ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চাকরির বয়স নিয়ে বুয়েট শিক্ষকদের আবদার

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ২৩ মে ২০১৭

চাকরির বয়স নিয়ে বুয়েট শিক্ষকদের আবদার

বিভাষ বাড়ৈ ॥ ‘২০১২ সালের ১০ জুলাইয়ের পূর্বে যে সমস্ত শিক্ষকগণের বয়স ৬০ বছর পূর্ণ হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক (অবসর গ্রহণ, বিশেষ বিধান) আইন, ২০১২ প্রযোজ্য হবে না। কিংবা আপাতত বলবৎ অন্য কোন আইন, অধ্যাদেশ, রাষ্ট্রপতির আদেশ, বিশ্ববিদ্যালয় সংবিধি, বিধি, প্রবিধি, উপ-আইন অথবা আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন কোন দলিলে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ৬৫ (পঁয়ষট্টি) বৎসর বয়স পূর্তিতে চাকুরি হইতে অবসর গ্রহণ করিবেন।’ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে জন্য জাতীয় সংসদে পাস করা এ আইন এখন কার্যকর থাকলেও তার বাইরে গিয়েই অভিনব আবদার তুলে রীতিমতো অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেছেন খোদ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রবীণ শিক্ষকদের একটি গ্রুপ। আইনে নেই, তবু তাদের দিতে হবে নতুন পে-স্কেল অনুসারে অবসরসহ সকল সুযোগ সুবিধা। দিতে হবে নতুন আইন পাসের আগে থাকা সেশন বেনিফিটসহ আরও বহু সুŸিধা। অথচ আইনের ধারা ৩ অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ৬৫ বছর পূর্তির পর সেশন বেনিফিট বা অন্য কোন সুযোগ সুবিধা পাওয়ার সুযোগ নেই। এখানেই শেষ নয়, এসব অবৈধ ও বেআইনী দাবি করে সকল প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধ রেখেছেন যেসব শিক্ষক তাদের অধিকাংশরই এখন চাকরির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই ৬৫ বছর চাকরির বয়স হয়ে যাওয়ার পরেও ক্লাস পরীক্ষা গ্রহণসহ নিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল সুযোগ সুবিধা। অবৈধ দাবি নিয়ে শিক্ষকদের এমন আচরণে হতাশ ও ক্ষুব্ধ সাধারণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নতুন পে-স্কেলে বেতন প্রাপ্ত হয় ২০১৫ সালে। সে হিসেবে বুয়েট শিক্ষকদের নতুন পে-স্কেল অনুসারে আগের তুলনায় বেতন বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় দ্বিগুণ। কিন্তু যেসকল শিক্ষক ২০১২ সালের ১০ জুলাইয়ের আগে অবসরে গিয়েছেন এমন অন্তত ২০ জন প্রবীণ শিক্ষক নতুন পে-স্কেল অনুযায়ী পেনশনের টাকা দাবি করছে। এ নিয়ে রীতিমত সরকারকে চাপাচাপি শুরু করেছেন শিক্ষকরা। অথচ সরকার বলছেন, ‘তাদের এই চাওয়া সম্পূর্ণভাবে বেআইনী, ভিত্তিহীন ও অযৌক্তিক। তারা আইনের বাইরে গিয়ে অনৈতিক দাবি করতে পারেন না’। অন্যদিকে তাদের এই দাবিকে ‘অতি লোভ’ বলেও সমালোচনা করছেন খোদ শিক্ষকরাই। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বুয়েট শিক্ষকদের আইন অনুসারে চলার পরামর্শ দিলেও কোন ফল পাওয়া যাচ্ছে না। বরং শিক্ষকরা তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নামানোর জন্য চেষ্টা করছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বুয়েটের এই প্রবীণ শিক্ষকদের দাবির পক্ষ নিয়ে বুয়েট শিক্ষক সমিতিও ক্লাস-পরীক্ষা ব্যতিরেকে সকল প্রশাসনিক কর্মকা- থেকে নিজেদের সরিয়ে রেখেছেন। এছাড়া ওইসব শিক্ষকরা অন্দোলন করছেন প্রায় তিন মাস ধরে। শিক্ষক সমিতির ব্যানারে আন্দোলন চললেও বেশিরভাগ শিক্ষকই এই আন্দোলনকে বলছেন ‘অনৈতিক আবদার বাস্তবায়নের আন্দোলন’। যাতে সমর্থন নেই সাধারণ কোন শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর। তারাও বলছেন, নিয়ম বিহর্ভূতভাবেই প্রবীণ এই শিক্ষকরা অতিরিক্ত পেনশনের টাকা দাবি করছেন। অথচ তাদের এখন চাকরিই অবৈধ। আন্দোলনের নামে ৬৫ বছরের পরেও কিভাবে চাকরি করছেন তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি ও বুয়েটে প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৬২ সালের ৪৩ ধারা অনুযায়ী একজন শিক্ষক ৬০ বছর বয়সে অবসর নিবেন। তবে তিনি যদি শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় যদি বিবেচনা ও প্রয়োজন মনে করে তাহলে অবসরের পরেও এই শিক্ষক প্রথম ধাপে ২ বছর, দ্বিতীয় ধাপে ২ বছর এবং সর্বশেষ আরও ১ বছর সর্বোচ্চ অর্থাৎ এই ৫ বছর চাকরি করতে পারবেন। তবে প্রতি ধাপে ওই শিক্ষককে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডকেটের কাছে আবেদন করতে হয় এবং সিন্ডিকেটের অনুমতি সাপেক্ষে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি ও চ্যান্সেলরের অনুমতির পর বর্ধিত সর্বোচ্চ পাঁচ বছর শিক্ষক হিসেবে কর্মরত থাকতে পারতেন। তবে শর্ত ছিল এই ৫ বছর তারা ক্লাস-পরীক্ষা ছাড়া অন্য কোন প্রশাসনিক কাজে জড়িত থাকবেন না। তাদের চাকরি মূলত ৬০ বছরেই শেষ। অতিরিক্ত সময় ছিল এক্সটেনশন পিরিয়ড। কিন্তু গত ২০১২ সালের ১০ জুলাইয়ে জাতীয় সংসদে এক আইন পাসের মাধ্যমে সরকার ঘোষণা দেয়, এখন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা ৬০ বছর অবসরের পরিবর্তে ৬৫ বছরে অবসর নিতে পারবেন। আগের মতো বর্ধিত ৫ বছর চাকরির সুযোগ থাকছে না। এরই মধ্যেই বুয়েটের প্রায় ২০ জন প্রবীণ শিক্ষক ২০১২ সালের ১০ জুলাইয়ের আগেই ৬০ বছর পূর্ণ করে নিয়ানুযায়ী অবসর নিয়েছেন। তবে তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকায় এবং তাদের আগ্রহ থাকায় প্রথম ধাপে দুই বছর চাকরির অনুমতি নিয়ে কাজ করেন। এরপর সরকারের কেউ নজর না দেয়ার অধিকাংশই পরবর্তীতে আর কোন আবেদন না করেও বাকি তিন বছরও কাজ করেছেন। সে অনুসারেও তাদের বর্ধিত ৫ বছর চাকরির বয়স ২০১৭ সালের মধ্যেই শেষ হয়েছে। কিন্তু ওই ২০ জন প্রবীণ শিক্ষক দাবি করছেন তাদের নতুন পে-স্কেল অনুযায়ী পেনশনের টাকাও পরিশোধ করতে হবে। জানা গেছে, অগের পে-স্কেল শিক্ষকরা পেতেন ৪০ হাজার টাকা। পরে নতুন স্কেলে এই একই গ্রেডের শিক্ষকরা ৭৮ হাজার টাকা বেতন পাচ্ছেন। সে হিসেবে পেনশনের টাকাও বেড়ে হবে দ্বিগুণ। ফলে প্রতি শিক্ষক পেনশন বাবদ প্রায় ৭০ লাখ থেকে ৮০ লাখ টাকা পাবেন। এত টাকাই ওইসব শিক্ষককে ঘিরে ধরেছে বলে সমালোচনা করেছেন শিক্ষকরা। ফলে অইনে না থাকলেও তারা বাড়তি টাকা দাবি করছেন। আর এ জন্যাই গত প্রায় তিনমাস ধরে এই দাবিটি তুলে ধরে আন্দোলন করছেন শিক্ষকরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষক সমিতির এক নেতা বলছিলেন, তারা প্রবীণ শিক্ষক তাই প্রকাশ্যে কিছু বলতেও পারছি না। তবে এ ধরনের আবদান বুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা কিভাবে তোলেন বুঝি না। তাদের চাকরি চলে গেছে ৬০ বছর হওয়ার পরেই। এই সময়ে চাকরি করেছেন তা নিয়েই আছে প্রশ্ন। এখন ৬৫ বছর পরেও তারা কাজ করছেন। নতুন আইন হওয়ার আগে ৬০ বছর হয়ে গেলেও তারা নতুন আইন অনুসারে সুবিধা চাচ্ছেন যা দেশের আইন পারমিট করে না। তারা প্রবীণ শিক্ষক তাই অনেক সময় সমর্থন করতে হয়। বুয়েটের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ফরিদা নিলুফার কথাতেও তেমনই ইঙ্গিত পাওয়া গেল। তিনি বলেছেন, ২০১২ সালের ১০ জুলাইয়ে অবসরের বয়সসীমা ৬০ বছরের জায়গায় ৬৫ করা হয়। কিন্তু ১০ জুলাইয়ের আগে অবসরের বয়সসীমাও ৬৫টিই ছিল। সুযোগ ছিল কোন শিক্ষক চাইলে ৬০ বছরের পরে যে কোন সময় অবসর নিতে পারবেন। তিনি আরও বলেন, প্রবীণ এসব শিক্ষক যে নতুন স্কেলের আওতায় পেনশন পাবেন না তা কোন নোটিস দিয়ে শিক্ষামন্ত্রণালয় ও ইউজিসি বিশ্ববিদ্যালয় অথবা শিক্ষকদের জানায়নি। ওইসব শিক্ষক তো নতুন পে-স্কেলে পেনশন পাবে বলেও আশায় রয়েছেন। অপর এক শিক্ষক বলছিলেন, আমরা তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আইনের বাইরে গিয়ে প্রবীণ এসব শিক্ষক পেনশনের টাকা দাবি করছেন। ফলে, নৈতিক জায়গা থেকে হলেও ভেতরে ভেতরে বেশিরভাগ শিক্ষক সমর্থন করছেন না। বুয়েটে প্রায় সাড়ে ৫শ’ শিক্ষক থাকলেও মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছাড়া বাকি সবাই এই অন্দোলনে অংশ নিচ্ছে না। শিক্ষকদের দাবির বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচর্য অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বিদেশে আছেন। তাই তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। এদিকে সমস্যা সমাধানে বুয়েটের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) বেশ কয়েকবার চিঠি আদান প্রদান হয়েছে। অথচ সমস্যা কোন সমাধান হয়নি। ইউজিসি ও বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রবীণ এই শিক্ষকরা ইউজিসিতে চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নানের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাত করেন। তবে সেই সাক্ষাতে প্রবীণ এই শিক্ষকদের ভূমিকা অনেকটা আক্রমণাত্মক ও অসদাচরণ ছিল বলে অভিযোগ ওঠে। এমনকি ইউজিসির পক্ষ থেকে সবার নাম উল্লেখ করে আবেদন করার পরামর্শ দিলেও তারা নামসহ কোন আবেদন করতে রাজি হননি। সোমবার এমন শিক্ষকদের অন্তত চারজনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হয়। দুইজন জনকণ্ঠের সঙ্গে কোন কথা বলতে রাজি হননি। বলেন না জনকণ্ঠের কারও সঙ্গে তারা কথা বলবেন না। পরে অবশ্য অনুরোধ করেন নাম যেন না উল্লেখ করি। অপর দুজন বলেন, এ নিয়ে আমরা যেহেতু কোথাও লিখিত দেইনি। তাই এখনই মিডিয়ায় নামসহ কথা বলা যাবে না। আন্দোলন তো করছেন? একথা বলার পর তারা বলেন, শীঘ্রই আমরা ইউজিসিতে লিখিত দিব। তখন দাবির পক্ষে যুুক্তি তুলে ধরা হবে। এদিকে বুয়েটের শিক্ষকদের দাবিকে অযৌক্তিক অভিহিত করে ইউজিসির চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান বলেছেন, আইনে বলছে নতুন পে-স্কেল অনুযায়ী তারা পেনশনের টাকা প্রাপ্ত হবে না। অথচ ২০ জন শিক্ষক এই টাকার দাবি করছেন। তারা বলছেন, ইউজিসির আইন মানি না। তাদের টাকা দিতে হবে। কিন্তু চাইলেই তো আইনের বাইরে কোন কিছু করা যাবে না। কারণ, তাদের দাবি অনুযায়ী টাকা দিলে তো সরকারের আইনের বরখেলাপ হবে। তিনি আরও বলেন, বুয়েটের সঙ্গে ইউজিসির কয়েকবার কথা হয়েছে, শিক্ষামন্ত্রণালয়েরও কথা হয়েছে। সেখানে আমরা বলেছি তারা আইন অনুযায়ী টাকা পাবেন না। কিন্তু বুয়েটের সাবেক বেশ কিছু শিক্ষকও সুপারিশ করছে তাদের দাবি মেনে নিতে। কিন্তু এতবড় অনিয়ম তো আমরা করতে পারি না, কারণ টাকা তো আসে সরকার থেকে। সরকার আইনের বাইরে গিয়ে তো কোন কিছু করবে না। পরিস্থিতিতে বিব্রত শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, নতুন আইন হওয়ার পর আগের সকল আইন বিধান যা আছে সব বাতিল। তাই এখন আগের কথা বলে কিছু দাবি তোলা অন্যায়, অযৌক্তিক। বুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা যদি এভাবে বারবার দাবি তোলেন যা আইনসম্মত নয় তাহলে তো মানুষ প্রশ্ন তুলবে। আমার আহ্বান হবে তারা যেন আইন মেনে দাবি করেন। তাহলে আমরা তাদের বিষয়টি দেখতে পারি। তবে বেইনী হলে তো করার কিছু থাকে না।
×