রবার্ট ফ্রস্ট বলেছিলেন ‘আধুনিক মানুষকে যিনি তার কথা শোনাতে পারেন, তিনিই হলেন আধুনিক কবি। কবে তিনি বেঁচে ছিলেন সেটা বড় কথা নয়। তবে যদি আধুনিককালে বেঁচে থেকেই সে কাজ করে থাকেন, তাহলে তিনি আরও বেশি আধুনিক। আমি নিজেকে একজন আধুনিক মানুষ ও আধুনিক কবি হিসেবে বলতে চাই- কবিকে একটা দায়ের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। একটা শান্তির পৃথিবীর রচনার জন্য কবিতা লিখতে হয়। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখলে, সমাজে অন্যায়-অনাচার দেখলে কবি কবিতা প্রসবে ছটফট করে। মানুষ থেকে কবিতাকে কিংবা কবিতা থেকে মানুষকে সরিয়ে রাখা খুবই কঠিন ব্যাপার। সেলফি জীবনের দার্শনিকতায় দিন এমনই এসেছে যেখানে ঘরে ঘরে নার্সিসাস। পাশের বাড়ির লোকটি কিভাবে বেঁচে আছে আমরা জানি না, জানতেও চাই না। কপাট বন্ধসমাজে একজন কবি তবু পলাশ শিমুল দেখতে থাকেন। জাম আর জামরুলের ফাঁকে এক টুকরো মিষ্টি রোদের কথা লিখতে থাকেন। আমার এই কবিতাগুলো গভীর জীবনবোধ নিয়ে লেখা কবিতা। হাওড়ের কৃষকের কান্নার কবিতা, একজন নারীর লাঞ্ছনা আর দুঃখ-দুর্দশার কবিতা, মেহনতী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের কবিতা। অনেকে আধুনিক কবিতার দুর্বোধ্যতা নিয়ে কথাবলেন। একজন কবি বা লেখকের কাছে কঠিন শব্দ বলে কিছু নেই; সত্যিকার অর্থে কঠিন শব্দ বলে কি কিছু আছে? কবিতা হলো সাহিত্যের রানী। বিন্দুর ভেতর এক বিশাল সিন্ধু।
কবিতা হলো সুচয়নকৃত শব্দমালার সুগ্রন্থিত রূপ। পঠনে যা শ্রুতিমধুর, বুকের ভেতর ঢুকে এক অনির্বচনীয় আনন্দ দেবে। যা পাঠককে ভাবায়, কবিতা রসে টইটুম্বুর করে রাখে।
একগুচ্ছ অভিজাত শব্দ পাশাপাশি বসালেন, তা একটা ভাব বা অর্থ সৃষ্টি করল বটে, কিন্তু শ্রুতিমধুর হলো না, তাকে আমি কবিতা বলি না। আমার নিজের কবিতার মূল ভাব জলের মতো পরিষ্কার। একটি নকশার ব্লকপ্রিন্ট আমার হাতে। আরেকটি বিজ্ঞ পাঠকদের হাতে। কোন মালমসলায় কতটা মিশেল ঘটিয়ে পাঠক আরেকটি নকশার স্বরূপ উন্মোচন করবেন তা বিজ্ঞ পাঠকরাই ভাল বোঝেন। কবির সঙ্গে পাঠকের সম্পর্ক স্রষ্টা ও ভোক্তার। এই কথাটি আমি বিশ্বাস করি।
হেনরির হাতুড়ি
শুনতে কি পাও, জন হেনরির হাতুড়ির গান
ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে শিকাগো শ্রমিক আগস্ট স্ফিজ, জোয়ান মোস্ট
শুনতে কি পাও- ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলোনোর আগে আগস্ট স্ফিজের কণ্ঠস্বর-
আজ আমাদের নিঃশব্দতা, তোমাদের আওয়াজ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী।
কারগারে ফাঁসিতে না ঝুলে নিজে আত্মাহুতি দিলেন মজুর নেতা লুই লিঙ্ক
আমি শুনি, আজও শুনি আকাশে বাতাসে হেনরির হাতুড়ির গান
আজও আমি শুনি বিপ্লবী চে’র বুকে নয়টি বুলেটে পাশবিক মৃত্যঘৃণ্টা ধ্বনি।
বাংলাদেশের শ্রম ফেরি করা এক যুবক আমি; আজও তন্দ্রায় শুনি
চে গুয়েভারার বিপ্লবের স্বর- বাস্তব বাদী হও, অসম্ভবকে দাবি কর।
আমি অসম্ভবের দাবি নিয়ে এসেছি
জেগে উঠো ছাইচাপা আগুন অধিকার হয়ে।
বুকে আজও রক্তচোষা মালিকের লুটে নেয়ার কষ্ট
ওই পুঁজিবাদ আজও রক্ত চায়। ওই জাগ্রত সাম্রাজ্য এখনও
পানির দামে কিনতে চায় মানবতা, অলৌকিক শ্রমঘণ্টা।
দুতিয়ার চাঁন
কুমারিত্ব পেলে নারী
পুরুষতান্ত্রিক শৃঙ্খল, তালাবন্ধ রুদ্ধ দ্বার
মনো দৈহিক ট্রমা বুকে বৈষম্যের জাল
নিষিক্ত ডিম্বাণু শরীর বৃত্তির কোন এক তিথিতে
ফিরে ফিরে এলো দুতিয়ার চাঁন
অধরা রূপ আনন্দে মিলিয়ে যাও
প্রেম ও মুক্তি খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত হও নারী
প্রতিটি রজঃ স্রাবে।
হাওড়ের আলপথে মানুষ
ভাটির দেশে কৃষাণীর কান্না হাওড়ের আলপথে নিরন্ন মানুষ
বাঁধভাঙ্গা ঢলে ফলজ ধানের করুণ মৃত্যু; ভেসে গেছে কন্যা বিয়ের স্বপ্ন
যক্ষের ধন তলিয়ে গেল এ কোন অভিশাপে।
ধানের থুর, মাছ আর জলজ কাঁকড়ার কসম
অভুক্ত শিশুদের আধপেটা কান্না ঘুম; বিস্তীর্ণ হাওড়ের বিলাপ হলো আজ
অভিশাপ, পাপের ফর্দে ভরে ওঠে বার বার
নির্দোষ অনাহারী কৃষকের খেরো খাতা।
পাতার চুরুট
ধোঁয়া কু-লীতে দেখি চিরচেনা সেই অচেনা মুখ
ভুলের দহনে পোড়াই- শুধু পাতার চুরুট।
বৃষ্টি সে তো কাঁদবে-
নদী! সে তো ভাঙবে দুকূল
ভুল! সে তো ঝর্ণার অতল
পাবে না খুঁজে তার কূল।
বুকের জমানো পাথর পাবে না খুঁজে নুড়ির দেখা
দু’চোখ পেতেছি স্বপ্ন দেখব বলে হয়ে উন্মুখ
কাঁপছি কষ্টে অচেনা সেই চিরচেনা মুখ।
ভুলের দহনে পুড়ি তাই
পোড়াই শুধু পাতার চুরুট।