ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

নজরুলের বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৩:৩০, ২৬ মে ২০১৭

নজরুলের বাংলাদেশ

১৮৯৯ সালে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম। একই সালে জন্ম নেন বাংলা সাহিত্যের আর এক দিকপাল জীবনানন্দ দাশ। একজন বাংলার রাঢ় অঞ্চল বর্ধমানের চুরুলিয়া গ্রামে। অন্যজন নদীস্নাত রূপসী বাংলার বরিশাল জেলায়। যার ছাপ দুই কবিরই কাব্য মহিমা এবং সচেতন মননে। নজরুল তাড়িত হন রাঢ় অঞ্চলের নানা টানাপোড়েনের এক বিদগ্ধ অনুভবে। যা তাঁর জীবনাচরণ, সৃষ্টিশীল উদ্যম এবং চিন্তাশীলতায় সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখে। তার ওপর আছে সমকালীন সমাজের উত্তপ্ত রাজনৈতিক আবহ, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিচিত্র ধারার উন্মাদনা, সব থেকে বেশি করে আছে সৃষ্টিশীল রবীন্দ্রপ্রতিভার সুবিশাল এক সমৃদ্ধ বলয়। ফলে সাহিত্যিক আঙ্গিনায়ও চলে এক যুগান্তকারী সময়ের উত্তরণ পর্ব। প্রায় অর্ধশত বছর রাজত্ব করা রবীন্দ্র সৃজন ক্ষমতার সুবর্ণকালের অভিযাত্রায় নজরুলের শৈশব, কৈশোর অতিক্রান্ত হয়ে যৌবনের উদ্দীপ্ত শিখরে সদর্প পদার্পণ। অতি সাধারণ ঘরে জন্ম নেয়া নজরুলের সংগ্রামী জীবনের বৈতরণী পার হয় হরেক রকম ঘাত-প্রতিঘাতের এক বিধ্বস্ত প্রতিবেশে। সঙ্গত কারণে নজরুল বেড়ে উঠেছেন ভাসমান স্রোতের পালহীন নৌকার বিপন্ন যাত্রীর মতো। বর্ধমানের চুরুলিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে নজরুলের গড়ে ওঠাটা ছিল এক বিস্ময়কর বালকের প্রতিদিনের কর্মপ্রবাহে নিয়মিত প্রতিকূল অবস্থার ঘূর্ণাবর্ত। অল্প বয়সে পিতৃহীন কবি মাতৃস্নেহ থেকেও প্রায়ই বঞ্চিত। মাতা জাহেদা খাতুনের সঙ্গে তেমন কোন স্নেহাতিশয্যের বন্ধনের গাঢ়তা ছিল না। এর প্রমাণ মেলে তাঁর মাতৃবন্দনার নানা সৃষ্টিকর্মের মূর্ত প্রকাশের মধ্যে। ছন্নছাড়া জীবনে মায়ের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়া কবি অন্যত্র মায়ের অভাব পূরণে নিমগ্ন থাকেন। মা বিরজাসুন্দরী কিংবা মিসেস এম রহমানকে নিবেদিত কবিতার সুমধুর ঝঙ্কার ধ্বনিত হয় কবির মাতৃপূজার অনুপম অভিব্যক্তি। বাউন্ডেলের জীবন শুরু পারিবারিক বন্ধনের শৈথিল্যের নির্মম কষাঘাতে। মাথার ওপর ছাদ কিংবা অভিভাবকের ছায়া না পেয়েও তিনি তৈরি হয়েছেন নিজের মতো করে। অনিয়মিত স্কুলে যাওয়া থেকে শুরু করে পাচকের দায়ভার নেয়া, নিত্য কিছু টুকিটাকি কর্মযোগে নিজেকে ভাসিয়ে দেয়া, এমনকি রুটি বেলা থেকে অনেক কিছুই করতে হয়েছে। কখনও নিজের জেলার চৌহদ্দির মধ্যে, কখনওবা অন্যত্র। এমনই বৈচিত্রিক অভিযাত্রায় ঘটে যায় জীবনের আরও একটি মহাযোগ। ১৯১৪ সালে শুরু হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামার হুঙ্কার এসে লাগে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের নিজস্ব সীমানায়। ফলে ১৯১৭ সালে ১৮ বছর বয়সে লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে যোগ দেন যুদ্ধের কারণে তৈরি হওয়া ‘বেঙ্গল রেজিমেন্টে’। ১৯১৮ সালে যুদ্ধে বেসামাল পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসা অত্যন্ত কঠিন এক ব্যাপার ছিল। ১৯২০ সালের আগ পর্যন্ত করাচীর সেনানিবাস থেকে ফিরে আসা সম্ভবই হয়নি। আর এই যুদ্ধের রেশ চলতে থাকে উদীয়মান সৃজনশীল দ্যোতনায় নিমগ্ন কবি-সাহিত্যিকদের। নজরুলও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। মাত্র এক বছরের মাথায় ১৯২১ সালে লিখেই ফেললেন ‘বিদ্রোহী’র মতো বলিষ্ঠ, উদ্দীপ্ত এবং সারাদেশ তোলপাড় করে দেয়া কবিতা। যা আজ অবধি বাংলা সাহিত্যে লড়াকু এবং বৈপ্লবিক আবেদনের এক অতুলনীয় কবিতা সম্পদ। সেই শুরু, তারপর আর কোনদিকে ফিরে তাকানোর অবকাশ পাননি। শুধু কি বাংলা সাহিত্যে? বিশ্বসাহিত্যেও ‘বিদ্রোহী’ কবিতা আপন মর্যাদায় স্বীকৃতি পায়। এই কবিতায় যা বললেন সেটাই পরবর্তী ২০ বছরের সাহিত্যিক জীবনে যুগান্তকারী অবদান রাখে। মানুষ আর মানবতার যে বাণী কবিতাটির প্রতিটি লাইনে সেটাকেই জীবনভর নানামাত্রিক নতুন আবহে, সৃষ্টিশীল মহিমায় ভরিয়ে তুলেছেন। দীপ্ত কণ্ঠে, কঠিন বয়ানে, বিপ্লবের রক্তিম ধ্বজায় সমস্ত অন্যায়-অবিচারকে নিশ্চিহ্ন করে সত্য, সুন্দর এবং ন্যায়ের বাণী ব্রজের হুঙ্কারে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত করেছেন। মানুষ এবং মনুষ্যত্বের অপমান কখনও মেনে নেননি। অত্যাচার, অবিচারের বিরুদ্ধে যেমন খ—গহস্ত হয়েছেন একইভাবে মানবতার জয়গানে অন্তর নিঃসৃত মমতায় নিজেকে সিক্তও করেছেন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় সেই বাণী- আমি ইন্দ্রানীর সৃত, হাতে চাঁদ ভালে সূর্য মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতূর্য। বাংলা সাহিত্যের আঙ্গিনায় চলছে তখন রবীন্দ্র সৃজন শক্তির একাধিপত্য। শুধু সে সময়ের কর্ণধারই রবীন্দ্রনাথ নন, তাকে অতিক্রম করে সে বলয় থেকে বেরিয়ে আসা ও সমকালীন সৃষ্টিশীলদের আয়ত্তের বাইরে। ইতোমধ্যে শুরু হয়ে যায় ৩০-এর দশকে কল্লোলযুগের স্রষ্টাদের রবীন্দ্রনাথকে পাশ কাটানো। আপন সংস্কৃতির বেড়াজালে তা সম্ভব নয় এই বোধে তাঁরা পাশ্চাত্য মনন চর্চায় নিজেদের নিমগ্ন করলেন। আর নজরুল যা করলেন তা যেমন বিস্ময়কর তেমনি প্রতিভাভাস্বর মননের উদ্দীপ্ত কিরণ। রবীন্দ্রভক্ত নজরুল রবীন্দ্র বলয়েই নিজেকে সমর্পণ করলেন, নিজস্ব সংস্কৃতিকে হাতড়ে বেড়ালেন, বাংলা ও বাঙালীর চিরায়ত ঐতিহ্য সমৃদ্ধ ধারায় তাঁর সৃজন ক্ষমতাকে নিবেদন করলেন। রবীন্দ্র অনুরাগী নজরুল রবীন্দ্র সৃষ্টিযজ্ঞে ডুবে থাকলেন। কিন্তু যখন লিখলেন, সৃষ্টি করলেন, সুর দিলেন কোথাও কোন রবীন্দ্র ছাপ নেই। এখানেই তাঁর অসাধারণত্ব, ব্যতিক্রমী আর ব্যক্তিক সৃষ্টি ক্ষমতা। সৃষ্টির আনন্দ আর উন্মাদনায় তাঁর সেই কবিতার মতো ‘আজি সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ এতই বিভোর থাকতেন যে, কতখানি ক্ষমতা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন সেটুকু ভাবার অবকাশও কোনদিন পাননি। আর তাই নিজের মতো করে সাহিত্যের যে পথ তৈরি করলেন, সঙ্গীতের ভুবনে গানের যে নতুনমাত্রা যোগ করলেন সেখানে আজও তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। রাগ-রাগিণীর সূক্ষ্ম কারুকাজ আর ঝঙ্কারে নজরুলের গানেরও কোন তুলনা হয় না। আপন বৈশিষ্ট্যে উন্নত মস্তকে নিজেকে শুধু দাঁড়ই করালেন না, মানবতার জয়গান গেয়ে সৃষ্টি ভা-ারও পূর্ণ করলেন। জাতি, ধর্ম আর বর্ণের করাল নিষ্পেশনে পিষ্ট সমগ্র দেশকে জাগানোর লক্ষ্যে শক্ত লেখনীর দাগ কাটলেন। মানুষের অসাম্য-বৈষম্যকে তীক্ষè বাক্যবাণে বিদ্ধ করলেন ‘মানুষ’ কবিতায়- গাহি সাম্যের গান মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান। আপন অন্তরে ঈশ্বর, মানুষের মাঝে সৃষ্টিকর্তা এই অনুভবে নজরুল প্রতিনিয়তই বিশ্বনিয়ন্তাকে নিজের মধ্যে উপলব্ধি করেছেন। সৃষ্টিকর্তাকে পাওয়ার জন্য কোন জাত-পাত কিংবা ধর্ম আর বর্ণের বেষ্টনীতে নিজেকে জড়াননি। এই অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূল্য দিতে হয়েছে তাঁকে। ধর্মান্ধরা তাঁকে নিয়ে কটূক্তি করেছেন, তাঁর মানবতার বাণীকে বিভিন্নভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। ধর্মীয় মৌলবাদ, শ্রেণী বিভক্ত সমাজের উচ্চবিত্তের শাসন-শোষণ, জাতবর্ণের বিভাজন, অসাম্য-বৈষম্যের নগ্ন থাবায় উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠিত নজরুলের সরল-সোজা বাণী যেভাবে প্রতিপক্ষকে ক্ষেপিয়ে তোলে তার প্রমাণ বিভিন্ন কবিতায় স্পষ্ট হয়ে আছে। তাঁর বাংলা, সংস্কৃত, আরবী-ফার্সী শব্দচয়ন নিয়েও হরেকরকম বাগ্বিত-ার অবতারণা করা হয়েছে। তবুও দুর্বিনীত, দুর্দমনীয়, অশান্ত নজরুলকে থামানো যায়নি। বীরদর্পে, দৃঢ়চিত্তে, অনমনীয় বোধে সমকালের আবর্জনাকে তোয়াক্কা না করে অতিক্রম করতে তাঁকে মোটেও ভাবতে হয়নি। অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়ানো নজরুল যেখানে গিয়েছেন, সৃষ্টিশীল উদ্যোম সেখানেই তাঁকে তাড়িত করেছে। তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি’ চট্টগ্রামে বসে লেখা, যে কবিতায় তিনি বাকি ৩৪ বছরের অনড়, অচল, স্পন্দনহীন দুঃসহ ব্যথার কথা উচ্চারণ করেন- তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিব না কোলাহল করি সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙিব না। নিশ্চল, নিশ্চুপ আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধ বিধুর ধূপ। কিংবা ‘ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি’ গানটিও কবির অনাগত জীবনের এক বেদনাবিধুর অনুভব। জন্মদিনে ফুলে ফুলে আচ্ছাদিত কবির নীরব, নিথর হয়ে বসে থাকার আগাম বার্তা বৈকি! স্বাধীনচেতা, অধিকার আদায়ের নির্ভীক সৈনিক নজরুল মাতৃভূমি আর মাতৃভাষাকে সবার ঊর্ধ্বে ভেবেছেন। আবহমান বাংলার মূল শেকড় থেকে তুলে আনা তাঁর সাহিত্যের নানা মাত্রিক উপাদানে পৌরাণিক উপাখ্যানের কাহিনী যেমন নিজস্ব মহিমায় স্থান পেয়েছে, একইভাবে মধ্যযুগের রাধা কৃষ্ণের প্রেম তাঁর সঙ্গীতে ঝঙ্কার তুলেছে। আর লালন বাউল তো তাঁর সুর সাধনার এক বিশিষ্ট সংযোজন। ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবে পাকিস্তান সৃষ্টির যে পাঁয়তারা তাকে মানতে পারেননি নজরুল। পাকিস্তানকে বিকৃত করে ফাঁকিস্তানও বলেছিলেন। ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের তিরোধান বাঙালী জীবন ও কর্মপ্রবাহে যে শূন্যতা, তা আরও মারাত্মক আকার নেয় পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৯৪২ সালে নজরুলের সমস্ত সক্রিয় ক্ষমতা বিলীন হয়ে যাওয়ায়। নিস্তেজ, নির্জীব, অসাড় চৈতন্যের এক নিষ্ক্রিয় অবসাদ পুরো জাতিকে হতভম্ব করে দেয়। ’৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রাম নজরুলের লড়াকু চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়েছে। বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মতো নজরুল সঙ্গীত স্বাধীনতার স্রোতে একাত্ম হয়ে যায়। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে নজরুলকে নিয়ে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। জাতীয় কবির মর্যাদায় তাঁকে অভিষিক্ত করা হয়। ’৭৫-এর পটপরিবর্তন সারা বাংলায় যে দুর্যোগের ঘনঘটা বাঙালীকে স্তব্ধ এবং হতবিহ্বল করে দেয় তার করুণ পরিণতি কি নির্বাক নজরুলকেও তাড়িত করে? কারণ মাত্র এক বছরের মধ্যে অর্থাৎ ১৯৭৬ সালে শান্ত বাকহীন নজরুলের জীবনাবসান হয়। এভাবে এক জীবন্ত কিংবদন্তি তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের ২২টি বছর পার করেন বেপরোয়া উদ্দীপনা আর সৃষ্টির উল্লাসে বিভোর হয়ে। বাকি ৩৪টি বছর কাটে নির্জীব নির্লিপ্ততা আর নিরুদ্বেগ নীরবতায়।
×