাত। নির্দিষ্ট রাষ্ট্র সৃষ্টির আদিকাল থেকে অদ্যাবধি কবি সাহিত্যিকগণ মাতৃভূমির বন্দনায় যে প্রগাঢ় ভালোবাসার প্রকাশ দেখিয়েছেন তা সত্যিই তুলনারহিত। আমিনুলের দেশপ্রেমের উত্তুঙ্গ প্রকাশ তাঁর অসংখ্য কবিতার পঙ্ক্তিতে ভাস্বর হয়ে উঠেছে : সবকিছু জেনেও তোমাকে ভালোবাসে প্রযুক্তিজ্ঞানহীন একটি পুরাতন মন- যেভাবে কনডেম সেলে দাঁড়িয়ে দুপুরে ফাঁসির দ-প্রাপ্ত কোন নির্দোষ প্রাণ চোখের জলে স্বরলিপি ভিজিয়ে গায় ‘আমার সোনার বাংলা’- আমি তোমায় ভালোবাসি! (“দ-িত প্রেম” ‘প্রণয়ী নদীর কাছে’ পৃঃ ৭৩) জীবন নিয়ত সংগ্রামশীল। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত চলে এই সংগ্রাম নিরবচ্ছিন্নভাবে। সংগ্রামের পরেই আসে প্রাপ্তি, আসে পূর্ণতা। কখনও কখনও পরস্পর অন্বিত হয় সংগ্রাম এবং ভালোবাসা কারণ ভালোবাসা থাকলেই কেবল তা পাওয়ার জন্যে চলে প্রাণান্ত সংগ্রাম। একাত্তরে দেশের প্রতি ভালোবাসা ছিল বলেই সংগ্রাম যুদ্ধ ও লক্ষ প্রাণের আগ্মত্যাগে বাঙালী সেদিন কুণ্ঠিত হয়নি। কবির অন্তরজাত উপলব্ধি : একাত্তর নাই- একাত্তর আছে আছে সংগ্রাম- আছে ভালোবাসা। এ মাটিতে মিশে আছে- বেহুলার প্রেম, তিতুমীরের তেজ, এ মাটিতে মিশে আছে- প্রীতিলতার প্রাণ, জাহাঙ্গীরের যৌবন। [“আছে সংগ্রাম- আছে ভালোবাসা” পৃঃ ২৬] ধর্মান্ধতা কখনই ধার্মিকের প্রতিশব্দ নয় বরং ধর্মের বিধি লঙ্ঘনকারী হিসেবেই বিবেচিত। একবিংশ শতাব্দীর এই বিশ্বে দেশে দেশে যুদ্ধ-বিগ্রহ, অত্যাচার-অনাচার, নিপীড়ন ধর্মকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধর্ম গ্রোত্রে ও বর্ণে প্রতিনিয়ত চলছেই। ধর্মের অপব্যবহারকারী এক শ্রেণীর মতলববাজ কুচক্রী মহল ধর্মের ওপর দোষ চাপিয়ে হিংসাবিদ্বেষ ছড়িয়ে যাচ্ছেÑ পরিণতিতে ঘটছে মানবতার চরম বিপর্যয়। এ বিষয়ে কবির সংক্ষোভ পরিব্যাপ্ত হয়েছে কবিতার পঙ্ক্তিতে : ঠিক আছে রাজি, এসো তবে ভাঙ্গি সবে মিলে! কিন্তু ভাঙ্গি কি করে? এতো বাবরি মসজিদ নয়! রে ভাই কামার, ওরে ভাই নাপিত এ যে- আর এক হিমালয়! ব্যথা লাগে ঘাড়ে! ফিরে আসে চোখ! (“পর্বত বিরোধী গান” পৃঃ ২২) আজকের সভ্যতার সমৃদ্ধি ও উন্নতি যাদের রক্ত ঝরা শ্রমের বিনিময়ে সেই নিম্নবিত্তের কৃষক শ্রমিক শ্রেণী চিরকালই অবহেলিত ও নির্যাতিত। রাজা যায় রাজা আসে কিন্তু তাদের ভাগ্যের উন্নয়ন হয় না। তাদের অমানসিক শ্রমে সুবিধা ভোগ করে এক শ্রেণীর মুনাফাখোর স্বার্থপর ও নাম সর্বস্ব মেকি দেশপ্রেমিক। আমিনুলের কবিতায় কৃষক শ্রমিক শ্রেণীর প্রতি সহানুভূতির চিত্র ফুটে ওঠে : নিশ্চয় ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল সোনালি সম্ভাবনায়।’ ভূমিহারা কৃষকের মনে বুক পকেটে কুড়িয়ে রাখি একটি দুটি পাতা যতক্ষণ না তারা চাপ লেগে ধুলা হয়ে ওঠে! [“ভাঙ্গনের শব্দ শোনে গাছ” পৃঃ ৬৯] আধুনিক যান্ত্রিক জীবনের ক্লান্তি, ক্লেদাক্ততা ও মৃত্যুচেতনা উত্তরাধুনিক কবিতায় একটি বড় অংশে বিস্তৃত। জীবনের অপূর্ণতা, অপ্রাপ্তি নৈরাশ্য ও ব্যর্থতা মৃত্যুচেতনারই প্রতিরূপ। বর্তমান সময়ে অবক্ষয়িত মূল্যবোধে কবির অন্তরাত্মায় মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সবকিছুর চূড়ান্ত পরিণতির ইঙ্গিত পরিলক্ষিত হয় : আর আমি এও জানি- তোমার হাতে শেষ পেয়ালাটি হেমলকের- যা করতেই হবে পান- আজ না হয় কাল যেভাবে মোহাম্মদ আলীদেরও মেনে নিতে হয় হার- শেষের খেলায়! [“জীবন তোমাকে লাল গোলাপ শুভেচ্ছা” পৃঃ ৩২] ঋতুচক্রের উপস্থিতি ও তার অনুপুঙ্খ রূপায়ণ তাঁর কাব্য পঙ্ক্তিতে দুর্লক্ষ্য নয় বিশেষ করে হেমন্ত ও শীত ঋতু। ঋতুর আর্ভিভাব ও প্রকৃতিতে তা প্রভাব তাঁর নিখুঁত তুলির আচড়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে এবং বিভিন্ন ঋতুর রূপ লাবণ্যের সাযুয্যে মাতৃভূমির বন্দনায় দেশপ্রেমের পরিচয় প্রতিভাত হয়েছে। পাকা হেমন্তের ক্ষেত হয়ে উঠেছে রোদের শরীর পৃথিবী পরে আছে রেশমের শাড়ি সোনারঙ জমিন, ছায়ারঙ পাড় যেখানেই চোখ যায়- চোখে এসে লাগে সোনার রেণুর ঢেউ- আহা সুখ!’ [“সোনালি রোদের পরাবাস্তবতা” পৃঃ ৩৬] তাঁর কবিতায় গতিশীল জীবন, আপেক্ষিত সুখ, সংগ্রাম ও ভালোবাসা, বিশ্বমোড়ল জাতিসংঘের ব্যর্থতা, প্রতারণা, শঠতা, প্রতিহিংসা, বিদ্বেষ ও সহিংসতা, নিম্নবিত্তের মানুষের প্রতি ভালোবাসা, দুর্বলের প্রতি স্বেচ্ছাচারিতা ও বিচারহীনতা, ঋতু বৈচিত্র্য, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের উৎকর্ষতা, ইত্যাদি বিচিত্র অনুষঙ্গ তাঁর কাব্যভূমে কবিতার আখরে সংবেদনশীল হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি রূপে সন্দীপিত হয়ে উঠেছে। তাঁর রোমান্টিক কবি সত্তার প্রতিফলন পরিদৃষ্ট হয় এ কাব্যের বেশির ভাগ কবিতায়। প্রেম ও রোমান্টিক আবহে তিনি জগৎ ও জীবনকে বীক্ষিত করেছেন একটি সুন্দর ও শান্তিময় পৃথিবীর কামনায়। কাব্যের আদ্যপ্রাপ্ত যুগ সভ্যতা ও ব্যক্তি মনের নানা সঙ্কট ও টানাপোড়নে বেঁচে থাকার তীব্র আশাবাদের চিত্র ফুটে উঠেছে। গ্রন্থটির বহুল প্রচার আমার একান্ত কামনা।
×