ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সাহিত্যে প্রেম

প্রকাশিত: ০৬:২৭, ২৬ মে ২০১৭

সাহিত্যে প্রেম

সাহিত্যে প্রেম বিভিন্ন রঙে, বিভিন্ন আঙ্গিকে হাজার বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রেম শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে ‘বিরহ’ শব্দটিও সামনে চলে আসে। বাংলা ভাষার এমন অসংখ্য সফল প্রেমপ্রধান সাহিত্যকর্ম রয়েছে-যেগুলো কয়েক শ’ বছর ধরে আমাদের আন্দোলিত করে আসছে। প্রেম ও বিরহ, মিলন ও বিচ্ছেদের কাহিনীনির্ভর এসব সাহিত্যকর্মগুলো পাঠকদের মনে পোক্ত আসন গেড়ে রয়েছে। বলা হয়ে থাকে পৃথিবী টিকে আছে প্রেমের ওপর অথবা প্রেমই আদি এবং অন্তিম সত্য। আমরা আলোচ্য নিবন্ধে বাংলা সাহিত্যে প্রেমের উপস্থাপন, রূপান্তর, বাঁক-বদল ও প্রেম সংক্রান্ত বিবিধ চিন্তার দিকে আমাদের দৃষ্টিকে প্রসারিত করার চেষ্টা করব। সে চেষ্টা কতটুকু সফল বা বিফল হলো, তার হিসেব লেখা শেষে করা যেতে পারে। দুই. বাংলা সাহিত্যের কথা বললে প্রথমতই চর্যাপদের কথা উল্লেখ করতে হয়। কারণ, এ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের যত নিদর্শন পাওয়া গেছে, তারমধ্যে সর্বাপ্রেক্ষা প্রাচীন বৌদ্ধ সহজিয়া সম্প্রদায়ের সাধনতত্ত্ব ‘চর্যাপদ’। চর্যাপদ সহজিয়া সম্প্রদায়ের সাধনতত্ত্বনির্ভর হলেও এর উপস্থাপন হয়েছে তৎকালীন মানুষের জীবন-যাপনের মধ্য দিয়ে। চর্যাপদে তাই তৎকালীন সমাজচিত্র সুস্পষ্ট। সেজন্যে দেড় হাজার বছর পূর্বে রচিত চর্যাপদের বিভিন্ন পঙ্ক্তিতে প্রেম-কামনা-বাসনার প্রতিচ্ছবি অদৃশ্যমান নয়। বরং বেশ ক’জন চর্যাকারের পদে প্রেমের বিষয়-আশয় নান্দনিকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। পাঠ করা যাক প্রাচীন গ্রন্থটির ২৮ নং চর্যার কয়েকটি পঙ্ক্তি : ‘উঁচা উঁচা পাবত তঁহি বসই সবরী বালী। মোরঙ্গীপীচ্ছ পরিহাণ সবরী গিবত গঞ্জরী মালী ॥ উমত সবরো পাগল সবরো মা কর গুলী গুহারী। (তেহোরী) ণিঅ ঘরণী নামে সহজ সুন্দরী ॥ নানা তরুবর মৌলিল রে গণঅত লাগেলী ডালী। একেলী সবরী এ বণ হিন্ডুই কর্ণকুন্তল বজ্রধারী। Ñশবর পা। আধুনিক বাংলা করলে উপরোক্ত কবিতার অর্থ এই দাঁড়ায় : ‘উঁচু উঁচু পাহাড়ে শবরী বালিকা বাস করে। তার মাথায় ময়ূরপুচ্ছ ও গলায় গঞ্জরীমালা লাগানো আছে। নানা তরু মুকুলিত হলো। তাদের শাখা-প্রশাখা আকাশে বিস্তৃত হলো। শবর-শবরী প্রেমে পাগল হলো। তাদের হৃদয় রঙিন ও উদ্দাম হলো কামনার রঙে। অতঃপর শয্যা পাতা হলো। শবর-শবরী প্রেমাবেশে রাতযাপন করল।’ এখানে মানব-মানবীর প্রেম স্পষ্ট। তাদের কামনা-বাসনাগুলোও রঞ্জিত। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে পরকীয়া প্রেমের ইঙ্গিতও ছিল। চর্যাকার কুক্কুরী পা ২নং চর্যায় লিখেছেনÑ‘দিবসহি বহুড়ী কাউ হি ডর ভাই।/ রাতি ভইলে কামরূ জাই ॥’ অর্থাৎ ‘দিনের বেলায় যে গৃহবধূ কাকের ভয়ে ভীত থাকে, সেই বধূই রাতের বেলায় অভিসারে চলে যায়।’ তিন. প্রাচীন যুগের সাহিত্য নিদর্শন চর্যাপদ রচনার প্রধান লক্ষ্য ধর্মীয় সাধনতত্ত্ব হলেও মধ্যযুগের সাহিত্যিকগণ আঙ্গিকে ও উপস্থাপনে সে ধারাবাহিকতা রক্ষা করেননি। মধ্যযুগের সাহিত্যে (১২০১-১৮০০ খ্রি.) বহুলভাবে স্থান করে নিয়েছে রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান জাতীয় রচনা। পাশাপাশি সেখানে বিভিন্ন মঙ্গলকাব্য তো ছিলই। মঙ্গলকাব্যে যে প্রেমের উপস্থিতি সরব নয়, তেমনটিও নয়। তবে প্রণয়োপাখ্যানগুলোতে যেভাবে প্রেমের চূড়ান্ত উপস্থাপন ঘটেছে বিষয়গত কারণেই মঙ্গলকাব্যে সেভাবে ঘটেনি। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ মূলত অনুবাদের কাল। বাংলা ভাষার শক্তিমান লেখকগণ এ সময় আরবী, ফার্সী, হিন্দি ভাষার জনপ্রিয় রচনাগুলো বাংলায় অনুবাদ শুরু করেন। এর মধ্য দিয়ে অবশ্য বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের সমন্বয় শুরু হয়। মধ্যযুগে অনুবাদকৃত রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑদৌলত উজির বাহরাম খাঁর ‘লায়লী-মজনু’ (মূল লেখক : ইরানী কবি জামি), শাহ মুহম্মদ সগীরের ‘ইউসুফ-জোলেখা’ (মূল : মহাকবি ফেরদৌসী), মহাকবি আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ (মূল : মালিক মুহম্মদ জায়সীর ‘পদুমাবৎ’), দোনা গাজী, আলাওল, মালে মুহাম্মদের ‘সয়ফুলমুলুক-বদিউজ্জামান’ (আদি উৎস : আলিফ লায়লা), শিরি-ফরহাদ প্রমুখ। মধ্যযুগের লায়লী-মজনু, ইউসুফ-জোলেখা, পদ্মাবতী, সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামালÑএই চারটি প্রণয়োপাখ্যানই খুব বেশি প্রভাবশালী ছিল। যদিও কবিরা এসব উপাখ্যান অনুবাদ করেছেন কিন্তু সেগুলোকে তারা অনুবাদের পারঙ্গমতায় প্রায় মৌলিক পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। তারা প্রয়োজনে কাহিনীর সঙ্কোচন ও সংযোজন করেছেন। সৃষ্টি করেছেন নতুন চরিত্রও। এ অনুবাদ হুবহু অনুবাদ না হয়ে ভাবানুবাদ হয়েছে বিধায় মূল রচনার পরিবেশ ও প্রতিবেশ বদলে দিয়েছেন লেখকরা। তার পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে আমাদের চিরচেনা প্রকৃতি ও পরিবেশ। এখানে আরও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে যেমন ধর্মতত্ত্ব ছিল, তেমনি মধ্য যুগের সাহিত্যে ছিল দেবী বন্দনা, যেটি প্রত্যক্ষভাবে আধ্যাত্মিকতাকেই স্থান করে দেয়। ধারণা করা হয়, আমাদের অনুবাদকৃত সাহিত্যগুলো সুফীদের সৃষ্টি। আর সুফীদের সৃষ্টিতে আধ্যাত্মিকতার মিশেল থাকবে এমনটাই স্বাভাবিক। ড. আহমদ শরীফ ‘বাঙালী ও বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থে এ ব্যাপারটিকে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। তার বিবেচনায়, ইউসুফ-জোলেখা, লাইলী-মজনু, শিরি-ফরহাদÑতিনটি প্রণয়কাহিনী বিশ্ব মুসলিমের ঘরোয়া সম্পদ।...লাইলী-মজনু ও শিরি-ফরহাদ রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের মতো অধ্যাত্মপ্রেমের রূপকাশ্রিত প্রণয়োপাখ্যান।’ অর্থাৎ প্রাচীন চর্যাপদের মধ্য যেমন ধর্মীয় চিন্তার প্রয়োজনে উপকরণ হিসেবে প্রেম এসেছে, তেমনি মধ্যযুগেও ¯্রষ্টা ও সৃষ্টির প্রেম দেখাতে গিয়ে আভিধানিকভাবে মানব-মানবীর প্রেম উপস্থাপিত হয়েছে। তবে এসব কাব্যে প্রেমের উপস্থাপনে ভিন্নতা লক্ষণীয়। ‘লায়লী-মজনু’ গ্রন্থে আমির পুত্র কয়েস ও লায়লীর প্রেম মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয়। চূড়ান্ত বিরহই এ কাব্যটির পরম পরিণতি। এ প্রণয়োপাখ্যানে প্রেম এসেছে, এ প্রেম তীব্র কামনা ও বাসনার নয়, এ প্রেম দেহজনির্ভর নয়। ড. আহমদ শরীফের ভাষায় এ প্রেম ‘অশ্লীলতামুক্ত’ ও ‘সংযমী’। অন্যদিকে চ-ীদাশের ‘শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন’ কাব্যে এ মন্তব্য বিপরীত দিক দিয়ে উপস্থিত হয়। ‘শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন’-এর রাধা ও কৃষ্ণ প্রেমের আদিরসে জারিত এবং কৃষ্ণের তীব্র কামনাকে পূর্ণতায় রূপ দিয়ে এটি সমানভাবে অশ্লীলও। দেহজ প্রেম এখানে আদি-অন্তে গুরুত্ব পেয়েছে। এবার মঙ্গলকাব্যের দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ‘চ-ীমঙ্গল’ কাব্যে মূলত ব্যাধ কালকেতু ও তার স্ত্রী ফুল্লরার প্রতি দেবী চ-ীর অনুগ্রহের কাহিনী বর্ণিত করেছেন। যদিও এ কাব্যে দেবীর উপস্থিতি সরব, তবু কালকেতু ও ফুল্লরার ঘরকন্না এতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। কালকেতু তার স্ত্রীকে প্রাণাধিক ভালবাসে। ফুল্লরাও ভালবাসে তার স্বামীকে। দেবী চ-ীর বিভিন্ন পরীক্ষায় তাদের প্রেমের দৃঢ়তা পাঠক মনে স্পষ্ট হয়ে উঠে। কাব্যে দেখা যায়, কালকেতু শিকারে গিয়ে স্বর্ণগোধিকা রূপধারী দেবী চ-ীকে গৃহে আনেন। কালকেতু হাটে গেলে দেবী এবার সুন্দরী নারীর বেশ ধরে তার গৃহে অবস্থান করেন। ফুল্লরা ঘরে এসে সেই সুন্দরী নারীকে দেখে ভেবেছেÑতার স্বামী বুঝি এ সুন্দরীকে বিয়ে করে ঘরে এনেছে। চিরায়ত বাংলা বধূর মতো ফুল্লরা স্বামীর নতুন বিয়ের বিষয়টিকে (যদিও ফুল্লরার ধারণা ছিল ভুল) মেনে নিতে পারেনি। প্রচ- কষ্টে তাই তো সে কেঁদে কেটে ‘চক্ষু রাতা’ করেছে। অবশ্য শেষ পর্যন্ত কালকেতু দেবী-প্রেমে এবং পতœী-প্রেমের পরীক্ষায় উৎরে যান। রাজ্য ফিরে পাওয়ার মধ্য দিয়ে কালকেতু-ফুল্লরার প্রেম অনন্তে পৌঁছে। মনসামঙ্গল কাব্যে বেহুলা ও লখিন্দরের প্রেমও এক্ষেত্রে বিশেষভাবে স্মরণীয়। মনসার শাপে চাঁদ সওদাগরের পুত্র লখিন্দর সাপ দংশিত। তাকে প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী ভেলায় করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। লখিন্দরের স্ত্রী বেহুলা সব বাধা উপেক্ষা করে স্বামীর সঙ্গে ভেলায় সহযাত্রী হন। স্বামীকে বাঁচানোর জন্যে বেহুলার যে আকুতি ও প্রচেষ্টাতা পাঠককে মাত্রই বিস্মিত করবে। স্বামীর প্রতি বেহুলার অগাধ প্রেম তাকে চরিত্র হিসেবে বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন করে দিয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য ধর্ম আশ্রিত, ¯্রষ্টা ও সৃষ্টির প্রেমনির্ভর হয়েও এতে নর-নারীর প্রেমের প্রকাশ ঘটেছে চিরন্তন ধারায়। তাদের প্রেম একমুখী ও পানসে হয়নি। বরং বিরহও এখানে নতুন মাত্রা লাভ করেছে। যার ফলে ঋতু অনুসারে বিরহীর বেদনা উপস্থাপনের জন্যে বাংলা সাহিত্যে ‘বারমাইস্যা’র উদ্ভব হলো। নানা কারণে মধ্যযুগের প্রেম বহু বর্ণিল ও বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়েছে। লাইলীর প্রেমের সঙ্গে রাধার প্রেম, কৃষ্ণের কামনা বহিঃপ্রকাশের সঙ্গে যেমন মজনুর কামনার প্রকাশ মেলে নাÑতেমনি বেহুলার ত্যাগের সঙ্গে মেলে না পদ্মাবতীর তিতিক্ষা। কালকেতু ও লখিন্দরের চরিত্রও পরস্পর মেলানো যায় না। অবশ্য সাহিত্য এমন অভিন্নতা ও বৈচিত্র্যই দাবি করে। চার. কালিক বিবেচনায় বাংলা উপন্যাসের বয়স তেমন দীর্ঘ হয়নি। বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাস ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ প্রকাশিত হয় ১৮৫২ সালে। এটি লিখেছিলেন হানা ক্যাথেরিন ম্যলেন্স। সে হিসেবে বাংলা উপন্যাসের যাত্রাকাল এখনও দু’ শ’ বছরকে অতিক্রম করতে পারেনি। ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাস হলেও এটি কিন্তু সার্থক উপন্যাস ছিল না। এর ছয় বছর পর ১৮৫৮ সালে প্যারীচাঁদ মিত্র লিখেন ‘আলালের ঘরের দুলাল’। সেটিও সার্থক উপন্যাস হিসেবে রূপ লাভ করতে পারেনি। বাংলা ভাষার প্রথম সার্থক উপন্যাস প্রকাশিত হয় এর আট বছর পরে। সমালোচকদের মতে, ১৮৬৫ সালে লেখা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘দুর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাসটিই বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক উপন্যাস। যেহেতু প্রবন্ধের নির্দিষ্ট বিষয় ‘সাহিত্যে প্রেম’Ñতাই আমাদের জানার আগ্রহ থাকেÑ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ উপন্যাসে কতটুকু প্রেমের প্রসঙ্গ আছে? এ উপন্যাসে যে প্রেমের প্রসঙ্গ নেই, তা নয়। তবে প্রেমের প্রসঙ্গ যেটুকু আছে সেটি দৈনন্দিনতার স¦াভাবিকতাকেও ম্লান করে। উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র ‘করুণা’ সম্পর্কে কথক মেম সাহেবের বর্ণনাটিকে উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করা যাকÑ‘স্বামীকে ভাল হইবার লক্ষণ দেখিবা মাত্র যে এইরূপ প্রেমের কথা কহিল, তাহাতে আমি উল্লসিতা হইলেও আশ্চার্য্যজ্ঞান করিলাম না, কারণ যৌবনকালে বিবাহিত স্বামী অপেক্ষা এই জগতের মধ্যে এমত প্রিয়তম সম্বন্ধ আর কাহারও সহিত হয় না।’ এ উপন্যাসটিতে প্রেমের প্রসঙ্গ এর চেয়ে বেশি উচ্চকিত হয়নি। প্রেমের প্রসঙ্গ যতটুকু এসেছে তা কেবলমাত্র কাহিনীকথক মেম সাহেবের উপলব্ধিজাত বর্ণনামাত্র। আলালের ঘরের দুলাল উপন্যাসেও প্রেম প্রসঙ্গ নিষ্প্র্রভ ছিল। তবে বাংলা ভাষার প্রথম সার্থক উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’তে প্রেমের প্রবল উপস্থিতি রয়েছে। উপন্যাসটি মানসিংহের পুত্র কুমার জগৎসিংহের সঙ্গে বীরেন্দ্র সিংহের কন্যা দুর্গেশনন্দিনী তিলোত্তমার মিলনের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি দিকে হেঁটেছে। উপন্যাসের আদি ও অন্তে প্রেমের উপস্থিতি দ্বন্দ্বমুখর ছিল। দুর্গেশনন্দিনীর মধ্য দিয়ে বাংলা উপন্যাসে বাধা-বিঘœ পেরিয়ে প্রেমের জয় সূচিত হয়েছিল। অবশ্য এ উপন্যাসটি মিলনাত্মক এবং প্রেমের মিলন এখানে প্রাপ্তি হলেও আমরা কিছুকাল পরে দেখি লেখকের ‘কপালকু-লা’ উপন্যাসে প্রেম ভিন্নমাত্রা নিয়েছে। দুর্গেশনন্দিনীতে যে প্রেম ছিল রাজ-রাজড়াদের, কপালকু-লায় সে প্রেম নেমে এসেছে সাধারণ মানুষের কাতারে। অরণ্যলালিতা কপালকু-লা ও নবকুমারের প্রেমের প্রধান বাধা সেখানে কাপালিক ছিল এবং কাপালিক সফলও হয়েছিল। উপন্যাসের সমাপ্তি করুণার উদ্রেক করলেও প্রেমিকা হিসেবে কপালকু-লা যথার্থই বাংলা সাহিত্যের নতুন সংযোজন হয়েছে। শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর, রবীন্দ্রনাথ, মানিক, জহির রায়হান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মাহমুদুল হক প্রমুখ বাংলা উপন্যাসে বিচিত্র প্রেক্ষাপটে প্রেমকে হাজির করেছেন। সময় যতো এগিয়েছি, ততই যুগ যন্ত্রণা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বাংলা উপন্যাসে। ফলে দ্বিমুখী প্রেম, ত্রিভুজ প্রেম, দ্বন্দ্ব ও সংঘাত আরও প্রবল হয়েছে। ১৯০১ সালে রচিত শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’ প্রেমের উপন্যাসের একটি মাইলফলক। শরৎচন্দ্র প্রেমিক হৃদয় উপস্থাপনে তৎপর সাহিত্যিক ছিলেন। ১৯০৩ সালে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ উপন্যাসটিও নানা কারণে আলোচিত। বিনোদিনীর প্রেম এখানে ভয়াল ও উপন্যাসের চালিকাশক্তি। বিনোদিনীর প্রেম কখনও মহেন্দ্রকে টেনেছে, কখনও দূরে সরিয়েছে, কখনও বিনোদিনী চেয়েছে বিহারীকে। অন্যদিকে মহেন্দ্রের ঘরে স্ত্রী আশা আছে, তবু সে বিনোদিনীকে পেতে চায়। এখানে বিহারী চরিত্রটিও নানাভাবে উজ্জ্বল। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝির কুবের ও কপিলার প্রেম অন্তজ শ্রেণীর মানুষের জীবনকে চিত্রিত করেছে অদ্ভুত সরলতায়। ‘চোখের বালি’র মহেন্দ্র যেমন পরকীয়ায় আশ্রয়ী, তেমনি পদ্মা নদীর মাঝির কুবেরও একই নেশায় মত্ত। এখানে লক্ষণীয় এই যে, কপিলাও অন্য একজনের স্ত্রী। সম্পর্কে কুবের তার বড় বোন মালার স্বামী। তারপরে কুবের ও কপিলার প্রেম বাধ মানেনি। প্রেমে দুজনই উছল হয়েছে। মাঝখানে যতই মালার শ্যান দৃষ্টি থাকুক, কপিলা ফিরে যাক তার স্বামীর কাছেÑশেষ পর্যন্ত দেখা যায় ময়না দ্বীপে সর্বাগ্রে কপিলাই কুবেরের সঙ্গী হয়েছে। কুবেরের প্রতি তার আকুতিভরা উচ্চারণ ‘আমারে নিবা মাঝি লগে’ শেষ পর্যন্ত সফলই হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের চিরায়ত উপন্যাসগুলোর কথা বললে ‘হাজার বছর ধরে’ সামনে চলে আসে। জহির রায়হানের মন্তু মিয়া চরিত্রটিও প্রেমে উজ্জ্বল এবং এটি দ্বিধাবিভক্ত চরিত্রও বটে। সম্ভবত, মন্তু নিজেকে বুঝতে পারে না, যার কারণে সে টুনিকে যেমন বিয়ের জন্যে বলে, সংসার পাতার কথা বলে; তেমনি আম্বিয়ার প্রতিও তার ভালবাসার কমতি থাকে না। এ উপন্যাসে জহির রায়হান প্রেমের উপস্থাপনে ও বিস্তারে ইঙ্গিতের আশ্রয় নিয়েছেন। খোলাখুলি কথা কমই বলেছেন। টুনির প্রতি মন্তুর ভালবাসা এবং মন্তুর প্রতি টুনির ভালবাসা প্রকাশ পেয়েছে তাদের প্রাত্যহিক আচরণে। টুনি মন্তুকে ভালবাসে বলেই আম্বিয়া ও মন্তুকে নিয়ে সালেহার মসকরা টুনির সহ্য হয় না। বরং সালেহার মসকরা টুনিকে রাগিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে সালেহা চরিত্রটির প্রতিক্রিয়া তুলে ধরা যেতে পারে : সালেহা বলল, ‘আমরা না হয় মন্তু মিয়া আর আম্বিয়ারে নিয়া একটুখানি ঠাট্টামশকরা কইরতাছিলাম, তাতে টুনি বিবির এত জ্বলন লাগে ক্যান?’ এ কথার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ‘পরক্ষণে একটা অবাক কা- করে বসল টুনি। সালেহার চুলের গোছাটা ধরে হ্যাঁচকা টানে ওকে মাটিত ফেলে দিল। তারপর চোখে-মুখে কয়েকটা এলোপাতাড়ি কিল ঘুসি মেরে দৌড়ে সেখান থেকে পালিয়ে গেল টুনি।’ জহির রায়হান টুনির মধ্য দিয়ে এভাবেই মন্তুর প্রতি তার অনুরাগ প্রকাশ করেছেন। তারাশঙ্করের ‘কবি’ উপন্যাসের বাসন্তী এবং ঠাকুর জি’র প্রেমও আমাদের কম বিহ্বল করেনি। বাংলা উপন্যাসের ভা-ার ইতোমধ্যেই অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে। প্রেমের প্রসঙ্গ এখানে অজ¯্র। স্থান সীমাবদ্ধতায় উপন্যাসের প্রেমের প্রসঙ্গ দীর্ঘায়িত করছি না। পাঁচ. প্রেমের উপস্থাপনে এ উপমহাদেশের কবিরা পাশ্চাত্যের চেয়ে এগিয়ে। এ উপলব্ধি কেবল এই সময়কার নয়, শতবছর পূর্বে এ উপলব্ধি বাঙালী সাহিত্য সমাজে প্রচলিত ছিল। বলেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘প্রেম : প্রাচ্য ও প্রাশ্চাত্য’ প্রবন্ধের কথা এখানে স্মরণযোগ্য। তিনি মনে করেন, ‘আমাদের দেশীয় সাহিত্যে সাধারণত যে সকল কাব্যগ্রন্থ দেখিতে পাওয়া যায়, তাহার অধিকাংশই প্রেমের কথা লইয়া। প্রেমের বৈচিত্র্য, তরঙ্গভঙ্গ এ দেশের কবিরা যেমন সুন্দররূপে বুঝিয়াছিলেন, পাশ্চাত্য কবিরা বোধ করি সেরূপ বুঝিতে পারেননি। আমাদের কাব্যের বিরহ, অভিসার, মানাভিমান ব্যাপার পাশ্চাত্য কাব্যে কোথায়? পাশ্চাত্য দেশে কি প্রণয়বন্ধনের মধ্যে বিরহ দেখা দেয় না?’ বলেন্দ্রনাথ ঠাকুরের এমন প্রশ্নের উত্তরে পাঠককে কেবল আমাদের ভাববাদী ও প্রাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী সভ্যতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া যায়। আমাদের পরিবেশ ও প্রকৃতিও এর জন্যে কম প্রভাবক নয়। বাংলা সাহিত্য রবীন্দ্রনাথের অবদান অবিস্মরণীয়। কবিতায় প্রেমের উপস্থাপন কিভাবে হয়েছে তার শুরু কবিগুরুর মাধ্যমে হতে পারে। রবীন্দ্রনাথ হচ্ছেন সেই প্রেমিকটি, যিনি দেহজ বাসনা থেকে প্রেমকে মুক্তি দিয়েছেন। স্পর্শে তার প্রেমকে ছোঁয়া যায় না। তার প্রেমের স্বরূপ বিভিন্ন কাব্যের বহু কবিতায় উপস্থাপিত হয়েছে। এ আলোচনায় আমরা মাত্র বিশেষ একটি কবিতার দিকে দৃষ্টি দেব। মানসী কাব্যের ‘নিষ্ফল কামনা’ কবিতাটি কবির প্রেম সংক্রান্ত ধারণাকে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করে। এ কবিতায় কবির উপলব্ধিÑ ‘সুতীক্ষè বাসনা-ছুরি দিয়ে তুমি তাহা চাও ছিঁড়ে নিতে? লও তার মধুর সৌরভ দেখো তার সৌন্দর্য-বিকাশ, মধু তার করো তুমি পান, ভালোবাসো, প্রেমে হও বলী চেয়ো না তাহারে। আকাক্সক্ষার ধন নহে আত্মা মানবের শান্ত সন্ধ্যা, স্তব্ধ কোলাহল। নিবাও বাসনাবহ্নি নয়নের নীরে, চলো ধীরে ঘরে ফিরে যাই।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভালবেসে প্রেমে বলি হতে বলেছেন, কামনা-বাসনাকে নিভিয়ে ফেলতে বলেছেন-কারণ নারী আকাক্সক্ষার ধন নয়। কাজী নজরুল ইসলাম ব্যক্তিগত জীবনে প্রেমিক পুরুষ ছিলেন, কবিতায়ও। তিনি বিদ্রোহী হয়েও তার বিজয় কেতন লুটায় ‘প্রিয়ার চরণ তলে এসে।’ বিরহও তার কবিতায় সমানভাবে উপস্থিত। ‘চক্রবাক’ কাব্যের কথা এখানে উল্লেখ্য। জীবনানন্দ দাশ নিমগ্ন প্রাণ। প্রকৃতিও মিথের মিশেলে তার প্রেম কোমল ও অপূর্ব। প্রেমিকা অন্যকোলে যুবকের সঙ্গে কথা বলবে, এমনটি কোন প্রেমিকের কাম্য নয়। জীবনানন্দের কবিতায় এমন উপস্থাপন রয়েছে চমৎকারভাবে। তার প্রেমিকস্বর- ‘সুরঞ্জনা, অইখানে যেয়ো নাকে তুমি বোলো নাকো কথা অই যুবকের সঙ্গে ফিরে এসো সুরঞ্জনা নক্ষত্রের রূপালী আগুনভরা রাতে; ................. কী কথা তাহার সঙ্গে? তার সঙ্গে!’ -আকাশলীনা। অন্যদিকে জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ পাঠকদের কাছে অমৃততুল্য কবিতা হিসেবে বহু আগেই বিবেচিত হয়েছে। আল-মাহমুদের প্রেম দেহজ যেমন, তেমনি ভাবগত দিয়েও গভীর। সোনালি কাবিনসহ বিভিন্ন কাব্যে তার প্রেমের রূপয়ান ঘটেছে। তিনি প্রাচীন প্রেমের গল্পগুলোকেও কবিতায় তুলে ধরেছেন। ‘বিপাশার চোখ’ কবিতাটি বিশেষভাবে স্মরণীয়। দেহজ প্রেমের উদাহরণ হিসেবে সোনালি কাবিনের প্রথম সনেটটি একাংশ পাঠ করা যাক- ‘ভালোবাসা দাও যদি আমি দেব আমার চুম্বন, ছলনা জানি না বলে আর কোন ব্যবসা শিখিনি; দেহ দিলে দেহ পাবে, দেহের অধিক মূলধন? আমার তো নেই সখী, যেই পণ্যে অলঙ্কার কিনি। বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল পৌরুষ আবৃত করে জলপাইর পাতাও থাকবে না।’ নির্মলেন্দু গুণ প্রেমের কবি হিসেবে পাঠকমহলে সমাদৃত আছেন। তার কবিতায় প্রেম বিরহ, আকাক্সক্ষা ও বেদনা একই সঙ্গে বেজে চলে। প্রেমিকার উদ্দেশ্যে তার পঙ্ক্তিমালকেÑ‘হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে/মন বাড়িয়ে ছুঁই,/দুইকে আমি এক করি না/এক কে করি দুই।’ হেলাল হাফিজ প্রেম ও দ্রোহের কবি। অন্যসব প্রেমিকের মতো কবির আকাক্সক্ষা তিনি প্রেয়সীকে পাবেন। এজন্যে যদি পথও হতে হয় তাও পরম আরাধ্য । প্রিয়ার প্রতি তার নিবেদন : ‘যদি যেতে চাও, যাও/আমি পথ হবো চরণের তলে/না ছুঁয়ে তোমাকে ছোঁব/ ফেরাবো না, পোড়াবোই হিমেল অনলে।’ ক্ষণজন্মা কবি আবুল হাসান প্রেয়সীকে ভালবাসেন বলেই তিনি ভালবাসার কবিতা লিখেননি। যদিও কবিতার মাধ্যমেই সেটা তিনি জানিয়েছেন। তার ভালবাসার কবিতা : ‘তোমাকে ভালবাসি তাই ভালবাসার কবিতা লিখিনি।/আমার ভালবাসা ছাড়া আর কোন কবিতা সফল হয়নি,/আমার এক ফোঁটা হাহাকার থেকে এক লক্ষ কোটি/ ভালবাসার কবিতার জন্ম হয়েছে।’ অন্যান্য কবির চেয়ে রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর প্রেমসত্তা উজ্জ্বল। তাইত তার হাত বাড়ালেই মুঠো ভরে যায় প্রেমে। যদিও তার প্রেম জীবন ও যুগযন্ত্রণা নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয় : ‘হাত বাড়ালেই মুঠো ভরে যায় প্রেমে/অথচ আমার ব্যাপক বিরহভূমি/ছুটে যেতে চাই পথ যায় পায়ে থেমে/ ঢেকে দাও চোখ আঙ্গুলের নখে তুমি।’ বাংলা কবিতায় এমন শতাধিক কবিতা পাওয়া যায়, যেগুলো প্রেমে নিবিড়, সৌকর্যে আলোকিত এবং নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। ছয়. বাংলা ছোটগল্পে প্রেমের উপস্থাপন খুঁজতে গেলে যে গল্পটি আমাকে বিশেষ আলোড়িত করে সেটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’। অন্ত্যজ জীবনের প্রেম, আদিম কামনা এবং ভাল লাগার মানুষটিকে পাবার জন্যে খুন করাÑইত্যাদি ঘটনার কারণে এটি ব্যতিক্রম। গল্পের চরিত্র ডাকাত ভিখু শেষ পর্যন্ত ভিক্ষুক বনে যায়। ভিক্ষুক জীবনে সে হাটের ভিখারিণী পাঁচীকে ভালবাসে। পাঁচীর হাঁটু হতে পায়ের পাতা পর্যন্ত ঘা। তবু উদভ্রান্ত জীবনে যে ভিখারিণীকে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু ভিখারিণী রাজি হয় না। কারণ, সে বসিরকে ভালবাসে। ভিখু পাঁচীকে পাবার জন্যে শেষ পর্যন্ত বসিরকে হত্যা করে এবং পাঁচীকে নিয়ে পালিয়ে যায়। অন্ত্যজ জীবনের প্রেম এভাবে খুব কম সাহিত্যিকই বিধৃত করতে পেরেছেন। অন্ত্যজ জীবনের প্রেমের কথা আসতেই তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তারিণী মাঝি’ গল্পটি সামনে চলে আসে। অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্যধারক এ গল্পটি জীবনের গভীরতর বোধকে তুলে আনে। তারিণী মাঝি তার স্ত্রী সুখীকে ভালবাসে। কিন্তু বানের পানিতে তলিয়ে যেতে যেতে সুখী যখন তারিণী মাঝির গলা আঁকড়ে ধরে-তখন তারিণী নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্যে সুখীর গলা চেপে ধরে। সুখী মারা গেলে পানির ওপরে তারিণী মাঝি ভেসে উঠে আর তার মনে হয়, বেঁচে থাকার আনন্দ সে উপভোগ করছে। গল্পকার এখানে দেখাতে চেয়েছেনÑনিজের অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়লে মানুষ নিজের প্রিয় কোন বস্তুকেও সরিয়ে ফেলতে পারে। তারিণীও তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রীকে হত্যা করেছে নিজের বাঁচার প্রয়োজনেই। তীব্র বাস্তবতা আমরা প্রেমেন্দ্র মিত্র, সৈয়দ ওয়ালীউল্ল্যাহর গল্পেও পাই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ছোটগল্পকে ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তার একরাত্রী, সমাপ্তি, কঙ্কালসহ আরও বেশ কিছু ছোটগল্প পাঠকহৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালীনও নার-নারীর প্রেমের প্রসঙ্গগুলো গল্পের এসেছে বহুবার। শামসুদ্দীন আবুল কালাম, সৈয়দ শামসুল হক, রাবেয়া খাতুন, সেলিনা হোসেন প্রমুখের নাম এখানে উল্লেখযোগ্য। হাসান আজিজুল হকের গল্পগুলোতে প্রেম ‘উপলক্ষ’ হয়ে এসেছে। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, হরিশংকর জলদাসের প্রেমের গল্পগুলোও ব্যতিক্রম। নাগরিক যন্ত্রণা তাদের গল্পে সাবলীলভাবে উপস্থিত। প্রেমের উপস্থাপনে বাংলা ছোটগল্পের বিশ্লেষণ করলে সহজে এতে দুটি ধারা লক্ষণীয় হয়। প্রথমত, অন্ত্যজ জীবনের প্রেম, পথপরিক্রমা, বিস্তৃতি; অন্যটি মধ্যবিত্ত ও নাগরিক প্রেম, যেটি যুগযন্ত্রণা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। অনেক গল্প প্রেমকে লক্ষ্য করে লিখা হয়েছে, অনেক গল্পে প্রেম এসেছে উপলক্ষ হিসেবে। যেভাবেই আসুক, সেটি এসেছে ভিন্ন ভিন্নভাবে, ভিন্ন ভিন্ন গল্প নিয়ে। সাত. বাংলা নাট্যসাহিত্যেও প্রেমের সরব উপস্থিতি রয়েছে। বিশেষত মানবজীবনে প্রেম এমন একটি অনুষঙ্গ, যাকে বাদ দিয়ে জীবন চলে। তবে এটা ঠিক আমাদের নাট্য সাহিত্যে প্রেমপ্রধান নাটক খুব বেশি নেই। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকটি প্রেম ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিয়ে রচিত। এ নাটকে প্রেমের উপস্থিতি প্রবল, সেটা দ্বিমুখীও বটে। যদিও কৃষ্ণকুমারীকে ঘিরে প্রেমের আবর্তন, তবুও ক্ষমতা রক্ষা এখানে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ কারণেই কৃষ্ণকুমারীকে শেষ পর্যন্ত আত্মহনন করতে হয়। উল্লেখ্য যে, কৃষ্ণকুমারীর আত্মহনন প্রেমের জন্যে নয়, সামাজ্য বাঁচানোর জন্যে! মুনীর চৌধুরীর দুটি নাটক ‘চিঠি’ ও ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ এখানে আলোকপাতযোগ্য। ‘চিঠি’ নাটকটি তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেক্ষাপটে লিখিত হলেও এখানে প্রেম কাহিনীর কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। নাটকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ঘটনায় প্রথমাবস্থায় মিনা মিনহাজ ও সোহরাব পরস্পরবিরোধী হলেও শেষ পর্যন্ত দুজন দুজনকেই ভালবেসে ফেলে। তাদের মিলন হয় নাটকীয়ভাবে। মিনা সোহরাবকে না পেলে আত্মহত্যা করবে। সে নিজের রুমের দরোজা বন্ধ করে রাখে। খবর শুনে সোহরাব ছুটে আসে। তখন মিনাকে পাওয়ার জন্যে তার তীব্র আকুলতা পাঠকের দৃষ্টি এড়াতে পারে না : ‘মীনা! সাড়া দাও! বেরিয়ে এস। রুদ্ধ দুয়ার খুলে বেরিয়ে এস।... শাস্তি দাও, অপমান কর, উপহার দাও, প্রহার করÑতবু বেরিয়ে এস। ...এই রুদ্ধ দুয়ার আমি ভেঙ্গে ফেলব। ঘরে প্রবেশ করে যদি দেখি তোমার অঙ্গ প্রাণহীন, তাকেই গ্রহণ করব। একই অস্ত্রে নিজের দেহ তোমার পাশে স্থাপন করব। কিন্তু তবু তোমার কাছে আসব। আসবই আসব। আসব।’ সোহরাবের তীব্র আকুতিতে মিনা দ্বার খোলে, সিক্ত হয় প্রেমের সুধায়। মুনীর চৌধুরীর ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ চিঠি নাটকটি থেকে শিল্পমানে গুরুত্বপূর্ণ। রক্তাক্ত প্রান্তরের জোহরা ও ইব্রাহিম কার্দির প্রেমের কথা এ প্রবন্ধে গুরুত্বসহকারে স্মরণ করছি। আমাদের আরেকজন প্রভাবশালী নাট্যকার উৎপল দত্ত। তার ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকে প্রেমকে ফ্রেমবন্দী করেছেন ভিন্ন গল্পে। দি গ্রেট বেঙ্গল অপেরার অভিনেত্রী ময়না প্রিয়নাথকে ভালবাসলেও পরিবেশ পরিস্থিতিতে সে বীরসিংহের রক্ষিতা বনে যায়। তবু সে প্রিয়নাথকে ভালবাসে। এজন্যে যে তাকে কম গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছেÑএমনটিও নয়। মাতৃতুল্য বসুন্ধরার কাছে ময়নার সহজ স্বীকারোক্তি : ‘ঐ শয়তান বীরকেষ্ট তোমাদের মেয়েকে মারে, জানো? প্রিয়নাথের নাম করেই মারে! তাই আমিও চব্বিশ ঘণ্টা প্রিয়নাথ বাবুর নাম করি। (হাসে) মার খেয়ে গা জুড়ায়’। নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের উজ্জ্বল নাট্যসৃষ্টি ‘কীর্তনখোলা’। বৈশ্বিক দৃষ্টিসম্পন্ন এ নাটকে প্রেম অনুষঙ্গকে প্রাণ দিয়েছে ডালিমন ও সোনাই চরিত্র দুটি। একজন অপেরা দলের কর্মীর সঙ্গে দিনমজুর সোনাইয়ের সংঘাতময় প্রণয়Ñনাটকটিকে চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছে। বাংলা সাহিত্যে প্রেমকেন্দ্রিক নাটক বেশি হয়ে উঠেনি। কারণ, বহু আগে থেকেই নাটক হয়ে উঠেছে অন্যায়ের প্রতি প্রতিবাদের হাতিয়ার। প্রতিবাদের প্রয়োজনে বাংলা নাটকে প্রেমের উপস্থিতি সরব ও সংগ্রামমুখর। আট. সম্প্রতি কালি কলমে প্রকাশিত ‘সাহিত্যের চাহিদা’ প্রবন্ধে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ‘বাংলা সাহিত্য মেয়েলী ধরনের।’ এছাড়া এই উপমহাদেশের মানুষ ভাববাদী প্রবণতা নিয়ে বেড়ে উঠেছে। এ কারণেই বাংলা সাহিত্যে যতটা প্রেমের অনুষঙ্গ বিচিত্রভাবে ও রঙে উপস্থিত হয়েছে, সেভাবে প্রাশ্চাত্যে উপস্থিত হতে পারে নি। গল্প, কবিতা, উপন্যাসে নর-নারীর প্রেমের শত রঙে পাঠক যেমন রঞ্জিত হয়েছে, তেমনি সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলা সাহিত্যেও।
×