ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধান বিচারপতির কোর্ট নিয়ে এ্যাটর্নি জেনারেল

গণশুনানি দরকার

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ২৫ মে ২০১৭

গণশুনানি দরকার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী হাইকোর্টে বাতিলের বিষয়ে আপীল শুনানিতে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে (এসকে সিনহা) উদ্দেশ করে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, ‘আপনার এ আদালতে কি হচ্ছে? একটা গণশুনানি দরকার। বিচার প্রার্থীদের জিজ্ঞেস করুন এখানে কি হচ্ছে?’ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের বিরুদ্ধে সুপ্রীমকোর্ট তদন্তের নির্দেশ দিলেও সে দেশের সংসদ ও রাজনীতিবিদরা মাথা নিচু করে তা মেনে নিয়েছে, প্রধান বিচারপতির এমন মন্তব্যের পর এ্যাটর্নি জেনারেল এসব কথা বলেন। জবাবে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা বলেছেন, ‘আমি বুক ফুলিয়ে বলতে পারি, আমি দায়িত্ব নেয়ার পর বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের যে আস্থা সেটা ৯০ ভাগের ওপরে। বাংলাদেশের যে কোন প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বিচার বিভাগ শত গুণ ভাল।’ প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপীল বিভাগের সাত বিচারপতির আপীল বেঞ্চে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর বিষয়ে বুধবার ষষ্ঠ দিনের শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ ও রিটকারীর পক্ষের আইনজীবী যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেন। পরে এ্যামিকাস কিউরি (আদালতকে আইনী বিষয়ে সহায়তা প্রদানকারী) হিসেবে বক্তব্য উপস্থাপন শুরু করেন প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমীর উল ইসলাম। আদালতের কার্যক্রম শেষে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন সুপ্রীমকোর্ট। প্রধান বিচারপতি ছাড়া বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেনÑ বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার। সংসদে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধন হাইকোর্ট বাতিল করলে তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন ও আইন সভায় উত্তাপ ছড়িয়েছিল। ওই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপীলেও উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় চলে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে এ্যাটর্নি জেনারেলের। বুধবার এ্যাটর্নি জেনারেল ছাড়াও রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা এবং রিটকারীর পক্ষে এ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ আদালতে উপস্থিত ছিলেন। ষষ্ঠদিনের শুনানির শুরুতেই প্রধান বিচারপতি এ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আমরা আপনাকে বেশি প্রশ্ন করব না। কারণ যাই বলি তা মিডিয়াতে চলে যায়।’ বিচারক অপসারণে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার প্রসঙ্গ টেনে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘সংবিধানের বাইরে গিয়ে যদি ব্যাখ্যা করেন, সেটা হবে কষ্টদায়ক। আজ ইংল্যান্ডের কি অবস্থা! আপনি লিখিত যুক্তিতর্কে অনেক কিছুই না জেনে লিখেছেন। যে আপনাকে এ্যাডভাইস করেছে সে জানে না।’ জবাবে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আমাকে কে এ্যাডভাইস করবে?’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এখানে আপনার টিম আছে। আমি আপনাকে অবমূল্যায়ন করছি না। আপনার ১৫৫ জন ল’ অফিসার রয়েছে। তাদের অনেকেই বিদেশে লেখাপড়া করেছেন। এই কারণে এ্যাডভাইসের কথা বলছি।’ এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘বোঝার চেষ্টা করেন। আমরা ঘরে (বাহাত্তরের সংবিধান) ফেরাতে চাই।’ এরপর প্রধান বিচারপতি এ্যাটর্নি জেনারেলকে ইংল্যান্ডের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে লেখা একটি বই দেন। সে বই থেকে এ্যাটর্নি জেনারেল কিছু অংশ পড়ে শোনানোর একপর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনি সাবমিশনে ইংল্যান্ডের অনেক বিষয় এনেছেন। অনেক সাবমিশন দিয়েছেন। তা কি না জেনেই দিয়েছেন? পৃথিবীর একমাত্র সভ্য দেশ ইংল্যান্ড। যে দেশে অলিখিত সংবিধানের ভিত্তিতে নির্বাচন, ক্ষমতা হস্তান্তর হয়ে থাকে। চুল পরিমাণ এদিক-সেদিক হয় না। ব্রেক্সিটে হেরে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। কি চিন্তা-চেতনা, মানসিকতা।’ এ সময় এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আমি আপনার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছি। ইংল্যান্ডকে সভ্য দেশ বলতে পারেন না। কারণ তাদের ইতিহাসই তো লুণ্ঠনের। ইংল্যান্ড বিদেশীদের লুণ্ঠণ করেছে।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘ইংল্যান্ড লুণ্ঠন করেছে, আমেরিকা করে যাচ্ছে। আমি সভ্য দেশ বলতে বুঝিয়েছি, গণতন্ত্র, আইনের শাসন, নাগরিকের মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সে দৃষ্টিকোণ থেকে।’ এ সময় এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘ইংল্যান্ডে ‘রুল অব ল’ বিকাশ ঘটেছে সেটা বলতে পারেন। কিন্তু সভ্য দেশ বলতে পারেন না।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘ওরা নাগরিকদের নিরাপত্তা দিয়েছে।’ জবাবে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘অন্যদের লুণ্ঠন করে নাগরিকদের সুরক্ষা দিয়েছে।’ এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আদি সংবিধানে ফিরে যাবেন? আমেরিকার সংবিধানে তো আছে ‘উই দ্য পিপল’। সেখানে আগে দাসপ্রথা চালু ছিল। এটা মাথায় রেখেই পরবর্তীতে পনের শতকের দিকে পরিবর্তন হয়েছে। এখন ইথিওপিয়া, মরক্কোসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লোক আমেরিকায় ভর করছে। এখন কি তারা আদি সংবিধানে ফিরে যাবে? আপনাকে সূক্ষ্মভাবে প্রশ্ন করছি এর উত্তর দেবেন। এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এখানে তো অদক্ষ ও কতিপয় বিচারকের অসততার বিষয়টি তো দেখতে হবে।’ এ সময় বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা বলেন, ‘তাহলে কি বিচার বিভাগের বিকাশ ঘটবে না? জুডিশিয়াল রিভিউ থাকবে না? তাহলে জুডিশিয়াল রিভিউ উঠিয়ে দেন।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘সংবিধানের এটুজেড আমরা ব্যাখ্যা করব জনগণের অধিকার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আসলে আমরা সারা সংবিধান ব্যাখ্যা করব। জনগণের মৌলিক অধিকার বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর প্রশ্ন যখন আসবে তখন আমরা সংবিধানের এটুজেড দেখবো।’ এ সময় এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এটা ঠিক না। আপনারা যোগ করতে পারেন কেবল।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আইনমন্ত্রী বলেছেন, আমি এত কথা বলি কেন?’ এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আইনমন্ত্রী কি বলেছেন সে বিষয়ে আমি জানি না।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘কথা বললে তো কথার পিঠে কথা আসবেই।’ পরে আবার লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন শুরু করেন এ্যাটর্নি জেনারেল। একপর্যায়ে সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগের প্রসঙ্গ টেনে বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞা বলেন, ‘আপনি যেভাবে বলছেন যে, সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের রেকর্ড পাওয়া গেছে। রায়ে তো সেভাবে নাই।’ এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘কালকে একটি শব্দের ব্যবহারের কারণে গণমাধ্যম আমাকে খলনায়কে পরিণত করেছে। আপনার নিজেরই একটি রায় আছে।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমাদের রায়ের ফাইন্ডিংস কি আছে তা দেখতে হবে। সুপ্রীমকোর্টে যাতে কোন শূন্যতা সৃষ্টি না হয় সেটার কারণেই বলা আছে।’ এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল অবৈধ। যদি সেটা বাতিল করা হতো তবে ওইসময়ের বিচারও বাতিল হতো। ফলে একটা শূন্যতা সৃষ্টি হতো।’ শুনানির একপর্যায়ে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘তৎকালীন টেকনোক্রেট আইনমন্ত্রী যিনি এই আদালতেরই একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী তিনি সুপ্রীমকোর্টের বিচারকদের এক ধরনের সুবিধা দিতেই জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে বাদ দিয়ে পঞ্চদশ সংশোধনী করেছেন।’ এ সময় প্রধান বিচারপতি সাবেক আইনমন্ত্রী সম্পর্কে এ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যে আপত্তি তুলে বলেন, ‘তিনি টেকনোক্রেট মন্ত্রী ছিলেন। বারের নির্বাচিত দুবারের সভাপতি। তিনি অত্যন্ত সজ্জন ও ভদ্রলোক। তার মন্ত্রিত্বকালে বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে মধুর সুসম্পর্ক ছিল। সুপ্রীমকোর্টকে আন্ডারমাইন করবেন না। টেকনোক্রেট মন্ত্রীদের নিয়ে এত কথা বলছেন? তাহলে কেন এ প্রথা রেখেছেন, কেন বাতিল করেননি? একটি শব্দ ব্যবহারের পূর্বে বুঝেশুনে করবেন। ইট মারলে পাটকেল পরবে, এটা মনে রাখবেন।’ প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, ‘যার কথা বলেছেন, তার যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠনে অবদান রয়েছে। তাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।’ এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টি রাজনৈতিক মেনিফেস্টোতে ছিল। এটা প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল। প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকাকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। তিনি না থাকলে এটা হতো না।’ এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এখানে আবার প্রধানমন্ত্রীকে টানছেন কেন? আপনি যদি গণতন্ত্র, আইনের শাসনের কথা বলেন, তাহলে ইংল্যান্ডসহ বিশ্বের সভ্য দেশগুলোর দিকে তাকান।’ প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, ‘ভারতের বিচারক নিয়োগের কলেজিয়াম প্রথা বাতিল করে সরকার নতুন আইন করেছিল। সে আইন ভারতের সুপ্রীমকোর্ট বাতিল করে দিয়েছিল। কিন্তু সেটা নিয়ে সংসদ কোন টু শব্দ করেনি। পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে সে দেশের সুপ্রীমকোর্ট। সে দেশের সংসদ ও রাজনীতিবিদরা মাথা নিচু করে তা মেনে নিয়েছে। যে পাকিস্তানে সুবিধাভোগী সরকার থেকেছে বেশিরভাগ সময়। সেই দেশেই সুপ্রীমকোর্ট কি রকম ভূমিকা তা দেখুন। কিন্তু আমাদের দেশে কি হয় তা দেখুন। এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনার এ আদালতে কি হচ্ছে? একটা গণশুনানি দরকার।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘কাদের নিয়ে?’ এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘কেন, বিচার প্রার্থীদের নিয়ে। তাদের জিজ্ঞেস করুন এখানে কি হচ্ছে?’ এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আগে কি ছিল জানি না। কিন্তু আমি বুক ফুলিয়ে বলতে পারি, আমি দায়িত্ব নেয়ার পর বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের যে আস্থা সেটা ৯০ ভাগের ওপরে। আমি কয়েক দিন আগে বাঁশখালী চৌকি আদালতে গিয়েছিলাম। সেখানে যে সংখ্যক বিচার প্রার্থী ভিড় করেছে তা অবাক করার মতো। আমি দৃঢ়ভাবে বলতে পারি বাংলাদেশের যে কোন প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বিচার বিভাগ শতগুণ ভাল। এ সময় এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আমি আপনার সব কথার সঙ্গে একমত পোষণ করতে পারছি না।’ এ সময় বিচারপতি ওয়াহহাব মিঞা বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে প্রধান বিচারপতির কাছে দিতে পারতেন। এখন পর্যন্ত কি কোন অভিযোগ দিয়েছেন?’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনি একমত পোষণ করতে পারবেন না, এটাই স্বাভাবিক। এ আদালতে বিচারকের সংখ্যা বাড়ানো দরকার।’ এ সময় এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আপনার সঙ্গে একমত।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমি দক্ষ, যোগ্য বিচারক এখানে নিয়োগ দিতে চেয়েছিলাম। যে কারণে গত দেড় বছরে কোন বিচারক নিয়োগ হয়নি। আপনারা যা চাচ্ছেন সেটি হলে তো এরকম হবেই।’ এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আমরা মূল সংবিধানে ফিরে যেতে চাই। এটি (সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান) সাংবিধানিক ইতিহাসে লজ্জা। আমেরিকা ভারতে মার্শাল ল হয়নি। আমাদের এখানে হয়েছে। মার্শাল ল এর মাধ্যমে যতখানি হয়েছে ততখানি বাদ দিতে চাই। বিগত সময়ে পারিনি।’ এর কিছুক্ষণ পরে এ্যাটর্নি জেনারেল বক্তব্য উপস্থাপন শেষ করলে হাইকোর্টে রিটকারীদের পক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ তার বক্তব্য উপস্থাপন শুরু করেন। মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘আমি হাইকোর্টে শুনানিতে সবকিছু বলেছিলাম। কিন্তু আপীলকারী এখানে এসে বলেছে, হাইকোর্টে রায়ে বিচারপতিরা নিজেরাই সব বলে দিয়েছে, আপিলকারীর এ বক্তব্য ঠিক না। এ কারণে এর জবাব না দিলে একই ঘটনা ঘটতে পারে। রায়ের পর এ্যাটর্নি বলবেন বিচারকরাই এ কথা বলে দিয়েছে।’ মনজিল আরও বলেন, ‘৭২ এর সংবিধানের ব্যাপারে যে সাবশিন রাখা হয়েছে সেটা ভুল ব্যাখ্যা। একটি সদ্য স্বাধীন দেশে যে সংবিধান তৈরি করা হয়েছিল, সে সময় কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না বলে এবারের দুইজন (ওই সময়ের মন্ত্রিসভার দুইজন সদস্য) সদস্য বলেছেন। তখন করা সংবিধানে বিচারকদের অপসারণের বিষয়টি সংসদের হাতে দেয়া হয়েছিল। এরপর অভিজ্ঞতা অর্জনের পর ১৯৭৪ সালে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু নিজেই অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাত থেকে ফিরিয়ে নেন।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনি কি ১১৬ অনুচ্ছেদের কথা বলছেন?’ মনজিল মোরসেদ বলেন ‘না, আমি ৯৬ অনুচ্ছেদের কথা বলছি। আমরা যে সংবিধানের কথা বলি, ১৯৭২ সালের সংবিধান, এটা বঙ্গবন্ধুর সংবিধান। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হাতে করা সংবিধার তিনি নিজেই চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে পরিবর্তন করেছেন। বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকা উচিত নয় সেটা বঙ্গবন্ধুরই সিদ্ধান্ত। যার নেতৃত্বে দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে সেই জাতির পিতাই অভিজ্ঞতার আলোকে সংবিধান সংশোধন করেছেন।’ শুনানিতে মনজিল আরও বলেন, ‘এ্যাটর্নি জেনারেল পঞ্চদশ সংশোধনীতে বিচারক অপসারণের বিষয়টি তাড়াহুড়া করার কারণেই বাদ পড়েছে, তার এই বক্তব্যও ঠিক না। এর প্রমাণ মিলবে পঞ্চদশ সংশোধনী করার আগে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি করা হয়েছিল। ওই কমিটি দেড় বছর ধরে সবার সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা শেষে সংশোধন এনছিল। ওই সংশোধনীর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজেই বক্তব্য দিয়েছেন। তখনও সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বাতিলের প্রস্তাব ছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সেই প্রস্তাব নাকচ করে দেন। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিচার বিভাগ স্বাধীন। বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ করা যাবে না। এ ছিল পঞ্চদশ সংশোধনীর প্রেক্ষাপট। এ থেকে প্রমাণ হয়, তারা জেনেশুনে বুঝেশুনেই পঞ্চদশ সংশোধনীতে সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান যুক্ত করেনি। মনজিল আরও বলেন, ‘ষোড়শ সংশোধনীর একটি প্রেক্ষাপট আছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর পরপরই দেশে বেশকিছু ঘটনা ঘটেছে। আদালত অবমাননার আইন করা হলো। অনেক সচিবকে আদালতে ডেকে পাঠানো হচ্ছে। এর মধ্যে আদালত অবমাননার আইন সংশোধন করে বলা হলো সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ডাকা যাবে না। এর অর্থ হলো, এর ফলে তাদের মধ্যে আদালতের রায় না মানার সুযোগ করে দেয়া হয়। এরপর আমরা আদালত অবমাননার আইনটির বৈধতা চ্যলেঞ্জ করলে আদালত ওই আইনই বাতিল করে দেয়। এরপর দুদক আইন সংশোধন করা হয়। যেখানে বলা হয়, সরকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সরকারের অনুমোদন ছাড়া অভিযোগ করা যাবে না। চ্যালেঞ্জ করা হলে আদালত এ ধারাটিও বাতিল করে দেয়। এরপর নারায়ণগঞ্জে মর্মান্তিক সাত খুনের ঘটনা ঘটে। হাইকোর্ট আদেশ দিল এরপর পরপরই সংসদে আলোচনা ওঠে, বিচারপতিদের নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করা হলো। সংসদে কেউ কেউ বললেন, আমরাই বিচারপতিদের নিয়োগ দিয়েছি তাদের অপসারণের বিষয়টি আমরাই সংসদে নিয়ে আসব। সচিবদের ডাকা, সাংসদদের জামিন না দেয়া এসব ধারণা থেকেই বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদে ফিরিয়ে আনার হুমকি দিল। এরপর প্রধানমন্ত্রীকে ভুল বুঝিয়ে ষোড়শ সংশোধনী আনা হলো। বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে নেয়া হলো।’ শুনানির শেষ পর্যায়ে মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘স্বাধীন বিচার বিভাগ আমাদের সংবিধানের মৌলিক কাঠামোরই অংশ। এটাতে হাত দেয়া যাবে না। কিন্তু ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে এতে আঘাত করা হয়েছে। অসৎ উদ্দেশে কোন আইন করা হলে সেটা বাতিল করতে পারে সুপ্রীমকোর্ট।’ এরপর এ্যামিকাস কিউরি হিসেবে আদালতে বক্তব্য উপস্থাপন শুরু করেন প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমীর উল ইসলাম। শুনানির প্রথম দিনে তিনি ’৭২ এর সংবিধানের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতেই ছিল। বঙ্গবন্ধুর সময় চতুর্থ সংশোধনী হলে তা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয়। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে ন্যস্ত হয়। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী পরে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে বাতিল হয়। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে আনা হয়। এর বিরুদ্ধে কয়েকজন আইনজীবী আদালতে গেলে গত বছরের ৫ মে হাইকোর্টের দেয়া রায়ে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে হাইকোর্টে ওই রায় আসে। হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করে রাষ্ট্রপক্ষ। গত ৮ মে পেপার বুক থেকে রায় পড়ার মাধ্যমে এ মামলার আপীল শুনানি শুরু হয়। ৯ মে দ্বিতীয়দিনের মতো শুনানি হয়। এ দুদিন রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা হাইকোর্টের রায় আদালতে পড়ে শোনান। এরপর ওইদিনই আদালতে চারজন এ্যামিকাস কিউরি তাদের লিখিত মতামত জমা দেন। এই চারজন হলেনÑ সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, এমআই ফারুকী ও আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া।
×