ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মলয় বিকাশ দেবনাথ

বৈশ্বিক শ্রমবাজার ও বাংলাদেশের নারীরা

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ২৬ মে ২০১৭

বৈশ্বিক শ্রমবাজার ও বাংলাদেশের নারীরা

আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের নারীরা অর্থনীতিতে অবদান রাখতে দেশ ও দেশের বাইরে নানাভাবে নিজেকে সম্পৃক্ত করছে। মেধাবী ও সচ্ছল পরিবারের মেয়েরা যেমন মেধার বিকাশ ঘটিয়ে দেশে-বিদেশে সুনামের সঙ্গে কাজ করছে, অন্যদিকে সুবিধা বঞ্চিত মেয়েরা ও ভাগ্যোন্নয়নের লক্ষ্যে কর্মক্ষেত্রে নিজেকে নিযুক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এ চেষ্টা হচ্ছে রীতিমতো যুদ্ধে নামার শামিল। প্রতিকূলতার যেমন শেষ নেই তেমনি রয়েছে মধ্যস্বত্ব ভোগকারীদের দৌরাত্ম্য। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ সরকার ও অন্য দেশের মধ্যে শ্রমিক পাঠনোর চুক্তি হয় এবং কিছু এজেন্সির মাধ্যমে তাদের পাঠানো হয়। যারা এ ধরনের ভিসায় যেতে আগ্রহী হয় তারা একেবারেই প্রান্তিক অবস্থা থেকে আসে। অনেকে হয়ত ধার-দেনা কিংবা কেউ নিজের শেষ সম্বল ভিটেমাটি বিক্রির মাধ্যমে টাকা যোগাড় করে একটু ভাগ্য পরিবর্তনের আশায়। বাস্তবে সে ভাগ্য কতটুকু বদলায়। শুরু হয় অনিয়ম-দুর্নীতি আর প্রতারণা দিয়ে। খরচ বাবদ যত টাকা দেয়ার কথা তার থেকে বেশি টাকা ব্যয় করতে হয় শ্রমিকদের, আবার অনেকে হয় প্রতারিত। এ ধরনের অনেক উদাহরণ আছে যে নারী শ্রমিকরা এক বছর ধরে টাকা দিয়ে এজেন্সির দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। এদিকে প্রশিক্ষণের অভাবে হংকংয়ে নারী শ্রমিক রফতানিতে দেখা দিয়েছে ধীরগতি। এ জন্য সরকারের উদ্যোগ ও সমন্বয়হীনতাকেই দায়ী করছেন জনশক্তি রফতানি ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) কর্মকর্তারা। হংকং সরকারের আগ্রহ অনুযায়ী ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে ৮০ হাজার নারী শ্রমিক পাঠানোর চুক্তি করে বাংলাদেশ সরকার। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে সুযোগ না দিয়ে সরকারীভাবে সেখানে শ্রমিক পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। এ লক্ষ্যে সারাদেশে আগ্রহী নারী শ্রমিকদের নিবন্ধন করে সরকার। যাতে প্রায় ২৫ হাজার নারী নিবন্ধন করে। কিন্তু এর বিপুল সংখ্যক নারী শ্রমিক যেতে আগ্রহী হওয়ার পরও সেভাবে যাওয়া হচ্ছে না তাদের। বিএমইটি সূত্র জানায়, হংকং সরকারের চাহিদা অনুযায়ী সে দেশের কয়েকটি বেসরকারী রিক্রুটিং এজেন্সির সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের একটি চুক্তি হয়। চুক্তিতে বলা হয়, হংকং যাওয়ার বিমান ভাড়া ৪০০ মার্কিন ডলার প্রাথমিকভাবে বহন করবে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। পরে কর্মীদের প্রতি মাসের বেতন থেকে সহজ কিস্তিতে তা কেটে নেয়া হবে। আর ভিসা ও অন্যান্য প্রক্রিয়ার খরচ বাবদ ৫০৫ ডলার ঋণ দিবে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক। যা পরবর্তীকালে বিভিন্ন মেয়াদে পরিশোধ করতে হবে। ভিসার মেয়াদ হবে দুই বছর। আর প্রত্যেক কর্মীর মাসিক বেতন কমপক্ষে ৫০০ ডলার যা বাংলাদেশী টাকায় ৪০ হাজার টাকা। অন্যদিকে সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসে আশ্রয় নিয়েছেন দুই শতাধিক নারী শ্রমিক। বেশিরভাগই নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের হেফাজত থেকে পালিয়ে এসেছেন। এদের মধ্যে অনেকে থাকা খাওয়ার সমস্যায় অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। প্রায় এক মাস ধরে দূতাবাসের আশ্রয়কেন্দ্রে থাকলেও তাদের কাউকেও দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। দূতাবাসের আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ভিকটিম সুমী আখতার (ছদ্মনাম) তার স্বজনদের টেলিফোনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে অভিযোগ করে বলছেন, যদি দূতাবাস তাকে দেশে পাঠাতে না চায় তাহলে তাকে যেন ঢাকা থেকে রিটার্ন টিকেট পাঠিয়ে ফেরত আনা হয়। গত ২৯ মার্চ থেকে এক মাসে দূতাবাসে আশ্রয় নেয়া ৫০২ জন নারী শ্রমিককে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে বলে জানান সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের লেবার কাউন্সেলর সারোয়ার আলম। নতুন করে আশ্রয়ে থাকা ৩২৯ নারীর মধ্যে জেদ্দায় বাংলাদেশ কনস্যুলেটে রয়েছেন ৭৪ জন, বাকি আড়াই শতাধিক রিয়াদ দূতাবাসে। এসব নারী শ্রমিকের অভিযোগ, বেসরকারী ব্যবস্থাপনায় বৈধভাবে শ্রমিক হিসেবে এলেও বাংলাদেশ থেকে দালালরা যে কাজের কথা তাদের বলেছিল, সৌদি আরব গিয়ে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সেই কাজ দেয়া হয়নি। রিয়াদের বাংলাদেশ দূতাবাসে আশ্রয় নেয়া কয়েক নারী বলছেন, তাদের কয়েকজনকে হাসপাতালে নার্সের সহযোগী ও পিয়নের কাজের কথা বলা হলেও সেখানে যাওয়ার পর দেয়া হয়েছে ক্লিনারের কাজ। আশ্রয় নেয়া অধিকাংশই মূলত গৃহশ্রমিক, যারা ঠিকমতো বেতন পায় না এমনকি তিন বেলা ঠিকমতো খাবারও জোটে না বলে অভিযোগ করেছেন। এ ছাড়া নিত্য শারীরিক নির্যাতন বাড়তে থাকার পাশাপাশি যৌন নির্যাতনের কারণেও পালিয়ে দূতাবাসের শেল্টারহোমে আশ্রয় নিয়েছেন বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান কয়েক নারী শ্রমিক। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ তো পায় না তার ওপর যোগ হয় নির্যাতন। এসব সহ্য করতে না পেরে তিন সপ্তাহ আগে ওই বাসা থেকে পালিয়ে রিয়াদের দূতাবাসে আশ্রয় নেয়ার কথা জানান তিনি। তিন সপ্তাহ দূতাবাসের আশ্রয়কেন্দ্রে কাটিয়ে দেয়া এই নারীর মতো অনেকে আরও বেশি সময় ধরে রয়েছেন। তারা কবে ফিরতে পারবেন, তাও জানেন না। মূলত বেশিরভাগ রিক্রুটিং এজেন্সি সঠিক ট্রেনিং না দিয়েই বিদেশে নারী শ্রমিক পাঠাচ্ছে। যার কারণে নারী শ্রমিকরা যাওয়ার পর ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না। তখনই তাদের ওপর মারধরের ঘটনা ঘটছে। তারা বলেন, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর ট্রেনিং বিভাগ মূলত দায়ী। কারণ নারী শ্রমিকদের এক মাসের ট্রেনিং দেয়ার কথা। কিন্তু বেশিরভাগ ট্রেনিং সেন্টারে নারী শ্রমিকেরা ট্রেনিংয়ের জন্য ভর্তি হলেও তারা ট্রেনিং না করে বাসায় চলে যান। শেষ দিনে গিয়ে সার্টিফিকেট নেন। এরপর বিদেশ পাড়ি জমান। তাদের মতে, এগুলো মনিটরিং করা জরুরী। তা না হলে বিদেশে শ্রমবাজারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হতেই থাকবে। বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ, এখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ দিনে দিনে বাড়ছে। তাই সঠিক কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত না করে বিদেশে পাড়ি জমানোর ব্যাপারে আরও সতর্ক হওয়া উচিত, সেই সঙ্গে সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক।
×