ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ব্রজেন্দ্র কুমার দাস

অভিমত ॥ হামিদ মির হতে পারলেন না‘বাপকা ব্যাটা’!

প্রকাশিত: ০৩:২৯, ২৪ মে ২০১৭

অভিমত ॥ হামিদ মির হতে পারলেন না‘বাপকা ব্যাটা’!

একটা খুবই প্রচলিত কথা যে, ‘বাপকা ব্যাটা, সিপাইকা ঘোড়া’। কথাটা বিস্তারিত ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। এর নিগূঢ় অর্থ কারও অজানা থাকার কথা নয়। কিন্তু সর্বাবস্থায় সর্বক্ষেত্রে ‘বাপ-ব্যাটা’ নিয়ে এমনি মন্তব্য বা প্রত্যাশা সঠিক বলে প্রমাণিত হয় না। তবে কখনও কখনও বরং উল্টোটা ঘটতে দেখা যায়। তবে কখনও কখনও যে বাপের ঘোড়ার চেয়ে ব্যাটার ঘোড়ার গতিবেগ আশাতীত বেশি হয় তাও কিন্তু অস্বীকারের কোন উপায় নেই। তবে উল্টোটার প্রাধান্য যুগে যুগে বেশি পরিলক্ষিত হতে দেখা যায়। রাজার ছেলে বাদশার ছেলে রাজা-বাদশা হতে পারেন নিতান্তই সাময়িক সময়ের জন্য। রাজা দশরথের ছেলে শ্রীরাম চন্দ্রকে রাজা হতে হয়েছিল অনেক খড়কুটো পুড়িয়ে। লঙ্কার রাজা রাবণের ছেলে রাজা হতে পারেননি। অকালে ধরাধাম ত্যাগ করতে হয় লঙ্কেশ্বর হওয়ার বাসনা ছেড়ে। আধুনিককালে এসে ক’জন প্রেসিডেন্ট বা রাষ্ট্রপতির ছেলে প্রেসিডেন্ট বা রাষ্ট্রপতি হয়েছেন সে হিসাব বা সে ইতিহাস তো একেবারেই নগণ্য। এ যুগে এসে মাঝির ছেলে রাষ্ট্রপতি, চা বিক্রেতার ব্যাটা প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন শত কোটি মানব সন্তানের দেশে। অন্যদিকে উজিরের ছেলে নাজির হওয়ার সৌভাগ্যও অর্জন করতে পারেননি। তবে এটাও সত্য যে কখনও কখনও ইন্দিরা গান্ধী, শেখ হাসিনা, বেনজীর ভুট্টোর মতো ‘বাপকা বেটি’দের দেখা মেলে ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ছেলে ‘রবীন্দ্রনাথ’ নজরুলের ছেলে নজরুল বা আল্লামা ইকবালের ছেলেকে কখনও কি ইকবাল হতে দেখা যায়। নেলসন ম্যান্ডেলার ছেলে বা মার্টিন লুথার কিংয়ের ছেলেদের কথা আমরা কি কিছু জানি! জানি না। কিন্তু এর পরও মানুষের প্রত্যাশা বাঘের সন্তান বাঘই হোক। সিংহের সন্তান সিংহের চরিত্রেই চরিত্রবান হোক। তবে সিংহের সন্তান ধূর্ত শৃগালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে কারও কিছু করার নেই। যা আছে তা হলো কষ্ট পাওয়া। তেমনি এক মানব সিংহের ঔরসে জন্ম নেয়া এক শৃগাল বা ভেড়ার দুঃখজনক একটি খবর নিয়েই আমার আজকের এই লেখা। সেই সিংহ পুরুষটি হলেন পাকিস্তানের প্রয়াত অধ্যাপক ওয়ারিস মির। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন বাংলাদেশের আক্রান্ত মানুষের বন্ধু হয়ে। সেই মহান সাহসী মানবতাবাদী মানুষটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে কবি ও সাংবাদিক সীমান্ত প্রধান তার নিবন্ধ ‘তিনি একজন কট্টর পাকিস্তানবাদী মানবতাবাদী’-এ লেখেন ‘সে সময় তিনি পাকিস্তান সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাংলাদেশে এসেছিলেন, প্রত্যক্ষ করেছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তা-বলীলা। অবলোকন করেছিলেন তাদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। আর সে সব ভয়াবহ দৃশ্যের বর্ণনা তুলে ধরে বলেছিলেন ‘পাকিস্তান সরকার তাদের সেনাবাহিনী দিয়ে বাংলাদেশে যে তা-ব চালাচ্ছে, তা মানবতার চরম সীমা লঙ্ঘন, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী সে দেশটির নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করছে।’ এ প্রসঙ্গে সীমান্ত প্রধান আরও বলেন, ‘১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে বাস করা যে ক’জন মানুষ বাংলাদেশের পক্ষে বলেছিলেন, গণহত্যা, লুটপাট আর ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন, তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে ছিলেন পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ওয়ারিস মির। বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু এই সাহসী মানুষটি ছিলেন প্রগতিশীল, মুক্তচিন্তার অধিকারী আর উদার মানবতাবাদী। এই বাংলার মাটিতে জন্ম নেয়া কিছু কিছু বিপথগামী যেখানে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বর্বরতার সমর্থনকারী সহযোগী হিসেবে ৯টি মাস কুকর্ম করে পাকবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের অংশীদার হয়েছে সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানে বসবাস করে ভুট্টো টিক্কা ইয়াহিয়ার পশু শক্তিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে বাঙালীর দুর্দশা স্বচক্ষে দেখার জন্য বাংলাদেশে ছুটে এসেছিলেন তিনিই তো বাংলার সেই সাহসী বন্ধু ওয়ারিস মির। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ স্নাত বাংলাদেশের মানুষ অকৃতজ্ঞ জাতির বংশধর নয়। কৃতজ্ঞ জাতির কৃতজ্ঞ প্রাণপুরুষ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। কৃতজ্ঞ জাতির কৃতজ্ঞ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কৃতজ্ঞচিত্তে গভীর শ্রদ্ধাভরে বাংলাদেশ স্মরণ করে মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু অধ্যাপক ওয়ারিস মিরকে। সেই শ্রদ্ধাবোধ থেকে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে বন্ধুর সম্মাননা দিয়েছিল তাকে। সেই সম্মাননা ২০১৩ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে গ্রহণ করেছিলেন অধ্যাপক ওয়ারিস মিরের পুত্র সাংবাদিক হামিদ মির। এই সাংবাদিক হামিদ মির একবার করাচী প্রেসক্লাবের সামনে ব্যানারও নিয়ে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের কাছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ওপর নির্মমতা তথা খুন, ধর্ষণ, গণহত্যা- লুটপাট ও ক্ষমা চাওয়ার জন্য জোর দাবি জানিয়েছিলেন। এ জন্য তিনি বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ের কাছে স্থান করে নিয়েছিলেন। অনেক অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন তার বাবার মতো সাহস প্রদর্শনের জন্য। বাংলাদেশের মানুষ তখন ভেবেছিলেন হামিদ মির ব্যাটার মতো ব্যাটা বা বাপকা ব্যাটা। কিন্তু ৪০ বছর পর হামিদ মির এ কী বলছেন। তিনি আজ অজ্ঞাত কারণে বলছেন তার বাবাকে দেয়া সম্মাননা ফিরিয়ে দিতে। বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, সম্মাননা দেয়ার সময় নাকি আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন পাকিস্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার। তিনি নাকি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি। আর সে কারণেই তিনি তার বাবাকে দেয়া সম্মাননা ফিরিয়ে দিতে চাইছেন। প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কিনা জানি না। আর দিয়ে থাকলেও বাংলাদেশের একান্ত অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পাকিস্তান হস্তক্ষেপ করে তাহলে সুসম্পর্ক স্থাপন করা কি বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব। পাকিস্তান যদি তার পার্লামেন্টে প্রকাশ্যে প্রস্তাব এনে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার ওপর হস্তক্ষেপ করে তাহলে সুসম্পর্ক যে গড়া যায় না সেটা সাংবাদিক হামিদ মিরের না বোঝার কথা নয়! তাছাড়া তিনি একজন সাংবাদিক। তিনি সবই বোঝেন ও জানেন। আর অধ্যাপক ওয়ারিস মিরের সন্তান হিসেবেও সম্প্রতি পাকিস্তানের কাজ কারবার তার কাছে অজানা থাকার কথা নয়। এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে বড় কথা হলো তার পিতাকে দেয়া সম্মাননা ফিরিয়ে দেয়ার অধিকার তার নেই। এ সম্মাননা, শ্রদ্ধা, ভালবাসা-কৃতজ্ঞতা বোধের। বাঙালীর অন্তরের নিংড়ানো শ্রদ্ধা-ভালবাসার প্রতীক এ সম্মাননা। কোটি কোটি বাঙালীর অন্তরের ভালবাসায় সিক্ত এ সম্মাননা ফিরিয়ে দেয়ার অধিকার বা ক্ষমতা কোন পাকিস্তানীর তো নেই-ই হামিদ মিরেরও নেই। এ প্রসঙ্গে মুহম্মদ জাফর ইকবাল যথার্থই বলেন ‘একজন সাংবাদিক এই সহজ বিষয়টা বুঝতে পারছেন না আমার সেটা বিশ্বাস হয় না। আমার ধারণা বাংলাদেশের সঙ্গে তার মাখামাখির কারণে সেই দেশের মিলিটারি কিংবা অন্য কেউ তাকে প্রাণের ভয় দেখিয়েছে এবং দুর্বল মানুষ নিজের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করছে। দোয়া করি তিনি প্রাণে বেঁচে থাকুন। তিনি বেঁচে থাকবেন ঠিকই কিন্তু একবার মরে গিয়ে বেঁচে থাকবেন। আর অনেকের সঙ্গে আমারও বড় দুঃখ হামিদ মির মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হলেন। হতে পারলেন না ‘বাপকা ব্যাটা’। লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক ব্যাংকার
×